কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে রাশেদ। চারপাশের নীরবতা এখন ও কাটেনি। কিন্তু রাশেদকে আর ঘুমিয়ে থাকলে হবে না। কত কাজ করতে হবে তাকে। বৃদ্ধ মাকে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়াতে হবে। মা ছাড়া যে তার কেউ নেই। বাবা মরে গেছে বেশ কয়েক বছর হল। এ বাড়ির সব কাজ করতে হয় রাশেদ কে।বাড়ির কাজ শেষ করে যেতে হবে চাকরি তে। চাকরি বলতে গাড়ি চালানো।এক মালিকের গাড়ি চালায় রাশেদ।
অসুস্থ মাকে খাওয়ানোর পর কাজে গেল রাশেদ। সময় মত না যেতে পারলে আবার বকা শুনতে হতে পারে। বড়লোকদের এই একটা সমস্যা। কোন কিছু হলে তার জন্য দোষ দেয় কর্মচারীদের।নিজের স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে রাগ ঝাড়বে কর্মচারীদের উপর।তবে সততা ও পরিশ্রমের জন্য রাশেদ এখন ও সে রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। তবে এ রকম ঘটনা যেন তার সাথে না ঘটে সেজন্য সাবধানতা অবলম্বন করে সবসময়।
ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে রাশেদ।গন্তব্য আশিক সাহেবের বাড়ি। হ্যাঁ,রাশেদ যার গাড়ি চালায় তার নাম আশিক রহমান।
মিনিট দশেক হাঁটার পর রাশেদের চোখ পড়লো আশিক সাহেবের প্রকান্ড বাড়িটির উপর। প্রতিদিন এই বাড়িটি দ্যাখে আর ভাবে রাশেদ। মানুষের জীবন কত বিচিত্র! কুঁড়েঘরে থেকে রাশেদের মত মানুষেরা দিব্যি ভালো আছে,সুখে আছে,ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো ও বেশ আনন্দে থাকে। কিন্তু প্রকান্ড প্রাসাদের মত বাড়িতে থেকে ও সুখ পায় না আশিক সাহেবের মত মানুষেরা।ঝগড়া লেগে থাকে এসব মানুষের সংসারে।যেমন থাকে আশিক সাহেবের সংসারে। এই ঝগড়ার কারণ অবশ্য জানে না রাশেদ। জিজ্ঞেস করতে চেয়ে ও পারে না সে। সাহসে কুলায় না তার। সামান্য একজন গাড়ির ড্রাইভার হয়ে মালিকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করতে ভয় হয় তার।
রাশেদ প্রকান্ড বাড়িটির ভেতর বসে আছে আশিক সাহেবের অপেক্ষায়।তিনি বের হলে তাকে নিয়ে যেখানে যাওয়ার হুকুম পাবে সেখানে যাবে। আশিক সাহেব বের হলেন বেশ কিছুক্ষন পরে। কিন্তু তাকে এত বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন? আজ ও তিনি স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করেছে নাকি? ভাবলো রাশেদ। আশিক সাহেব কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাশেদ। আজ রাশেদের খুব ইচ্ছা করছে আশিক সাহেবের কাছে শুনতে যে,স্যার আপনার কি হয়েছে? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আপনার কি মন খারাপ? অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে আশিক সাহেব কে জিজ্ঞেস করল রাশেদ -স্যার আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোন সমস্যা হয়নি তো স্যার?কথাটা বলেই নিজের কাজে মন দিল রাশেদ। আশিক সাহেব চুপ করে আছেন, কিছুই বলছেনা।
হঠাৎ করে আশিক সাহেব বলে উঠলো-বুঝলে রাশেদ, তোমার ম্যাডাম মানে আমার স্ত্রী আমার ‘ মা ‘ এর সাথে এক বাড়িতে থাকতে চাচ্ছে না।সে চায় আমার ‘মা ‘ কে বাইরে কোথাও রেখে আসি।এটা নিয়ে প্রায় ঝগড়া হয় আমাদের। অনেক ভেবে চিন্তে ‘ মা’ কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার চিন্তা করলাম। বুড়ো হয়ে গেছে, আধুনিক সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। তার থেকে বরং বৃদ্ধাশ্রমে থাক। ওখানে অন্য বৃদ্ধাদের সাথে ভালোই থাকবে। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসবো।
কথাগুলো শুনে রাশেদের খুব কষ্ট হচ্ছে, সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে স্যারের ‘ মা ‘ বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে। রাশেদের বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো স্যার আপনি অনেক বড় ভুল করছেন।’ মা ‘ একজনই হয়, পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বিনিময়ে যার ভালবাসা কেনা যায় না সে হচ্ছে ‘ মা ‘।কিন্তু কথাগুলো বলতে পারলো না রাশেদ। রাশেদের মত মানুষদের ভালবাসায় কোন জড়তা থাকে না।মন থেকে ভালবাসতে জানে এরা। পরের দিন আশিক সাহেবের ‘মা’ কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা হলো।এই জঘন্য কাজটি রাশেদকেই করতে হয়।খুব অপরাধবোধ হচ্ছিলো মনে মনে কিন্তু কিছুই করার ছিল না রাশেদের।
এই ঘটনার পরের দিন আশিক সাহেব কে বলে দু’দিনের ছুটি নিয়েছে রাশেদ।নিজের অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়েছে রাশেদ কিন্তু মূলত মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য ছুটি নিয়েছে। যে ব্যাক্তি নিজের ‘ মা ‘কে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে পারে সে অন্যের মায়ের কষ্ট হয়তো না বুঝতে পারে তাই মিথ্যা বলেই ছুটি নিয়েছে রাশেদ। পরেরদিন রাশেদ তার মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল।রাশেদ আর তার মাকে রাস্তায় দেখে ফেলে আশিক সাহেব।কিন্তু তিনি জানেন না যে ওই মহিলা টি রাশেদের মা। এটা দেখে তিনি রাগান্বিত হন। কিন্তু সেসময় রাশেদ কে কিছু বললেন না।
ছুটি শেষে রাশেদ যখন আশিক সাহেবের বাসায় গেল তখন তিনি কিছুটা ধমকের সুরে বললেন-তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলেছে। নিজের অসুস্ততার কথা বলে এক মহিলার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। এর শাস্তি হিসাবে তোমাকে আজ থেকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হলো।তুমি এখন যেতে পারো। এতক্ষন চুপ করে থাকা রাশেদ এবার বেশ জোর গলায় বলল- লাগবে না আপনার চাকরী। ‘ মা ‘ কি জিনিস আপনি সেটা বুঝবেন না,আপনার ‘মা ‘ তো বৃদ্ধাশ্রমে।আপনার কাছে স্ত্রী সব। স্ত্রীর জন্য গর্ভধারিণী মা কে ত্যাগ করতে পারেন, আপনি কি বুঝবেন ‘ মা ‘ কি জিনিস।
আমার ‘ মা ‘ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। আপনার এখানে কাজ করি আর বাকি সময় টা মায়ের সেবা যত্ন করে কাটাই। আমার স্ত্রী বলছিল আমার অসুস্থ মায়ের সাথে সে থাকতে পারবে না। আমি স্ত্রী কে ত্যাগ করেছিলাম ‘ মা ‘কে ত্যাগ করবো এই ধারণা কখন ও মনে ও করিনি । এতদিন ধরে মায়ের সেবা যত্ন করে আসছি কখন ও বোঝা মনে হয়নি ‘ মা ‘ কে। যে মা আমার জন্য এত কিছু করেছেন তার জন্য আমি এতটুকুন করতে পারবো না?আপনি কি বুঝবেন ‘ মা ‘ কি জিনিস। গত কয়েকদিন ধরে মায়ের অসুখ টা বেড়েছে তাই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।আপনি তো বুঝবেন না ‘ মা ‘ কি জিনিস তাই আপনাকে মিথ্যা বলছিলাম।মিথ্যা বলে বেশ করেছিলাম।আমার কাছে ‘মা’ আমার পৃথিবী। লাগবে না আপনার মত মানুষের চাকরি। এই নেন আপনার গাড়ির চাবি।
আশিক সাহেবের হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে বেরিয়ে গেল রাশেদ। চাকরি টা হারিয়ে নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে না রাশেদের, মায়ের জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। আয়ের একমাত্র উৎস টা হারিয়ে মায়ের চিকিৎসার টাকা কিভাবে পাবে এই ভেবে কষ্ট পেল রাশেদ। কিন্তু বুকভরা আশা নিয়ে রাশেদ ভাবল- চাকরি একটা গেছে অন্য একটা ঠিক জোগাড় করে নিব।বিষন্ন মনে বাসার দিকে যাচ্ছে রাশেদ।
রাশেদের কথাগুলো শুনে নিথর হয়ে দাড়িয়ে আছে আশিক সাহেব।তার সমস্ত শরীরে এক অদৃশ্য ভাবনা কাজ করছে।তার হৃদয়ের গভীরে সীমাহীন ভালবাসা ভর করলো মায়ের জন্য। তার ভুলে ধরা মন টা আজ যেন মুক্ত হয়ে গেছে। ‘ মা ‘ কি জিনিস তিনি এখন বুঝতে পেরেছেন। কত বড় ভুল তিনি করেছে তা বুঝতে পেরেছেন। সে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। তার ‘ মা ‘ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘ মা ‘। তার মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পারে না,কখন ও না।
পরদিন ভোরে আশিক সাহেব রওনা দিল রাশেদের খোঁজে। রাশেদ কে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে যাবে, তার মা কে ফিরিয়ে আনবে। মা কে সে অনেক ভালবাসে সেটা বলবে।অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে সেটা বলবে। সে জানে তার মা তার উপর রাগ করে থাকতে পারবে না।সন্তানের সকল অপরাধ মেনে নিয়ে ও যে মানুষ টা ভালবাসে সে হচ্ছে ‘মা ‘। অনেকক্ষণ খুজে তারপর রাশেদের দেখা মিলল। তাকে দেখেই আশিক সাহেব বলল-এই নাও গাড়ির চাবি, আমার মা কে আনতে যাবা না বৃদ্ধাশ্রম থেকে?মুচকি একটা হাসি দিয়ে গাড়ির চাবি নিল রাশেদ। আশিক সাহেব আর রাশেদ রওনা হয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রমের পথে। পূব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে।প্রকৃতি যেন আজ অবিশ্বাস্য সুন্দর লাগছে কারণ আজ যে একজন গর্ভধারিণী ‘ মা ‘ বৃদ্ধাশ্রমের বন্দীশালা থেকে মুক্ত হবে।