বাণিজ্য মেলায় সবাই যে বাণিজ্য করতে যায়না তার উৎকৃষ্ট এক উদাহরণ আমাদের আরিফ, ছোটখাটো হাতির বাচ্চা সাইজের পাব্লিক, আদর করে আমরা ছ্যাস্রা বলে ডাকি। ছ্যাস্রা ডাকার পিছনে বিশেষ কোন ভাবার্থ যে নেই তা কিন্তু নয় একেবারেই। কারণ একটা আছে বটে। আর সেটা হলো এই ছেলের কোন রিলেশনই টিকেনা কোনমতে। সর্বশেষ চৌদ্দ নাম্বার রিলেশনটা ব্রেকাপ হলো সবে চৌদ্দ দিনও হলোনা তার। সব রিলেশন ব্রেকাপের কমন একটা কারণ, রিলেশনে থাকা অবস্থায় অন্য মেয়ের সাথে ছ্যাস্রামি আর লুতুপুতু করা!
তো সেদিন হয়তো প্রকৃতির খেয়ালবশত এক আমুদে সন্ধ্যায় আমার মতো অলস স্বভাবের ঘুম প্রিয় মানুষটা হাজির হলাম বাণিজ্য মেলায়, সাথে আরিফ আর রাব্বী। এক্ষেত্রে রাব্বীর সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া ভাল মনে করছি। মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘সতীসাধ্বী মেয়ে’ এই কম্পলিমেন্টটা অনেকের জন্যই ব্যবহার হতে শুনেছি, ছেলেদের বেলায় শুনিনি কখনো। ছেলেদের বেলায় ‘সতীসাধ্বী ছেলে’ এরকম কোন কমপ্লিমেন্টের প্রচলন থাকলে রাব্বীই সবার আগে এই কমপ্লিমেন্টের দাবীদার হতো! আরিফের বিপরীত মতাবলম্বী একেবারেই। তারমতে মানুষের নাম যেমন একটা, মানুষের জন্ম মৃত্যু যেমন একবারই, তেমনি তার ভালোবাসার মানুষও একটাই হওয়া উচিত, এবং ঐ একজনের সাথেই তার বিয়ে হওয়া উচিৎ। তবে দুঃখজনকভাবে দার্শনিক লেভেলের এই ছেলেটি মেয়েঘটিত কাজে নিতান্তই ভয়াবহ রকমের কাঁচা, তাই আরিফের চৌদ্দের বিপরীতে রাব্বীর জীবনে প্রেমের সংখ্যা শুন্য!
আগেই বলে রেখেছি বাণিজ্য মেলায় সবাই বাণিজ্য করতে আসেনা। সাথে যখন আরিফের মত কিপটা আর ছ্যাস্রা কেউ থাকে তখন তো একেবারেই না। জটিল কিন্তু সরল একটা লক্ষ্যে আজ আমরা মেলায়, আরিফের জন্য একটা মেয়ে পটানো লাগবে। লাগবে বলতে লাগবেই। চৌদ্দ দিনের একাকীত্ব কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা আরিফ!
বাচ্চাকালে শেষ কবে বিছানায় হিসু করেছিলাম আমার পরিষ্কার মনে আছে, কিন্তু আরিফের কাছে শেষ কবে ট্রীট পেয়েছিলাম সেটা অনেক কষ্ট করেও মনে করা দায়। তো এবার বিশাল এক সুযোগ সামনে! আরিফ সগৌরবে ঘোষণা করল মেয়ে যদি পটিয়ে দিতে পারি তো সে আমাদের ট্রিট দিবে! আমরা যা খেতে চাই, যেখানে খেতে চাই খাওয়াবে!
মিশন শুরু হল আমাদের। পছন্দ অপছন্দের একটা ব্যাপার আছে। হুট করে কোন মেয়ে তো আর ধরে আনা যায়না! ঘণ্টাখানেক ঘুরে পা আর পেটের বারোটা বাজিয়ে একজনকে মনে ধরলো আরিফের অবশেষে। মেয়ে একা আসেনি, সাথে সফরসঙ্গী আরো চারজন। সর্বমোট পাঁচজন। বয়স্ক করে একজন মহিলা, সাথে মেয়েটি সহ তার বয়েসী আরো দুইজন মেয়ে, আর একটা বাচ্চা ছেলে! বছর তিনেক বয়স হবে বেশী হলে! বাচ্চাটি বয়স্ক মহিলাটির হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে, মেয়ে তিনজন তাদের ঠিক পেছনে!
মেয়ে রূপসী সন্দেহ নেই। আরিফের পছন্দ আছে বলতে হবে! মেয়েদের দলটা সামনে, আমরা তিন আদমী পেছনে। ওদের পিছু পিছু একটা ক্লথ স্টোরে ঢুকলাম আমরা। ওরা শাড়ী পছন্দ করছে। এই ফাকে রাব্বী আরিফকে জানিয়ে দিলো তারও ওদের সাথে মিল রেখে পাঞ্জাবি দেখা দরকার। মেয়েরা পাঞ্জাবী পডুয়া ছেলেদের প্রতি উইক, তাই এতে ভালো একটা ইমপ্রেসন তৈরি হবে। আর আমাদের তিনজনের বিলটা আরিফকে দিতে দেখলে নিশ্চয় মেয়ে পুরোপুরিভাবে ইমপ্রেসড হয়ে যাবে! মানিব্যাগের কথা ভেবে খানিকটা উসখুস করলেও পরে ঠিকই রাজী হলো বেচারা। মেয়ে পটাবে আর খরচ না করলে কি চলে! মোটামুটি সস্তায় তিন জনের জন্য তিনটা পাঞ্জাবি নিতেই আরিফের মানিব্যাগের হাজার চারেক টাকা হাওয়া!
মেয়েদের দল খাবে এবার। ঢুকলো এক খাবারের দোকানে। আরিফকেও ঠেলে ওই দোকানে ঢুকিয়ে পিছে ঢুকলাম আমরা। মেয়েরা কি যেনো খাচ্ছে, ফুচকা আর চটপটি হয়তো। আরিফকে ধরলাম। আমাদেরও খাওয়া উচিৎ। খাবার দোকানে তো আর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা যাবেনা। বিল দিতে গিয়ে দেখা গেল প্রতি প্লেট ফুচকার দাম খুঁজে দেড়শ করে। দাম শুনে আকাশ থেকে পড়া আরিফ রীতিমতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর উপক্রম করলেও রাব্বী সামলালো তাকে কোনমতে। বুঝালো যে,আর যাই হোক ক্রাশের সামনে টাকা নিয়ে কিপটামি চলেনা।
এভাবে আরো বেশ কয়েকভাবে কিপটা আরিফের মানিব্যাগ আরো কিছুটা হালকা করে দিলাম আমরা। এরমাঝে টার্গেটেড মেয়েটা বেশ কয়েকবার তাকিয়েছিল আমাদের দিকে। আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে বলে মনে হলো। মুচকি হাসলো। সেই হাসিতে আমাদের আরিফ ফিদা! আমরাও উৎসাহ পেয়ে গেলাম বহুগুণে।
রাত বাড়ছে। শুধু শুধু পিছে পিছে ঘুরে দেরী করার মানে হয়না কোনো, শুভ কাজ সেরে ফেলা উচিৎ শীঘ্রই। আরিফকে বললাম একটা কাগজে তোর কন্টাক্ট নাম্বার আর এফবি আইডি লিখে আমাকে দে, আমি ওটা তোর ক্রাশ বরাবর পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছি। সাথে কাগজ কলম ছিলনা অবশ্য! পাশে লটারির স্টল, ওখান থেকে কাগজ কলম চেয়ে নিয়ে কাগজে আরিফ তার কন্টাক্ট নাম্বার আর ফেসবুক আইডি লিখে আমার হাতে দিল! আরিফের জন্য আমরা এতকিছু করছি দেখে বেচারা আবেগে অলমোস্ট কেঁদেই দিল!
মেয়েদের গ্রুপটা সামনে, অলমোস্ট বেরিয়ে যাচ্ছে মেলা থেকে, পেছনে লাইন ধরে আমরা। আমি আগে, মাঝে আরিফ, শেষে রাব্বী। আমার হাতে আরিফের কন্টাক্ট নাম্বার আর এফবি আইডি লিখা কাগজ। কিভাবে এই কাগজ মেয়েটা বরাবর পৌঁছাব সে এক বিরাট চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল আমার। সাথে সাথে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল!
পেছন থেকে ইশারায় মেয়েদের গ্রুপের বাচ্চা ছেলেটাকে ডাকলাম। টার্গেটেড মেয়েটাকে দেখিয়ে দিয়ে হাতে কাগজটা গুঁজে দিয়ে বললাম ওই মেয়েটাকে দিয়ে আসতে। বাচ্চা ছেলে, কিছু বোঝার কথা না, নিল কাগজটা। কাগজটা মেয়েটাকে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে। পিছনে স্পষ্ট শুনতে পেলাম আরিফের মুখে মুসিবতের দোয়া উচ্চারিত হচ্ছে।
বাচ্চাটা হাতের কাগজ মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। বললো, ” মা, মা, এইটা তোমাকে দিতে বলসে ওই ভাইয়াটা!”
বাচ্চাটার হাত থেকে মেয়েটা কাগজটা নিয়েছিলো কিনা দেখার সুযোগ হয়নি আমাদের, ততক্ষণে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম মানিব্যাগে হাত দিয়ে মাথাঘুরে পডে যাওয়া আরিফকে সামলাতে!