বাবা দশম শ্রেণীর উত্তরপত্র দেখছিলেন।আমি পাশে গিয়ে বসলাম।বাবা যে খাতাটা দেখছিলেন সেটার হাতের লেখা আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো।ভেবেই পাচ্ছিলামনা খাতাটা কার হতে পারে? আমিও বাবার স্কুলে পড়েছি।আমরা যখন ক্লাস টেনে তখন ওরা সবে সিক্সে ছিলো।ক্লাসের এত গ্যাপের ভিতর ওদের হাতের লেখাটা পর্যন্ত চেনার কথা না।মনের দ্বিধাদন্দ্ব অগ্রাহ্য করে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,,
-বাবা খাতাটা কার?
বাবা বললেন হিরামনের। আমার মনের ভিতর যে প্রশ্নগুলো উঁকি দিচ্ছিলো তার উত্তর পেয়ে গেলাম। হিরামন, আমার স্কুললাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড আদুরিনীর ছোট ভাই। ভাইবোনের হাতের লেখা অনেকটা একরকম তাই হিরামনের হাতের লেখাটা আমার খুব পরিচিত মনে হয়েছে।
আদুরিনী আর আমি একই মাধ্যমিক স্কুলে পড়েছি।তখন ক্লাসে ফাস্ট হওয়া নিয়া দুজনাতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতো।এক পরীক্ষায় ও ফাস্ট হতো তো পরের পরীক্ষায় আমি।পড়াশুনোয় প্রতিযোগিতা ছিলো কিন্তু হিংসা নয়।দুজনে দুজনার কাছে পড়াশুনো শেয়ার করতাম। একজন না বুঝলে অন্যজন বুঝিয়ে দিতাম। সব ঠিকঠাক চলছিলো। জে এস সি তে দুজনেই এ প্লাস পেলাম আর বৃত্তিও কিন্তু নবম শ্রেণীতে ঘটলো বিপত্তি। ও মুখ কালো করে বসে থাকতো।এত জিজ্ঞেস করতাম কিচ্ছু বলতো না।উল্লেখ্য ওর পরিবারেরর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিলো।দিন আনে দিন খায় এমন আরকি।কিন্তু আদুরিনীর আম্মু খুব ভালো ছিলেন।তিনি নিজে শিক্ষিত না হলেও ছেলে মেয়েদের পড়াশুনোর ব্যপারে ছিলেন সচেতন । যাই হোক আদুরিনীকে জিজ্ঞেস করতে করতে একদিন জানলাম ওর ব্রেস্ট টিউমার হয়েছে।মুহুর্তেই সবকিছু আবছা দেখছিলাম।আমার খুব ভয় লাগছিলো ওকে হারিয়ে ফেলবো না তো!!!
আমি বাড়িতে এসে ওর অসুস্থতার কথা বলেছিলাম।বাবা ওকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।সাথে আমিও ছিলাম।পরে ওর অপারেশন হয়।মানুষের কিছু সহযোগীতা থাকলেও অপারেশনের টাকাটা মূলত ওর আম্মুর রাস্তার কাজ করার টাকা। অসুস্থতার দরুন ও পড়াশুনোয় অনিয়মিত হয়ে গেছিলো।তারউপর স্কুল থেকে ওর বাড়ি অনেক দূর । এস এস সি তে ওর রেজাল্ট আশানুরূপ হলোনা।কলেজে এসে ও বিজ্ঞান থেকে মানবিক বিভাগে চলে গিয়েছিলো।
আমরা আলাদা আলাদা রুমে ক্লাস করতাম।দেখা হওয়া অনেকটা কমে গেলো। তবুও অনেক ভালো বান্ধু ছিলাম আমরা। কয়েকমাস পর হঠাৎ আদুরিনী গায়েব।ওকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। ফ্রেন্ড, আত্মীয় স্বজন কারো বাসায় নেই।। তানিয়া (আমার আরেকটা বেস্ট ফ্রেন্ড)আর আমি ওর নম্বরে ফোন দিয়ে চলেছি কিন্তু ফোন বন্ধ।আবার কখনো কল পড়লে ধরছেনা।একদিন পর তানিয়াকে মেসেজ দিয়ে জানালো ও ওর পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছে। আমরা সবাই আজিব হয়ে গেলাম।কলেজে যদি একটা ভদ্র মেয়ে হিসেব করা হতো তাহলে সেটা আদুরিনী কিন্তু সেই কি না! স্যারেরা পর্যন্ত বলেছিলেন,,,আদুরিনীর মত মেয়ের নামে এমন একটা কথা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে!!
আন্টি ফোন করে বাবার সাথে কান্না করেছে। আমি ভাবতেই পারছিলাম না, কি করে পারলো ও আন্টিকে কষ্ট দিতে!
যে মহিলা ওর জন্য রাস্তা তৈরীর কাজ করেছে সেই মহিলার মান সম্মান এভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দিলো!
ও কি ভাবে ওর বাবা মাকে দেখলে মানুষ ব্যাঙ্গ করে হাসে,ভাইবোনদেরকে টিটকিরি মারে!তাদের তখন কতটুকু ব্যথা লাগে তা ও ভেবেছে! আমি রাগে অভিমানে কখনো ওর সাথে কথা বলিনি। তারপর আড়াই বছর কেটে গেছে। আজকে হিরামনের খাতাটা দেখার পর ওর কথা খুব মনে পড়ছে। সব অভিমান ঝেড়ে ফেলে ওকে কল করলাম।
-কেমন আছিস?
-ভালো,,,, তুই?
-এইতো ভালো।দুলাভাই, বাবু কেমন আছে?
-ভালো,,, তুই কই? ঢাকা গেছো?
-আমি ঢাকা যামু ক্যা? আমি তো বরিশাল পড়ি।
-ওহহহহহহহ ফারজু!!!!(ওর কণ্ঠে সে কি আনন্দ!) আমি ভাবছি নন্দিতা,,,, কেমন আছিস তুই?
-একদম কণ্ঠটাও ভুলে গেলি? অবশ্য ভোলারই কথা আর এত দিন!
মান অভিমানের পালা শেষ করে দুজনে মনখুলে কথা বললাম। কিন্তু বুকটা ভারই থেকে গেলো। আদুরিনীর মতো মেধাবী স্টুডেন্ট আর পড়াশুনো করেনি।এইচ এস সিও ওর দেয়া হয়নি।ওর হাসবেন্ড আর পড়াবেনা।বই দেখলে নাকি ওর কান্না পায় তাই ফেরীওয়ালার কাছে বইগুলো বিক্রি করে দিয়েছে।। আগে যা করেছে,,, তা বাদ,,,,, কিন্তু এখন যদি ও শান্তিতে থাকতো তবুও আফসোস ছিলোনা। হায়রে জীবন!!!