আর্থিক সচ্ছলতার দিক থেকে আমি মধ্যবিত্তের থেকে একটু নিচে। পরিবারের সাপোর্ট বলতে কিছুই ছিল না। ছোট একটা বোন আছে বাড়িতে। বাবাকে অনেক আগেই হারিয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পরে সিদ্ধান্ত নেই যে ঢাকায় এসে পড়ালেখা করব। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই আমার ঢাকায় আসা। ঢাকায় এসে একটা মেসে উঠি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রথম বছর পার করার পরে আমি স্টুডেন্ট পড়ানো শুরু করি। খুব সকালে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বা সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে ওইখান থেকেই সরাসরি স্টুডেন্টএর বাসায় যেতাম। এতো কষ্টের মাঝেও আমার মনে ভালোবাসা ছিল। মেয়েটার নাম ছিল বেলা। বেলা আমার গ্রামেই থাকতো। হঠাত্ করে একদিন জানতে পারি যে বেলার মা মারা গিয়েছে। কিছুদিন পরে বেলার বাবা আরেকটা বিয়ে করে।
সৎমায়ের ঘরেই থাকতে হয় বেলাকে। কিছুদিন পরে সেই সৎমা বেলার কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ বেশি কিছু না, মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করার দরকার নেই। আর সংসার তো ঠিক মতো চলছে না, টাকা পয়সার অভাব। যখন টাকা পয়সার অভাব থাকবে না, তখন তুমি আবার স্কুলে যাবা। এমন একটা বাণী বেলাকে শুনিয়ে দেয় বেলার সৎমা। সারাদিন বেলা ঘরের মধ্যে থাকতো,কান্নাকাটি করতো। আমি যখন জানতে পারি, আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারিনি। আমি ফোন করে বার বার বলতে থাকি যে, “তোমার মাকে বোঝাও ব্যাপারটা। কিন্তু বেলা সাহস পায়নি। একটা পর্যায় গিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আরো কিছু বাড়তি স্টুডেন্ট পড়াবো। নিজের টাকায় বেলাকে পড়াশোনা করাব। কারণ ও তো আমারি বউ হবে। ও পড়ালেখা করে তো আমার সন্তানদেরই মানুষ করবে।
এরকম একটা মোটিভেশন নিয়ে আমি আরো কিছু স্টুডেন্ট পড়ানো শুরু করলাম। প্রতি মাসে ওই টিউশনের একটা এমাউন্ট থেকে বেলার কলেজের জন্য পাঠাতাম। বেলার লেখাপড়া আবার শুরু হয়ে গেল। আমি কষ্টের পর কষ্ট করা শুরু করলাম। খুব সকালে ইউনিভার্সিটি, দুপুর অথবা বিকেলে ব্যাক করে সেখান থেকে স্টুডেন্ট পড়াতে যেতে হত। রাত দশটা পর্যন্ত টিউশন করিয়ে মাঝে মাঝে এমন হতো আমি নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে খেয়ে বের হতাম, আবার রাতে এসে খেতাম। মাঝে মাঝে হেঁটে হেঁটেই স্টুডেন্ট পড়তে চলে যেতাম। এভাবেই কাটাতে থাকে আমার দিনগুলি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাজারো স্বপ্ন আমার মাঝে। প্রতিটা মূহুর্ত স্বপ্ন দেখছি মাকে নিয়ে, ছোট বোনকে নিয়ে আর সেই ভালোবাসার মানুষ বেলাকে নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে যখন আমার মনে হল যে। আমার এই স্বপ্নগুলো পূরণ করার করার জন্য একটা ভালো চাকরির দরকার। বিভিন্ন জায়গায় আমি সিভি দেওয়া শুরু করলাম। একটা পর্যায়ে গিয়ে একটা প্রাইভেট কম্পানিতে আমার চাকরি হয়। খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ি। সাথে সাথেই মাকে ফোন করি। “মা তোমার ছেলে চাকরি পেয়েছে, আর কষ্ট করতে হবে না মা। ছোট বোনটা কোই ওর কাছে একটু ফোনটা দাও। ” কিরে , তোর ভাইতো চাকরি পাইল। আর কষ্ট নাই, আর কষ্ট করতে হবে না। তোর বিয়ে দিব এবার ধুমধাম করে। মা আর বোনের সাথে কথা বলা শেষ করে বেলাকে ফোন দিলাম। চোখে পানি টলমল করছিল আমার। বেলা ফোনটা রিসিভ করতেই আমি বললাম; ” হ্যালো বেলা, চাকরিটা আমার হয়ে গেছে বেলা তুমি শুনছো। এবার আমাদের স্বপ্নগুলো আমি সত্যি সত্যি বাস্তব করব। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।
আই প্রমিস তোমার সব স্বপ্নগুলো পূরণ করব আমি। শত আশা, শত স্বপ্ন নিয়ে অগ্রগামী হলাম। নতুন চাকরি অনেক চাপ। খুব সকালে বাসা থেকে বের হওয়ে, বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা এগারোটা বেজে যায়। বাসায় ফিরে কেন জানি কিছু ভালো লাগতো না। না চাইতেই বালিশের উপর মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে যেতাম। কোন কিছুই ভালো লাগতো না আমার। কি করব, নতুন চাকরি কিন্তু স্বপ্ন অনেকগুলো। কিছুদিনই না হয় আর কষ্ট করতে হবে তার পর তো আর কোন কষ্ট নেই।দিন যত যাচ্ছিল, আমার উপর চাপের পরিমাণটা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। বাবা যখন ছোট বেলায় কষ্ট করত, তখন বাবার কষ্টটা বুঝতে পারতাম না। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে। বালিশের উপর মাথা রেখে চিন্তা করতাম, কিভাবে বাবা সংসারটাকে টিকিয়ে রেখেছিল। হুম আমাকেও যে পারতে হবে। কাজের চাপে মা, ছোট বোন, বেলা ওদের সাথে ঠিকমতো কথা বলতে পারতাম না।
এমন করে প্রায় দের মাসের মত কেটে যায়। একদিন রাতে তখন রাত তিনটা, হঠাত্ করে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। কোনোভাবেই ঘুম আসছিল না আমার। হঠাত্ করেই মাথায় আসে যে, ” আচ্ছা আমি বেলাকে একটা কল দিব। উম নাহ ওর তো পরীক্ষা ওকে কল দেওয়াটা ঠিক হবে না। আচ্ছা ঘুমিয়ে যাই। পনেরো মিনিট পরেও ঘুম আসছে না। আবার চিন্তা করলাম ফোনটা দিয়েই দেই। তিনটার সময় যখন বেলার নাম্বারে কল দিলাম। হঠাত্ করে দেখি ওর নাম্বারটা ব্যস্ত দেখাচ্ছে।
“আমি মনে হয় ভুল নাম্বারে কল করেছি, আবার কল করলাম তখন দেখলাম বেলার নাম্বারটা আসলেই বিজি। হয়তো ওর পরিচিত কারো সাথে কথা বলছে। একটু পর আবার ট্রাই করি, তখনো নাম্বারটা বিজি। যখন দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, এবং ত্রিশ মিনিট পরেও দেখলাম যথারীতি বেলার নাম্বারটা বিজি। আমার হাত পা কপা শুরু করে দেয়। আমি তো ক্লান্ত থাকতাম, ঘুমিয়ে যেতাম, না না কোন ফ্রেন্ড হতে পারে। না ও আমাকে বলবে, আমি ওকে চিনি ও আমার থেকে কিছু লুকাবে না। এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, তিন ঘন্টা, হয়ে গেল। ভোর তখন সারে ছয়টা। হঠাত্ করে দেখলাম বেলার নাম্বারটায় কল ঢুকেছে। বেলা আদও সত্যি বলে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য, বেলা যখন ফোনটা রিসিভ করল।
ও তখন অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল; “‘তুমি এতো সকালে। আমি ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বললাম; “না মানে মাত্র ঘুমটা ভাঙল তাই চিন্তা করলাম, তোমাকে একটা ফোন করি। বেলা তখন বলল; “‘ মাত্র ঘুম ভেঙেছে। ” “হ্যাঁ মাত্রই, তাই তো তোমাকে ফোন দিলাম। ঠিক ওই মূহুর্তে বেলা বলল; “‘ও আমারও তো মাত্র ঘুম ভেঙেছে। আমি তো তোমার ফোন পেয়ে চিন্তা করলাম কি হলো। আমি তখন প্রশ্ন করলাম; “তুমি কি সত্যি ঘুমিয়েছিলে। ও তখন বলল;”‘হ্যাঁ আমি তো ঘুমিয়েছিলাম, তুমিই তো ফোন দিয়ে উঠালে। আমি বুঝতে পারলাম যে, রাজ্যটা ঠিকই আছে শুধু বেলার রাজ্যের রাজা আজ অন্য কেউ।
আমি আর ফোনে কথা না বলে সকালেই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। চার ঘন্টা পরে যখন গ্রামে এসে পৌছাই, বেলাকে ফোন করে বললাম যে; “আমি এসেছি তুমি দেখা করো। বেলা দেখা করতে আসল, আমি বসলাম ওর সামনে তার পর বললাম; “আমি সারারাত ঘুমাইনি। তুমি সারারাত কথা বলেছ, অন্য কারো সাথে আর বসে বসে আমি পাহারা দিয়েছি। কেন মিথ্যা বললে। নিজের চাওয়া পাওয়া সবকিছু বাদ দিয়ে তোমার জন্য ছুটেছিলাম। কোন চাওয়া পাওয়া নেই এখন তোমার কাছে। যদি আজ আমাকে মানুষ মনে কর, একটা সত্যি কথা বলবে। আমি আসলে সত্যিটা জানতে চাই কি হচ্ছে। বেলা তখন ওর মাথাটা নিচু করে রাখে। একটু চুপ থেকে মাথাটা উঠিয়ে বলে; “‘তুমি আমাকে অনেক দিন ধরে সময় দিচ্ছিলে না।
আকাশ নামে ভালো ফ্রেন্ড ছিল আমার। তুমি সময় দিচ্ছিলে না বলে, ওর সাথে কথা বলতে বলতে আমার রিলেশন হয়ে যায়। আমি চুপ করে শুনছিলাম, বেলা যখন সবকিছু শেয়ার করল। আমি তখন মাথা উঠিয়ে বেলার দিকে তাকিয়ে বললাম; “আরে পাগলী একটা মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে নিজেকে। সেই নিজেকে তোর জন্য কোরবানি করলাম, তোর সুখের জন্য। আর নিজের ভালোবাসাটুকু কোরবানি করতে পারব না। ছেড়ে দিলাম, কোরবানি করে দিলাম নিজের ভালোবাসাকে। সুখে থাক, ভালো থাক। তবে কিছু কথা তোর জানা উচিত। হাজার বার জানতে চেয়েছিলি না যে কিভাবে আমি তোর জন্য টাকাগুলো পাঠাই। কখনো বলিনি কেন জানিস, যাতে তোর কষ্ট না হয় এটা শুনে যে আমি তোকে আমার কষ্টের টাকা পাঠাচ্ছি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
এই দুই পা দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে ছাত্র পড়িয়ে এক হাজার, দুই হাজার টাকা নিয়েছি মাসে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোর জন্য খেটেছি। আরে আমি অন্য মেয়ের সাথে ব্যস্ত হয়ে যাই নাই। যাতে করে তুই, আমার মা, বোন এই মানুষ গুলো কষ্ট না করে। এর জন্য নিজের সুখকে ত্যাগ করে। সুখের চোখে কাপড় বেঁধে দুঃখটাকে হাতে নিয়েছিলাম। আরে আমি তো সারাজীবনের জন্য চলে যাইনি। স্বপ্নগুলো তো তোদেরই ছিল, বাস্তবটা শুধু আমি করতে চেয়েছিলাম। ধৈর্য ধরতে পারলি না। আফসোস নেই আমার, যাস্ট এটুকুই মনে রাখবি, ভালোবেসেছিলাম , ভালোবাসবো। কিন্তু এই মানুষটাকে আজকের পর থেকে আর কোনদিন ফিরে পাবিনা। কোন দিন আমার ছায়াটাও দেখতে পাবি না । আজ এই দেখাটাই তোর সাথে আমার শেষ দেখা। ভালো থাকিস তুই।
এর পর অনেক কষ্ট মনে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসলাম। খুব কষ্ট হতো ঠিক মতো কাজে মন বাসাতে পারতাম না। বার বার বেলার কথা মনে পড়ত। একটা সময় নিজেকে বোঝাতে শুরু করলাম। যে না আমি আর কষ্ট পাবো না। ভেঙে পড়লে তো হবে না। আমার মা আমার বোন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের জন্য হলেও আমাকে শক্ত হতে হবে। ওদের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে যে। এক বড়ভাই ছিল তার কাছে সবকিছু শেয়ার করলাম। তিনি আমাকে বিজনেস করার প্ল্যান দিলেন। আমি তখন বললাম; “ভাই বিজনেস করতে তো অনেক টাকার প্রয়োজন আমি এতো টাকা কোথায় পাব। তিনি তখন বললেন; “‘ তুমি চিন্তা করো না আমার এক পরিচিত ভাই আছে তিনি একটা ব্যাংকের ম্যানেজার। তার কাছে গেলে তিনি তোমাকে হেল্প করতে পারবে। তার পর সেই ভাইয়ের সাথে ব্যাংকে গেলাম তার সাথে দেখা করার জন্য। তিনি আমার সবটা শুনে লোন দিতে রাজি হলেন। লোন নিয়ে শুরু করলাম একটা রেস্টুরেন্টের বিজনেস। মাকে ভালো রাখার জন্য বোনটাকে ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য অগ্রগামী হলাম আমার নতুন যাত্রায়।
আজ দীর্ঘ সাত বছর আমি আজ প্রতিষ্ঠিত। আমি এখনো বিয়ে করিনি। ছোট বোনটাকে ভালো একটা পরিবারে বিয়ে দিয়েছি। মাকে নিয়ে আজ খুব ভালো আছি। আজ আমি বড় বড় দশটা রেস্টুরেন্টের মালিক। আজ বাসায় সারাদিন ঘুমালেও তার চিন্তা করতে হয় না। আজ আমি অজস্র টাকার মালিক।
পরিশেষে: ধৈর্য সবাই তো ধরতে পারে না। আর যে পারে সেই সুখের দেখা পায়। আর যেই মেয়েটা মানে বেলা ধৈর্য রাখতে পারেনি। তার একবার ডিভোর্স হয়েছে। এখন যার ঘরে রয়েছে সেই হাসবেন্ডটা যেন কেমন। বেলাকে অনেক মারধর করে। অন্য মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে। আর বাকিটা আপনারাই বুঝে নিন।
তবে সর্বশেষ একটা কথাই বলব; ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারে মাঝে, একটা জোনাকি পোকা যদি উড়ে যায়, তাহলে সেটা আপনার কাছে বিশাল এক আলোর সন্ধান হতে পারে। ঠিক ওই মুহূর্তে আপনি যদি আপনার ওই প্রিয় মানুষের হাতটা ছেড়ে দিয়ে, যদি সেই জোনাকি পোকার আলোর পিছে ছুটেন। একটা পর্যায় গিয়ে বুঝতে পারবেন, ক্ষণিক সময়ের এক আলোর জোগান ছিলো ওই জোনাকি পোকা। তখন আপনি আপনার ঘোরটা কাটিয়ে পিছু ফিরে তাকাবেন ওই হাতটার জন্য। কিন্তু হে ওই হাতটা আর খুঁজে পাবেন না। পাবেন না সেই ভালোবাসা মাখা স্পর্শ।