জিনিয়া পেয়ারা গাছে চড়ে আর নামতে পারছে না। ওর খুব অসস্তি লাগছে। একটা মেয়ে হয়ে গাছে চড়া ওর বোধহয় ঠিক হয়নি। ওর মা রেহেনা বেগম ওকে অনেকবার নিষেধ করেছে। কিন্তু ও ছোটবেলা থেকেই যেমন ওর মায়ের কথা শোনেনি, আজও তাই করেছে। কিন্তু কাজটা যে অনেকবড় ভুল হয়েছে, জিনিয়া এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। আশে পাশে কেউ নেই, ওকে সাহায্য করার জন্য। তাছাড়া কারো কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার মেয়ে ও নয়। জিনিয়াদের বাড়ির আঙিনাটা তুলনামুলক বড়।
ওর দাদার গাছ লাগানোর বাতিক ছিল। যার কারনে ওদের বাড়ির আঙিনাটা ছোটখাটো একটা বাগানে পরিণত হয়েছে। জিনিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পেয়ারা গাছ থেকে লাফ দিয়ে সে নিচে নামবে, কিন্তু সে লাফ দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। এর আগে জিনিয়া আম গাছ থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিল।যার কারনে সে পনেরো দিন ভালো ভাবে হাঁটতে পারেনি। লাফ দেওয়া ছাড়া উপায় না পেয়ে জিনিয়া চোখ বন্ধ করে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। চোখ বন্ধ করার কারনে সে বুঝতে পারল না যে, গাছের নিচে একটা ছেলে এইমাত্র এসে দাঁড়িয়েছে। লাফ দেওয়া সাথে সাথেই বিপত্তিটা ঘটে গেলো।
-এই, এই তুই আমার উপর লাফ দিলি কেনো?
– আমি কি তোকে দেখেছি? আমি তো মনে করেছি, নিচে কেউ নাই।
– তোর কপালে কি চোখ নাই? আমার তো মনে হচ্ছে, তুই ইচ্ছে করেই এটা করেছিস।
– একদম মিথ্যা কথা বলবি না,।
– আমি মিথ্যা কথা বলছি? দাঁড়া আমি এখুনি মা কে বলে দিচ্ছি।
এতোক্ষণ জিনিয়া যার সাথে কথা বলছিল, সে তার আপন ভাই রুহান। রুহান ও জিনিয়া দুজনে সমবয়সী। একই স্কুলে পড়ার কারনে ওদের মধ্যে সারাক্ষনই ঝগড়া লেগে থাকে। রুহান এর বৈশিষ্ঠ্য হলো জিনিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। ছেলে হিসেবে রুহান শান্তশিষ্ট । সারাক্ষন পড়ালেখা নিয়ে থাকার কারনে চেহারাটা কিছু বোকা বোকা টাইপের। ক্লাসে সবসময় রোল এক হওয়া সত্তেও সে জিনিয়ার অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা। যার কারনে সবাই ওকে মেধাবী বললেও জিনিয়ার কাছে সে গাধা।
রুহান হনহন করে মাকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। ভেতরে ঢুকেই ওর ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গেলো। কারন মাকে বলে কোনো লাভ নেই। জিনিয়ার ব্যাপারে নালিশ দিলে পরবর্তীতে জিনিয়া সবার সামনে ওকে কঠিন প্রশ্ন করে অপমান করবে। তাই মার কাছে নালিশ না দিয়ে রাগে গজগজ করতে করত সোজা পড়ার টেবিলে বসে জোরে জোরে পড়তে লাগল। দূরথেকে জিনিয়া রুহানের কর্মকান্ড দেখছিল, আর হাসছিল। এভাবেই চলছিল ওদের ভাই বোনের খুনসুটি। কখনো পড়ার টেবিলে, কখনো খাওয়ার সময়, আবার কখনো স্কুলে যাওয়ার সময়, ঝগড়া লেগেই থাকত। ঝগড়া যেমন লেগেই থাকত, তেমনি ওদের একে অপরের জন্য ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা।
সামনে জিনিয়া ও রুহানের এসএসসি পরীক্ষা। টেষ্ট পরীক্ষার পর খুব তোড়জোড় করে ওরা পড়ালেখা করছে। ঝগড়া করার মতো সময় ওদের কাছে বলতে গেলে নেই। এমনই একদিনের কথা- বিকালবেলা জিনিয়া পড়ছিল। এমন সময় ওর মা এসে ওকে ডেকে নিয়ে গেল অন্য একটা রুমে। সেখানে গিয়ে জিনিয়া বুঝতে পারল, ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ছেলে নাকি একজন সরকারী চাকুরীজীবি। মহুর্তের মধ্যে জিনিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মায়ের কাছে জেদ করলো, পরীক্ষার আগে সে বিয়ে করবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা? রুহান সব বুঝতে পারল, কিন্তু ছোট বলে সেও মুখ ফোটে প্রতিবাদ করতে পারল না। অবশেষে অনেক কান্না-কাটি করা সত্তেও জিনিয়ার বাবা-মার পছন্দ করা ছেলে সাথে বিয়েটা হয়ে গেলো। বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই জিনিয়া জীবনটা পরিবর্তন হয়ে গেলো। যে মেয়েটা সারাদিন টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াতো, সে মেয়ে এখন সারাদিন ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ যে মেয়েটার হাতে ভাঙ্গে যাওয়ার ভয়ে মা কখনো কাঁচের গ্লাস দিতো না। আজ সেই মেয়ে একটা সংসার সুন্দর -সাবলীলভাবে গুছিয়ে নিয়েছে।
বিয়ের ১বছরে পরের কথা আজ বেশ কয়েকদিন হলো জিনিয়া বাবার বাসায় আসছে। বিয়ের ১ বছরের মধ্যেই জিনিয়ার গর্ভে জন্ম নিয়েছে এক নতুন অস্তিত্ব। আজ সেই অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসার কথা। পরিবারের সবাই খুশি কারন, কেউ বাবা হচ্ছে, কেউ দাদা, হচ্ছে, কেউ নানা হচ্ছে, কেউবা নানী হচ্ছে। কিন্তু যে মেয়েটা মা হচ্ছে, শুধু তার মুখেই হাসি নেই। অজানা আশাঙ্কায় জিনিয়ার বুকটা ধুক ধুক করছিল। অবশেষে জিনিয়া সন্তান প্রসব করলো। ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে জিনিয়ার। কিন্তু নবজাতক সন্তানটা হয়তো জানবে না, মায়ের জীবনের বিনিময়ে সে এই পৃথিবীতে এসেছে।
অবাক হলেন? অবাক হবেন না, কারন সন্তান প্রসবের সময় জিনিয়ার মৃত্যু হয়। বিধাতা হয়তো জিনিয়া নামের মেয়েটির ভাগ্যে এটাই লিখে রাখছিল। আজ নবজাতক সন্তানটিকে সবাই আদর করছে,। কিন্তু যে মেয়েটা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারন করেছিল, সেই মেয়েটাই আজ নিজের সন্তানকে আদর করতে পারছে না। পেয়ারা গাছে চড়ে নামতে না পারা মেয়েটি এখন অন্ধকার কবরে। আচ্ছা আপনি কি বলতে পারবেন, জিনিয়ার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? ওর পরিবার নাকি ভাগ্য নাকি ওর নবজাতক সন্তান নাকি ও নিজে? জানতে খুব ইচ্ছে করে।।।