দেরি করে ফেললাম। ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে কিভাবে সময় চলে যায় ! আকাশে মেঘ জমেছে, দ্রুত যেতে হবে। এতক্ষনে হয়ত নিহাকে দেখতে পাত্র পক্ষ চলে এসেছে। পা চালিয়ে দ্রুত এলাম।
বাবা বারান্দায় বসে আছেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, যাইরে বাজারের দিকে ঘুরে আসি। ভিতর হতে মার ফোপানো কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। যা বুঝার বুঝে নিলাম। এমনি হয় প্রতিবার; চলছে, চলছেই। আমাকে দেখেই নিহা বলল, খেতে আয় তাড়াতাড়ি, ইস ! কি কেলেভূত হয়ে আছিস! গোসল করে খেতে আয় তাড়াতাড়ি। নিহা স্বাভাবিক, ওর মার্বেল চোখে কোন কিছু নেই, কিছুই যেন হয়নি। নিহা এমনই থাকে। পৃথিবীতে যেদিন এলাম, সেদিন চাঁদ এসেছিল। আমার জন্মের ৩ বছর পর নিহা এল, সাথে আষাঢ় এল। ঈশ্বর পারেনও ! এভাবে ঈশ্বর ভবিষ্যৎ ম্যাজিকের বীজ বুনে দিলেন।
দিন যেতে থাকে, শ্যাম নিহা বড় হতে থাকে, এক সময় ঘনিয়ে আসে ম্যাজিকের দিন। হাশেম ঘটক রাতকে দিন বানায়, কালো নিহাকে শ্যাম বানায়, এর বেশি তিনিও পারেন না। পীরের তাবিজ, পুকুরের গোসল, মাজারের শিন্নী কিছুই কিছু পারে না। নিহাকে দেখতে আসা পুরুষগুলোর মন যেহেতু কালো,, তাই বস্তুজগতের নিয়ম মেনে কালোয় কালোয় মনযোগী হয় না। নিহার কালোর সাথে অপার টাকার রসায়ন অসমর্থ বাবা বুঝেও না বুঝার ভান করেন। প্রতিবার পাত্রপক্ষের আসা যাওয়ার পালায় বাবা নিজেই নিজেকে দায়ি করেন। নিহার শ্যাম যে বাবা হতে পাওয়া ! বাবা যদি কালো না হতেন, বাবা যদি নিহার জন্ম না দিতেন, বাবা বড্ড বেঁচে যেতেন। বাবা তাই পাপী, বাবা নিজেই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রবল আক্রোশে বাজারের দিকে চলে যান। আমার মা কাঁদেন, বড্ড কাঁদেন, শুয়ে কাঁদেন, বসে কাঁদেন, রান্না ঘরে কাঁদেন, বাথরুমের কল ছেড়ে দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন। মার কাঁদায় ম্যাজিক শেষ হয় না, কিছুই হয় না, তবু কাঁদেন। মাঝে মাঝে সবকিছুর জন্য নিহাকেই দায়ি করেন। কি আশ্চর্য ! নিহা বড্ড বেহায়ার মত হাসতে থাকে ! নিহা এমনি।
ভাত খেয়ে নিহার ঘরে যাই। নিহা ছবি আঁকছে। আমাকে দেখেই নিহা হাসল। খুব সুন্দর করে হাসল। চাপা শ্বাস বেরুলো। নিহা অনেক সুন্দর করে হাসে। বিলে ফুটে থাকা লালপদ্ম যেভাবে চোখ আটকে দেয়, নিহার হাসিও তেমনি। আচ্ছা কোন ছেলে কি নিহার হাসি দেখেনি ? বোধ হয় দেখেনি। কোন ছেলের কি ইচ্ছে করে না নিহার সুন্দর চুলে মুখ গুঁজে রাখতে ? সবাই শুধু চামড়াই দেখে ? চামড়াই দেখবে ?
নিহার পাশে বসলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। কত মানুষকে ম্যাজিক দেখিয়ে একগাদা বিস্ময় ঝোলা করে ফিরি আর ঘরে ফিরে আল্লাহর ম্যাজিকের সুন্দর সর্বস্বান্ত রুপ চাক্ষুস করি।আল্লাহ জানেন কালো মেয়ের সহজে বিয়ে হয় না তবু কেন নিহাকে তিনি কালো বানালেন ! কেন এমন করে এমন ভাবে খেলতে তার ইচ্ছে হয় !
আমাকে সাদা আর নিহাকে কালো বানিয়ে তিনি কী এমন ক্ষমাহীন অদ্ভুত জটিলতার আনন্দ নিতে চাইলেন ? ? স্রষ্টার আর কি দোষ ! ছোট বেলায় আমরা যখন পুতুল নিয়ে খেলতাম, গাড়ি নিয়ে খেলতাম, আমরা কি ভাঙ্গা – গড়ার নেশায় মাততাম না ! প্রতিটা শক্তিমান ঈশ্বরের খেলাঘরে সব দম দেয়া পুতুল।
নিহা একটি দেয়াল এর ছবি এঁকেছে, দেয়ালের রঙ হলুদ। নিহা দেয়ালের রঙ কে সবুজ করছে এখন। নিহা দেয়াল আঁকলো কেন ? প্রশ্নটা মনে উকি দিতেই নিহা বলে উঠল, যদি দেয়াল হতাম ! – দেয়াল হয়ে কি হত ? – তাহলে যে কোন রঙেই নিজেকে মানানো যেত। আমার মন ও চোখ জ্বলে উঠল। আমি প্রমাণ করে দেব মানুষ ও দেয়াল হতে পারে, দেয়াল হতে জানে। – আমার কাছে আয়। – কেন ? – ম্যাজিক দেখাবো তোকে। তোকে আজ সাদা করে দিব। – মানুষের ম্যাজিক ত মায়া মিথ্যা। – মানুষ ও পৃথিবীর সব – সবটুকু মিথ্যা। এই যে ম্যাজিক দেখিয়ে একটু নাম হয়েছে, লোকে অনুরোধ করে কত জায়গায় নিয়ে যায়, সবাই জানে সব মিথ্যে, তবু তো নিয়ে যায়, দেখে, হাততালি দেয়।
আমার ব্যাগে থাকা সাদা পাউডার বের করে নিলাম। পানি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করলাম। নিহার মুখে পেস্ট মাখাচ্ছি, নিহা হয়ে যাচ্ছে সাদা, ধবধবে, সাদা চামড়ার অলীক মানুষ। বাহ ! আজ জানতে পারলাম নিহা সাদা চামড়ার হলে কালো পৃথিবীতে চাঁদ হয়ে ফুটে থাকত। সাদা হলেই নিহা পৃথিবীর সবটুকু প্রান্তর এক নিঃশ্বাসে ছুয়ে ফেলত। সাদা হলেই নিহা পৃথিবী পচে গলে শুয়োর মুখো গন্ধ ছড়িয়ে ভেঙ্গে টুকরো – টুকরো হয়ে বিলীন হয়ে যেত। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হিংস্র – কালো খুনে শয়তানি বৃষ্টি, সব শস্য – শ্যামল প্রান্তরের টুটি চেপে ধরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, এবড়ো – থেবড়ো করে দিচ্ছে সব কিছু। – আয় উঠোনে , বৃষ্টিতে ভিজি। – আমি বললাম। – অনেক বৃষ্টি ! – হোক। আয় তুই।
উঠোনে দুজন বৃষ্টিতে ভিজছি, এত বৃষ্টি, এত বাতাস, সব উড়িয়ে নতুন করে সভ্যতা বিনির্মাণ করতে যাচ্ছে। বৃষ্টি নতুন আনে, নতুনত্ব আনে, সে নতুনে পুরনোরাই নতুন রুপে আসে, লাভ হয়না কিছুই, মাঝে পড়ে থাকে ঘাড় ভাঙা ধানের শিস, পরাজিত শান্ত গাছ, মরা পাখি, পালক, আর ও অনেক হারাধনের ধ্বংসাবশেষ, টুকরো টুকরো আশা, হতাশার কাব্য। আমরা বৃষ্টিতে ভিজছি, কাপছি, বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে নিহার মুখের সাদা পাউডার। মানুষের ম্যাজিক মিথ্যা, প্রকৃতির ম্যাজিক বাস্তব, ঝরঝরে সত্য। প্রকৃতি নিহাকে যেভাবে দেখতে চায় ঠিক সেভাবে ফিরিয়ে আনছে।
আমি নিহার দিকে তাকিয়ে আছি, নিহার চোখ বন্ধ, ওর শরীর কাঁপছে, থর থর থর থর, বৃষ্টিতে নাকি বেদনায় জানতে ইচ্ছে করছে না। যা হচ্ছে ভালই হচ্ছে, আমাদের চোখের জল, বুকের সবটুকু তাপ – গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে আগ্রাসী বৃষ্টি। আমাদের সব তপ্ততা এক সময় বৃষ্টিকেও স্পর্শ করল, বাঁধ ভাঙ্গা দুঃখ নিয়ে আলো জ্বেলে খুজে নিল অভাগী মেয়েকে, প্রবল মমতা ও শান্তনার স্মারক চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেল নিহার মেঘ চুলে। দূরে কোথাও ডেকে উঠল অস্থির চিল। নিহা পড়ে আছে, ময়ূর পেখমের মত চুল মেলে দিয়ে। আমি নিহার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি – আমাকে জানতেই হবে বৃষ্টি নিহার চুল ছুয়ে কি বলে গেল !!!!!