বোনদের মধ্যে যদি কেউ প্রশ্ন করে ফাঁকিবাজি বেশি করে কে সবাই এক নামে বলবে ” মিলি – জিমি”। তারপর হলাম আমি এর পরে বড়আপু আর মানহা আপু। এটা হল ফ্যামিলির লিষ্ট করা। আর ভাই যেহেতু চারজন তাও আবার বড় বড় তারাও খুব ভাল করেই জানে কে কেমন। একদিন বাসায় কেউ নেই আমি মিলি আর বড় আপু তিনজনে ছিলাম। আর খালাও ততটা রান্না করে রেখে যায় নি। পরে বোনেরা মিলে প্লান করলাম যে রান্না করবো তাও আবার স্পেশাল। রান্নার যখনই কোন প্রোগ্রাম হয় না কেন বোনেরা কেন জানি না ঘাড় ধরে আমাকেই ঠেলে দেয়। অনেকটা ” ধামাল ” মুভির ” মানবের ” মত। ক্রিটিকাল সিচুয়েশনে কেমন করে যে আমি আগে চলে যাই নিজেও জানি না।সে যাই হোক প্লান হল গরুর মাংস আর ডাল ভুনা করা হবে। ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভিজালাম আমি। বড় আপু ডাল ভিজালো। আর মিলি যেহেতু রান্না করবে না তাই ওকে দেওয়া হয় কাটাকুটির দ্বায়িত্বে।
বাজে ১১টা মোটামুটি মাংস কাটাকাটি বড় আপুর শেষ। আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রান্না ঘরে ঢুকে দেখি জনাবা তখনও মনোযোগ দিয়ে একটা পেয়াঁজ ছিলতেছে তাও পুরো ১০ মিনিট লাগিয়ে। বড় আপুরে ইশারা দিলাম সেও মিলির কাহিনী দেখে অবাক। বড় আপু ধুম করে এসেই পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল মিলির। ব্যাঁকাতে ব্যাঁকাতে প্রশ্ন করল
___” আমি কি করছি মারতেছ কেন ”
___ ” তুই কি পেঁয়াজ ছিলতেছিস নাকি পেঁয়াজরে ড্রেস আপ করাচ্ছিস”। বড় আপু রেগে বলল।
___ ” বড় আপু প্রতিটি কাজ শৈল্পিক কায়দায় করা উচিত”। মিলি খুব গম্ভীরভাবে উওর দিল।ও উওর শুনে এত মেজাজ খারাপ হল যে বলার মত না। জিদ করে উওরই দিলাম
___ ” মিলি এক্ষুনি ওঠ না হলে বড় আপু দিছে নরমাল কিল কিন্তু আমি যদি দেই তাইলে কিন্তু শৈল্পিক কায়দায়
কিলামু “।
মিলি তাড়াতাড়ি পেঁয়াজ রেখে উঠে গেল বড় আপু পেঁয়াজ কেটে দিল আমি তাড়াতাড়ি করে মাংসটা বসিয়ে মিলিকে আবার ডাক দিলাম। সে ততক্ষনে ফোন হাতে নিয়ে টিভির সামনে। মিলির টিভি দেখাটা ওয়ান অফ দ্যা মোষ্ট ফেভারিট থিংন।যদি কিছু নাও চলে ও বসে বসে টক শো দেখে যা কোন মরা মানুষের সামনে ছেড়ে দিলে সে বাপ বাপ বলে দৌড় মারবে। খালা তো মাঝে মাঝেই বলে ” মিলিরে তোর গলায় টিভি বাইন্ধা দেই তোর কষ্ট কম হবে”। তখন মিলি উওর দেয় ” আম্মা পাগলের মত কথা বলবা না তো আমার গলায় টিভি বান্ধলে আমি নিজে টিভি দেখমু কেমনে? এতো আয়নার সামনে যাইয়া টিভি দেখা লাগবে। আর কারেন্টের লাইনই বা লগে লগে নিয়া ঘুরবো কি করে “। মিলির অভূতপূর্ব উওর শুনে খালা হার্ট অ্যাটাক করতে করতে বাঁচে মাঝে মাঝে। মিলিকে ধরে বেঁধে টিভির সামনে থেকে সরিয়ে এনে হাতে চালের পাতিল দিয়ে বললাম,
_ ” মিলি তুই চাল ধুয়ে চড়ায়ে দে। ডাল নামিয়ে রেখেছি। অন্যচুলা খালি”।
_ ” এই সামান্য একটা কাজ তুমি আমারে দিয়ে করাবা বাবু আপু “। মুখটাকে মাসুম বাচ্চাদের মত করে বলল মিলি।মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললাম
_” আপাতত এইটুকু কর আমি গোসল করে আসি”।
এই বলেই সোজা রুমে চলে গেলাম। দেখি বড় আপু ঢুকেছে গোসল করতে। তাই দেরি না করে কাপড় নিয়ে সোজা খালার ওয়াশরুমে ঢুকলাম। গোসল সেরে কাপড় ধুয়ে যখন বের হলাম তখন ঘড়ির কাঁটা ১ টা ছুঁইছুঁই। বারান্দায় কাপড় মেলে দিয়ে যখন রুম থেকে বের হলাম আমার তো আক্কেলগুড়ুম। মিলি ফোনে ইউটিউব দেখছে আর চাল ধুইতেছে। সে বিগত ২০ মিনিট যাবত চালই ধুয়ে যাচ্ছে। এই হচ্ছে তার ফাঁকিবাজির নমুনা।
পটুয়াখালী যখনই যাই দেখা যায় নিঃশ্বাস ফেলার উপায় থাকে না ঘরের মেয়েদের। বছরে একবার যাওয়া হয় দেখা গেছে অনেক অনেক আত্মীয়রা আসে দেখা করতে। ঠিক তেমনই একদিন অনেক অনেক মেহমানের আগমন। খালা আর খালামনি সবার কাজ ভাগ করে দিয়েছে। আমাকে প্রায় ৪০ টার মত সিদ্ধ ডিম ছিলতে দিয়ে গেছে। বড় আপুরে দিছে পিঁয়াজ ছিলতে। মিলি জিমিরে দুইটারে একত্রে দিছে আদা আর রসুন ছিলে ব্লেন্ড করতে।আর মানহা আপু চুলার কাছে। বাকি অন্যান্যরাও খুবই বিজি। ডিম ছিলি আর ভাবি জীবনটা ডিমের মত হয়ে গেছে খালি ঘুরে ঘুরে প্যারাই আসে। বড় আপুও মোটামুটি চোখ আর নাকের পানি এক করতেছে পিঁয়াজ ছিলতে ছিলতে। হঠাৎ মিলি জিমি দুইটা এসে হাজির।
___ ” বাবু আপু তাড়াতাড়ি ওঠো তুমি যেয়ে আদা রসুন ব্লেন্ড করে ফেলো। আমি আর মিলি ডিম ছিলে দিচ্ছি “।
জিমি খুব আগ্রহ নিয়ে বলল। ওদিকে তাকিয়ে দেখি আদা রসুন সব ছিলে পরিষ্কার করে ফেলেছে ওরা।আমিও মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম।ভালই হইছে এত গুলো ডিম তো ছিলা লাগবে না ব্লেন্ডারে ওগুলো ব্লেন্ড করতে ৫ মিনিটের ব্যাপার। তাই তাড়াতাড়ি উঠে সোজা গেলাম খালার কাছে ব্লেন্ডার চাইতে। খালা আমার কথা শুনে ঝাড়ি দিয়ে বলল ” কত বার এক কথা বলব যে ব্লেন্ডার নষ্ট হয়ে গেছে শিলপাটায় বাটতে হবে মসলা”। খালার কথা শুনে মনে চাচ্ছিল চিক্কুর দিয়া কান্দি আর গান গাই ” আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায় “। আমি ঘন্টা ধরে মসলা বেঁটে হাতের চামড়া উঠাইছি আর দুইটা মিলে ডিম ১৫ মিনিটে ছিলে পগার পার।
প্রচন্ড শীতে একবার পাঁচ বোন এক খাটে গাদাগাদি করে ঘুমিয়েছি যেটা কি না খুব ফেভারিট আমাদের। দুইটা কম্বল আছে আমাদের একটা একটু বেশি বড়ো অন্য একটা ছোট। বড় দুই জন তাদের বড় হওয়ার পাওয়ার ইউজ করে কম্বল বড়টা নিয়ে নিছে। আর আমরা ছোট তিনজন ছোটটায় ঘুমিয়েছি। শোয়ার একটু পরেই যথারীতি জিমি মিলির মারামারি শুরু। বড় আপু বলল আমি যেন ওদের দুইটার মাঝে যেয়ে ঘুমাই। কি আর করার মাঝে যেই শুয়েছি একটু পরেই কম্বল টানাটানি শুরু দুইটার। মিলি বলে ওর ওদিকে কম্বল কম আর জিমি বলে ওর ওদিকে কম্বল কম। দুইটার টানাটানিতে আমার কোন সমস্যাই নাই। কারণ আমি ছিলাম মাঝে কম্বল যাচ্ছিল না আমার শরীর থেকে। কিন্তু সমস্যা হল এক জায়গায় যেয়ে যখন দুইটা কিলাকিলি শুরু করল।
হায়রে কিন্তু কষ্টের ব্যাপার হল দুইটা দুইটারে কিলাচ্ছে আর কিল গুলো আমি মাঝে থাকার দরুন সব আমার গায়ে পড়ছে। কিছু বলার জন্য মুখ বের করার সুযোগই পাচ্ছিলাম না মাথা বের করলেই কিল যে কোথা থেকে আসছিল আল্লাহ মালুম। পরে বড় আপু আর মানহা আপু অনেক কষ্টে ওদের শান্ত করে আমাকে বাঁচায়। দুইটারে খাটের দুই কোনায় দেওয়ার পরে শান্ত হয় সব।
একদিন আম্মুর এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছি গ্রামে। আম্মুর স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড ছিল। আম্মুর মারা যাওয়ার পরেও আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন উনি। বিকালের দিকে আমি মিলি আর জিমি গিয়েছিলাম উনাদের বাসায়। বড় আপুরা যেতে পারি কোন কারন বশত। যেয়ে বসার পরে অনেক কথা হল এর পরে ভদ্র মহিলা এক প্লেট মুড়ি আর পানি এনে সামনে দিলেন খাওয়ার জন্য নাস্তা হিসাবে। মুড়িতে আমাদের বোনদের ভীষন অরুচি। দরকার হলে না খেয়ে থাকব তাও মুড়ি খাওয়া যাবে না। ওদিকে আম্মুর বান্ধবী বার বার এক কথা বলতেছে ঘরে কিছুই নেই ঘরে কিছুই নেই কি দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করবে।
মিলি জিমির দিকে তাকিয়ে দেখি ঠোঁট চেপে শক্ত করে রেখেছে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কঠিন কোন প্লান চলতেছে ওদের মাথা যা কিনা মোটেও ভাল কিছু না৷ মহিলা কোন কারণে বাইরে যেতেই দুই শয়তান খাটের নিচে থেকে একটা টুকরি টেনে বের করল। ওর মধ্যে অনেকগুলো ডিম।টপাটপ সবগুলো ডিম ব্যাগে রেখে আবার চুপ করে বসল। আমি কিছু বলার আগেই আন্টি এসে হাজির। না পারছি কিছু বলতে না পারছি কিছু সইতে৷ চোখ দিয়ে এত বার ইশারা করছি তারপর দুইটাই দেখেও না দেখার ভান করেই যাচ্ছে। শেষমেষ যখন বের হলাম ওই বাসা থেকে দুইটারেই বললাম, ” সমস্যা কি তোদের ডিম আনলি কেন না বলে “। ” আরে ওই মহিলা খালি এক প্যানা পাড়তেছে ঘরে কিছু নাই ঘরে কিছু নাই। তিনজনরে তিনটা ডিম পোচ তো করে দিতে পারত ” মিলি ঝাড়ি দিয়ে বলল। জিমিও সাথে তাল মিলালো ” এখন একদম ভাল হইছে ঘরে সত্যিই কিছুই নাই”। আমি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দুইজনের থিউরি শুনতেছিলাম আর ভাবতেছিলাম এরা নাকি আমার বোন।
এখন আর আগের মত কাজ নিয়ে মারামারি হয় না। রান্নার কাজ একাই সামলাতে পারি একটুও কষ্ট হয় না। বিশাল এক খাটের কোনায় পড়ে থাকি তাও ইচ্ছা হয় না হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাই। আলমারি আর ওয়্যারড্রয়ার এখন শুধুই আমার। কোথাও গেলে একাই যাই কোন ঝামেলা হয় না। কিন্তু কি জানেন আমি আবারও চাই রান্নাঘরে মারামারি হোক। কথা কাটাকাটি হোক। খাটে পাঁচ বোন একসাথে ঠেলাঠেলি করে ঘুমাই কারন তখন যে এক ঘুমে রাত পার হয়ে যেত। এত বড় খাট তাও ঘুম আসে না সারারাতে একফোঁটাও। কাপড় চোপড় রাখা নিয়ে আবার ঝগড়া হোক এসব আবার জাষ্ট ফিরে পেতে চাই। বোনগুলো এখন এত এত দূরে যে চাইলেও ব্যস্ততার কারণে যোগাযোগ হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো যে আমাদের খুব প্রিয় যা এই মনের খাতায় অমলিন রয়ে যাবে সারাজীবন।