– এই এই, তোমার সমস্যা কি ? সমস্যা কি তোমার ?
– আমার আবার কি সমস্যা!
– বিয়ার পর থাইকা রোজ সকালে এই ডিম পোস আর আলু ভাজি ছাড়া কপালে কিছু জুটে না। এই! বিয়া বসার আগে সারাদিন কি বাপ মার বাড়িতে বইসা আলু আর ডিম খাইছো ?
– আর কিছু বলবা ?
– কি আর বলবো! কিছু বললেই তো মুখটা প্যাঁচা পাখির মত কইরা বইসা থাকো।
– জানো যখন তখন বলতাছো কেন ?
– এই খবরদার! খবরদার বইলা দিলাম! আমি কিন্তু শিকদার বংশের লোক। সারা শরীর ভরা জেদ। খবরদার আমার সামনে রাগ দেখাইবা না। একে তো পারো না কোন কিছু তারপর উপর আবার রাগ দেখাও।
– ভাল করি।
– ওই পাশের বাসার মজনু ভাইরে দেখো। রোজ অফিসে যাওয়া মাত্র শুরু হইয়া যায় তার বকবকানি। আজ সকালে তার বউ এই রেসিপি রান্না করছে। দুপুরে বাসায় যাইয়া উমুক রেসিপি দিয়া ভাত খাবো। আর আমার হইলো রাজ কপাল। মাসের তিরিশ দিন একই রেসিপি দিয়া ভাত খাইতে হয়।
– তা তোমার ওই মজনু সাহেবের বাড়িতে গিয়া তিন বেলা খাইলেই ঝামেলা সাইড়া যায়।
– তোমার আক্কেল জ্ঞান দিন দিন কমতাছে। এই বাড়ি আমার। এই বাড়িতে আমি থাকি, আমার বউ থাকে। আর আমি যাইয়া খাওয়া দাওয়া করবো আরেক বাড়িতে! তোমার মাথা ঠিক আছে তো ?
– আমার মাথা ঠিকি আছে।
– আম্মা মারা যাওয়ার আগে তোমার মত একটা আমড়া কাঠের ঢেকিরে কেন যে আমার ঘাড়ে তুইলা দিছিলো আল্লাহই জানে।
– এই কই যাও! নাশতা কইরা যাও।
– তোমার নাশতা তুমিই খাও। বেশি বেশি কইরা আলু আর ডিম খাও। দিন দিন তো আলু আর ডিমের মত হইতাছো।
– এখন কিন্তু বারাবারি করতাছো।
– শোনও, অফিসে যাওয়ার আগে তোমারে আমি স্পষ্ট বইলা যাইতাছি। আমি আজ দুপুর বেলা নতুন রেসিপি দিয়া খাত খাবো। যদি খাবার টেবিলে নতুন রেসিপি না পাই তা হইলে কিন্তু এ বাড়ির সব কিছু ভাঙ্গাইয়া ফেলবো বইলা দিলাম।
– হইছে যাও। এখন মাথা ঠান্ডা কইরা অফিসে যাও।
– গেলাম।
আজব এক মেয়ে মানুষ নিয়া সংসার করি। স্বামীর ভাল মন্দ তো বুঝেই না, স্বামীর সখ আহ্লাদ বইলা যে কিছু আছে সেইটাও বুঝে না। কোন দুঃখে যে বিয়া করতে গেছিলাম। সব দোষ আমার মরহুম আম্মাজানের। কত বার বলছি সবে মাত্র বয়স হইছে পঁয়ত্রিশ। আমার তো এখনও প্রেমের বয়সী পার হয় নাই কি দরকার আছে বিয়া সাদির! আমার বয়সী বন্ধু বান্ধবরা এখনও স্কুল কলেজের সামনে দাঁড়ায়া থাকে। আমার লজ্জাবোধ একটু বেশি হওয়ায় তাদের সাথে যাওয়া হইতো না। তাই বইলা এখনই বিয়া করতে হবে! কে শুনে কার কথা, ধইরা দিলো বিয়া করায়া। তাও এমন বউ কপালে জুটছে, তারে কিছু বলা আর কলা গাছরে বলা এক কথা।
– এই শোন।
– কি বলবা তারাতারি বলো। অফিসে জরুরী কাজে ব্যস্ত আছি।
– হুম তা তো জানি। আমারে সময় দেয়ার মত সময় নাই তোমার।
– আমি অফিসে আসলে কি তোমার ভালবাসা বাইড়া যায় ?
– কেন আমি মনে হয় তোমারে সব সময় ভালবাসি না!
– তুমি যদি ভালইবাসতা তা হইলে বিয়ার পর থাইকা আলু আর ডিম খাওয়া রাখতা না। রোজ রোজ ভাল ভাল মুখরোচক রেসিপি খাইতে দিতা।
– হা হা হা, তুমি পারও বলতে।
– হাসি থামাও, তোমার হাসি দেখলে আমার গা জ্বলে। কি জন্য ফোন দিছো সেইটা বলো।
– আজ দুপুরে তোমারে নতুন একটা রেসিপি খাওয়ামু।
– সত্য! সত্য বলতাছো ?
– হুম, সত্যি।
– আমি এখনই আসতাছি। অফিসের সব কাজ বন্ধ আজ।
– আরে না না এখন না। আমার তো রান্নাই করা হয় নাই। দুপুরে ঠিক সময় মত আইসো।
– ইস! আমার যে কি আনন্দ লাগতাছে বউ, মনটা চাইতাছে এখনই উড়াল মাইরা চইলা আসি।
– পাগল একটা, রাখলাম।
– আইচ্ছা, রাখো।
আজকের দিনটা আমার এতো ভাল এইটা তো আমার কল্পনাতেও ছিল না। আহ! বিয়ার পর এই প্রথম বউ এর হাতে নতুন রেসিপি দিয়া ভাত খাবো। আনন্দে চোখ দিয়া পানি চইলা আসতাছে। নাহ, বউটারে শুধুশুধু গাল মন্দ করি। এইটা ঠিক না। আমার মুখের দিকে তাকায়া সে আজ নতুন রেসিপি রান্না করতাছে। এমন সোনায় সোহাগা বউ আজকাল পাওয়াটাও বেশ মুশকিলের। মরহুম আম্মাজান, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
বউ এর নতুন রেসিপির কথা শুইনা অফিসের কোন কাজেই আর মন বসতাছে না। এদিকে ঘড়ির কাটাও আজকে আর সামনে যায় না। মেজাজটাই খারাপ হইয়া যাইতাছে। বারবার ঘড়ির কাটার দিকে তাকাইতাছি, মন হইতাছে কাটা এক জায়গায় দাঁড়ায়া আছে। ইচ্ছা করতাছে হাত দিয়া ঘড়ির কাটাটা ঘুরায়া দেই। বিরক্তিকর সময় অনেক কষ্টে পার করার পর দুপুর দুইটা বাজতেই অফিস থেকে দিলাম এক দৌড়। এক দৌড়ে বাড়িতে।
– বউ আমি চইলা আসছি!
– ও মা! তোমার না তিনটার পর আসার কথা।
– আরে রাখো তোমার তিনটা, সকালে না খাইয়া অফিসে গেছি। ক্ষিদায় পেটের ভিতর চো চো করতাছে।
– ক্ষিধায় পেট চো চো করতাছে না কি নতুন রেসিপি শুইনা অফিস থেইকা দৌড়ায়া চইলা আসছো, কোনটা?
– লজ্জা দিয়ো না বউ, জানো আমার লজ্জা একটু বেশি।
– সেইটা তো বুঝতেই পারি। যাও, তুমি হাত মুখ ধুইয়া আসও। আমি টেবিলে খাবার দেই।
– নতুন রেসিপি রান্না হইছে তো না ?
– হুম হইছে।
– আচ্ছা আমি আসতেছি।
কিসের হাত মুখ ধোয়া আর কিসের কি! কোন মতে হাতে মুখে পানি দিয়া খাবার টেবিলে আইসা বইসা আছি। বউ যে রান্না ঘরে কি করে কে জানে। আমার তো আর সহ্য হইতাছে না। আর কতক্ষণ বসায়া রাখবে! কি জ্বালার মধ্যে পড়লাম, আজকে মনে হইতাছে কোন কিছুতেই সময় যাইতাছে না।
– এই, আর সময় ধইরা বসায়া রাখবা। ভাতের প্লেটে তো ভাত ঠান্ডা বরফ হইয়া গেলো।
– এই তো হইয়া গেছে।
– এইটা কি নতুন রেসিপি ?
– হুম, তোমার জন্য বানাইছি।
– দেখতে কিন্তু বেশ ভাল লাগতাছে। মুরগী, গরু, মাছ তিনওটাই একসাথে। তরকারির ঝোলের রংটাও দেখতে ভাল হইছে। খাইতেও মনে হয় বেশ সুস্বাদু হবে।
– নাও, খাইয়া দেখও কেমন হইছে।
– আরে এগুলা কি! হা হা হা, বুঝছি তরকারির ঝোলের মধ্যে নুডুল দিছো।
তোমার মাথায় যে এতো বুদ্ধি আগে জানতাম না। আমার আম্মাজান সারাজীবন উনি তরকারির মধ্যে আলু দিয়া খাওয়াইছে। কিন্তু তরকারির মধ্যে নুডুলস দিয়া খাওয়ায় নাই। দাও আরেকটু দাও।
– হুম নাও, কেমন হইছে।
– স্বাদটা ভালই হইছে কিন্তু কেমন জানি সব কিছু মাটি মাটি লাগতাছে। মুখে জ্বর ঠোসা উঠছে তো তাই মনে হয় স্বাদ পাইতাছি না। ওই মাংসের টুকরাটা দাও। না না ঝোল দিয়ো না আর।
আহ! আজ মনে হইতাছে কত বছর পর পেট ভইরা খাওয়া দাওয়া করলাম। মনের সুখে শান্তিতে বিছানায় চার হাতপা ছড়ায়া শুইয়া আছি। আনন্দে গান গাইতে মন চাইতাছে আমার। জীবনে খুব সখ ছিল বউ এর হাতে নতুন রেসিপি দিয়া খাওয়া দাওয়া করবো। আজ সেই সখ আমার পুরন হইছে। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো অন্য জায়গায়। খাওয়ার আধা ঘন্টা পর থেকেই পেটের ভিতর কেমন জানি মোচড় দিয়া উঠতাছে। এর মধ্যে দুই দুইবার টয়লেটে যাওয়া গেছি। পেটের অবস্থা তো ভাল ঠেকতেছে না!
– বউ, আমারে ধরো। আমারে টয়লেটে দিয়া আসো। হাঁইটা যাওয়ার মত শক্তি নাই আমার।
– কি হইলো তোমার ?
– জানি না, কিছুই বুঝতে পারতাছি না। খালি পেটের মধ্যে মোচড় মাইরা উঠে। আরে তারাতারি ধরো আমারে।
– চলো, তারাতারি চলো।
সময় বাড়তেই আমার অবস্থা আরো খারাপের দিকে। সারা শরীর ছাইড়া দিচ্ছে। টয়লেটে যাইতে যাইতে আমার অবস্থা খারাপ। কোন ওষুধপাতি, কোন কিছুতেই কাজ হয় না। ও আল্লাহ রে! এ কোন গজবের মধ্যে ফালাইলা আমারে। মানুষের মনে একটু সখ আহ্লাদ থাকে। আমি না হয় একটু সখ করছিলাম বউ এর হাতে নতুন রেসিপি খামু তাই বইলা এমন শাস্তি দিলা! এখন আমার কি হবে ? আমার জীবনতো যাইতাছে টয়লেটে যাইতে আর আসতে। ও মা গো! তুমি কি বউ বিয়া করায়া রাইখা গেলা।
টানা তিন দিন বিছানা আর টয়লেট ছাড়া আর কোথাও যাই নাই। জীবনে বড় পাপ করছিলাম বউ এর হাতে নতুন রেসিপি খাইয়া। যার শাস্তি এখন পর্যন্ত ভোগ করতে আছি। তবে এখন কিছুটা সুস্থ হওয়ার পথে আছি। এই তিনটা দিন যেনও আমার উপর আল্লাহর গজব পড়ছিল। এখনও চোখ মেইলা ঠিকমত তাকানোর শক্তি পাইনা। একটার পর একটা স্যালাইন খাইতেছি আর খাইতাছি। দেখি শরীরের অবস্থার কোন উন্নতি হয় কি না।
– কেমন লাগতাছে এখন তোমার ?
– মানুষ মরার পথ থাইকা বাঁইচা ফিরলে যেমন লাগে ঠিক তেমন।
– এই তিন দিন তো কথাই কইতে পারো নাই ঠিকমত। আজকে তো তাও কথা কইতাছো।
– আমার কথা কি তোমার সহ্য হইতাছে না ? না কি আমি বোবা হইয়া গেলে তুমি খুশি হইতা ?
– তোমার যত আজগুবি কথাবার্তা।
– কৈই যাও ?
– রান্নাঘরে।
– রান্নাঘরে কেন ?
– আজব তো! রান্না করা লাগবো না।
– তোমার আর রান্নাঘরে যাইয়া কাজ নাই।
তোমার ওই নতুন রেসিপি খাইয়া আমার এই অবস্থা। তুমি আর ভুলেও কোন দিন রান্না করবা না। দরকার হইলে আমি তিন বেলা খাবার হোটেল থাইকা নিয়া আসবো। তারপরও তোমার হাতের রান্না আমি আর কোন দিনও খামু না।
– আর নতুন রেসিপি ?
– ও রে! নতুন রেসিপির কথা শুইনা আবার পেট মোচড় মারছে। আমারে ধরো, টয়লেটে নিয়া যাও।
– হায় রে কপাল আমার, চলো।