প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় এপার্টমেন্টের লিফটে এক বয়ষ্ক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়। সন্ধ্যা ৭টায় বাসায় ফেরার সময় লিফট এ উনাকে ছাড়া গত দু মাসে আর কাউকে পাইনি। লিফটের গায়ের বোতম চেপে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমার পাশে দাঁড়ান, আমিও সৌজন্যতা রক্ষার্থে হেসে ফোনে মনযোগ দেই। উনি ৯ তলায় নেমে যান আর আমার গন্তব্য ১২ তলায়।
বিপত্তিটা ছিলো অন্য যায়গায় উনি প্রতিদিন সেই শুরুর দিন থেকে লিফটে উঠেই আমার দিকে চেয়ে থাকতেন, আমি বুঝতে পারতাম যখনই তার দিকে তাকাতাম তিনি নড়েচড়ে দাঁড়াতেন। নিত্যদিন তার একই কাহিনী আমাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলতো। আজকে অফিসে খানিকটা ঝামেলা হওয়ায় মেজাজ টা প্রথম থেকেই বিগড়ে ছিলো, তার উপর ছোট বোনটা কল করে সে কি কান্নাকাটি, আজ ক্লাস শেষে ফেরার সময় নাকি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের চালকের দ্বারা শ্লীলতাহানির স্বীকার হয়েছে ! আমি বাড়ি ফিরলেই থানায় গিয়ে গাড়ির নম্বর অনুযায়ী মামলা করবে।
প্রতিদিনের মতো আজও লিফটে উঠার সময় সেই বয়ষ্ক ভদ্রলোক, বয়স কতো হবে ৬০ বা ৬৫ হবে। প্রতিদিনের মতো মুচকি হেসে আমাকে আগে বোতম চাপতে দিয়ে পাশে দাঁড়ালেন, কিন্তু প্রতিদিন তিনি আমার পাশে দাঁড়ান আজ লিফটের ক্ষানিক টা কোণায় প্রায় মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও উনি দাঁড়াতেই পারেন ভেবে আমি ফোনে মনযোগ দিলাম। উনি উনার এক হাত প্যান্টের পকেটে দিয়ে কি যেন হাতড়াচ্ছিলেন আর বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন যা প্রতিদিনের তুলনায় অনেক বেশি। আমি বিব্রত হচ্ছিলাম বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি হতে যাচ্ছে, উনার বারবার তাকানো আর অঙ্গভঙ্গিতে আমার শরীর টা ঘিনঘিন করে উঠলো ছিঃহ এমন বৃদ্ধ মানুষ তার মেয়ের বয়সের কাউকে এভাবে নোংরা ইঙ্গিত করতে পারে?? শরীরের সব শক্তি এক করে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম
-কি চান কি আপনি?? নিজের মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের সাথে এভাবে নোংরামি করতে আপনার বুকে বাধে না? আপনার বয়স যদি এতো বেশি না হতো তাহলে একটা থাপ্পড় ও আপনার গাল এড়াতো না। লোকটির চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো মুহুর্তেই ৯ম তলায় আসতে উনি নেমে গেলেন যাওয়ার আগে আবারও পেছন ফিরে তাকালেন আমি রাগে ক্ষোভে থু ছুড়ে মারলাম।
রাগে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে, একটা মেয়ে বাড়ি থেকে অফিস, ১২ বছরের ছেলে থেকে ৯২ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত কারোর কাছেই কেন নিরাপদ নয়? কেনো একটা নারী দেহ নিয়ে এতো লালসা কুকুর গুলোর? পুরো ব্যাপার টা বাসায় ছাপিয়ে গেলাম, বাসায় এসে বোনের অভিযোগ অনুযায়ী বিআরটি ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকার সাহায্যে যোগ্য সাজাও পাওয়ালাম বাস চালক কে। আজ প্রায় ১০ দিন হয়ে গেলো একবারের জন্যে ও ঐ লোকটার মুখোমুখি হতে হয়নি আর আমাকে। সেদিন এরকম কিছু না করলে বদমাইশ টা কে চিনতেই পারতাম না। আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হয়ে গেলো অথচ এমডি স্যার গুরুত্বপূর্ন মিটিং ডেকেছেন, মাথা কাজ করছেনা কোন রকম ব্রাশ করে কাপড় বদলে দৌঁড়ে বেরিয়েছি। কথায় আছেনা শিগগির গেলে ঘুরে আয়? আমারও তাই হয়েছে গত রাতে হঠাৎ লিফট নষ্ট হয়ে গেছে এতো সকালে ঠিক করাতে লোকও আসেনি, তাই বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ১২ তলা থেকে নিচে নামতে হচ্ছে। ৯ তলায় নামতেই দেখি মানুষের ভির, অনেকেই উৎসুক দৃষ্টিতে ফ্লাট নাইন বাই বি এর দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে।
কৌতুহল বশত একজনকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? তিনি বললেন ভেতরে একজন প্রায় মরনাপন্ন । কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগলো দেখতে ইচ্ছে করছিলো কেনো যেন, দেখতে যাবো না করেও গেলাম। ছিমছাম গোছানো একটা ফ্ল্যাট, বসার ঘরে মস্ত একটা ফ্রেমে এক ২০/২২ বছরের মেয়ের ছবি। মাথায় বাদামী রঙের কোকড়া চুল পিঠ অবধি, উজ্জ্বল গায়ের রঙ, হালকা গড়ন, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে মনে হয় যেন বাস্তব মুখচ্ছবি! সরু নাক আর হাসিটা ছবির সবচেয়ে বড় আকর্শন। পাহাড়ের ঢালে ফুলের ঝুড়ি হাতে ছবিটা তুলেছে। যতটুকু চেনা যাচ্ছে এটা বান্দরবানেরই কোন এক পাহাড়। মজার ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটা দেখতে অনেক টা আমার ই মতো যে কেউ না চিনলে বলবে আমার বোন। এত মিল দুটো ভিন্ন মানুষের মাঝে কি করে হয়? অবাক হয়ে চেয়েছিলাম ছবিটার দিকে যেন এক ঘোরে আছি!
– ও রূশা আমার মেয়ে একটা ভারী পুরুষ গলার শব্দে ঘোর কাটলো আমার পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি সেই আটপৌঢ় লোকটি। আমি তার ঘরে দাঁড়িয়ে আছি ভেবেই শরীরে বেশ বড় আকারের একটা ঝাড়ি খেলাম, সরে আসবো তখনই তিনি বলা শুরু করলেন।
– স্নাতক শেষ করার পর প্রথম ৭০০ টাকা বেতনে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পাই, অতঃপর সাড়ে ৬ বছরের প্রণয়কে পালিয়ে এসে পরিণয়ে রূপ দেই। ছোট সংসার আয় কম খুব সতর্কতার সাথে সংসার চালাতো মেয়েটা । রেবেকা প্রভাবশালী ঘরের মেয়ে ছিলো তাই সবসময় ভয় হতো আমার কখনও যদি অভাব সহ্য করতে না পেরে আমাকে ছেড়ে চলে যায় বা ওর পরিবার ওকে নিয়ে যায়! মনের ভেতর থাকা সেই ভয় থেকেই ঐ টানাপোড়েনের সংসারে বাচ্চা নেই। ৯ মাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর অপেক্ষার পর আমার মেয়ে পৃথিবীর আলো দেখে।
মেয়েটার প্রথম প্রথম হাত পা নাড়ানো, ঠোঁট বেঁকিয়ে কেঁদে উঠা, হাত উচু করে ধরতে চাওয়া, অদৃশ্যে চেয়ে হেসে উঠা এসব দেখে আমার স্ত্রী হুহু করে কেঁদে উঠতো আনন্দে! ওর আনন্দ দেখে মনে হতো আমি সার্থক! পেরেছি সে মানুষ টাকে খুশি করতে যে আমার জন্য সব ছেড়ে এসেছে। নাম রাখার দিন বাজার করতে রেবেকা ওর বাবার দেওয়া চেইন টা আমার হাতে তুলে দেয়, নিজেকে খুব অপরাধি লাগছিলো কিন্তু উপায় ছিলো না। মেয়ের নামে আকিকা দেওয়ার জন্য একটা ছোট খাশি কিনি, আর বাকি সব বাজারের তালিকা করে দিয়েছিল ও। মেয়েটার নাম রাখবো পাশের বাসার আন্টি পাক্কা রাধুঁনী উনিই সব করবেন। সাধ্যের মধ্যে ঘটা করে আকিকা দেই, ওর নাম রাখি রুবাইয়াত রূশা। হঠাৎই আমার চাকুরী চলে যায় তখন রূশা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে, মেয়ের ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে রেবেকা চাকুরী নেয়, আর আমি চাকুরীর অভাবে রাতের আধাঁরে রিকশা বেছে নেই। যেদিন রিকশা ভাগে পেতাম না সেদিন দিনমজুরী করতাম।
এতোটুকু ও কষ্ট বা আক্ষেপ হতো না আমার নিজের কষ্টের জন্য, কারণ বাসায় এসে যখন দেখতাম মেয়েটা কুপির আলোতে রাতজেগে পড়ছে তখন সব দুঃখ মাটি হয়ে যেতো। ছাত্রী হিসেবে রূশা খুবই ভালো ছিলো পরপর ৫ম শ্রেণী ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি পায়। ভালো চাকুরীর যাতাকলে তখন আমি শিক্ষিত হয়েও গার্মেন্টস এ হেল্পারের চাকুরী করতাম। মেয়েটা যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে তখন একটা সরকারি ব্যাংকে ভাগ্য গুনে চাকুরী পেয়ে যাই। সংসারে ধীরে ধীরে খরচ বাড়ে কূলাতে পারতাম না তারপর ও মেয়ের মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর রূশা বায়না ধরলো উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবে, ওকে বিদেশে পড়ানোর মতো যোগ্যতা তখন আমার ছিলো না কিন্ত মেয়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে ব্যাংক থেকে ১২ লক্ষ টাকা লোন নিয়ে ইংল্যান্ড পাঠাই। এরপর আর কখনোই রূশার সাথে যোগাযোগ হয়নি আমাদের। শুনেছি কোন এক ব্রিটিশ কে বিয়ে করে সেখানেই স্থায়ী হয়ে গেছে!
ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও বলতে শুরু করলেন; গত চারবছরে আমার স্ত্রী মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন প্রায় অন্ধ হয়ে মৃত্যুশয্যায়! কথাটা বলতে গিয়ে ভদ্রলোকের গলা ধরে এলো। জানিস মা তুই দেখতে অনেক টা আমার রূশার মতো, তাই প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭ টায় বাহিরে দাঁড়িয়ে তোর ফেরার অপেক্ষা করতাম আর লিফটে একসাথে উঠতাম। যাতে তোকে লুকিয়ে দেখে বুকের হাহাকার টা একটু কমে। আমায় ভুল বুঝিস না মা সেদিন আমার মেয়েটার জন্মদিন ছিলো, ওর পছন্দের চকলেট গুলো তোকে দিতে খুব ইচ্ছে করছিলো আমার কিন্তু সাহসে কূলাচ্ছিলো না! তাই হাজারো ইতস্ত করেও পকেট থেকে বের করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা! লোকটির হাত ধরে মেঝেতে বসে পরলো রুহী, মাথা তুলে উনার দিকে ছলছল চোখে চেয়ে বললো
-বাবা আমাকে ক্ষমা করবেন? ভদ্রলোক চোখের জল ছেড়ে বললেন
-মা আমার একটা আবদার রাখবি? আমার স্ত্রী কে চলে যাওয়ার আগে একবার মা ডাক টা শুনিয়ে দিবি? কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না আমি ভদ্রমহিলা চোখে ঝাপসা দেখেন, বিছানার সাথে লেগে গেছেন প্রায়। দরজার সামনে ঝাপসা আমায় দেখে হৃদয়ের সব আকুতি দিয়ে হাত বাড়িয়ে হেসে বললেন রূশা!
এরপর আর হৃদক্রিয়া কাজ করেনি উনার! ভদ্রলোক স্ত্রী কে জাপটে ধরে চোখ বুজে আছেন। ভালোবাসার সামনে আবারও নির্মম ভাবে খুন হলাম আমি! অপরাধবোধে মরে যাচ্ছিলাম। হ্যাঁ এটাই প্রকৃতির প্রতিশোধ.. কোন এক পক্ষকে কাঁদিয়ে গেলে প্রকৃতি তার বিচার দিয়ে সে অপর পক্ষকে জীবন পরিক্রমার কোন এক বাঁকে কাঁদিয়েই যায়! মায়ের সাথে করা প্রতিটা খারাপ ব্যাবহার আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, ভেতর থেকে বারবার কানে একটা শব্দই ভেসে আসছিলো মা ক্ষমা করে দিও আমায়.. ক্ষমা করে দিও..