বাসায় ফিরলাম এইমাত্র। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিলো মা। মায়ের হাতে একটা বই। চোখে চশমা। চশমার পাওয়ার আছে, কত পাওয়ার ঠিক জানিনা। আমি একবার চোখে দুই মিনিটের জন্যে দিয়েছিলাম, তিন মিনিট পর্যন্ত বসে থাকতে হয়েছে চুপ করে। ফ্রেশ হয়ে খেতে আসলাম। টেবিলে দু’টো প্লেট সাজানো। মা খেয়েছে অনেক আগে। আমি ভাত খেয়ে নিলাম। পাশের প্লেটটা খালি পড়ে আছে, চেয়ারটাও! এখানে বসে এই প্লেটে অভ্র ভাত খেতো। আমার ভাই, বড় ভাই। মাস পাঁচেক হলো মারা গিয়েছে। মা এখনো অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পারেনি, আমিও। এখনো নেই হয়ে যাওয়া কারো অস্তিত্ব টের পাই বাসায়। রুমে এসে বসলাম। এটা আমার রুম। এই রুমে এখন আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি অভ্র’র রুমে গিয়ে বসলাম। অভ্রর রুমটা সুন্দর, সাজানো গোছানো।
এই রুমে ফ্যান নেই, বড় জানালা আছে। জানালা দিনের বেলায় খোলা থাকতো, সবসময় নয়। ফ্যান নেই কারন অভ্র’র ভয়! ওর ভয় ছিলো ফ্যানের পাখা খুলে যদি মাথায় এসে পড়ে। অভ্রর মৃত্যুভীতি ছিলো প্রচণ্ড। সাধারণ ভীতি নয়। মৃত্যুভীতি সবার থাকে, ওর অস্বাভাবিক রকম ছিলো।আমি পর্দা সরিয়ে বড় জানালাটা খুলে দিলাম। একদলা বাতাস হুড়মুড় করে ঢুকলো আমার কানের পাশ দিয়ে। বাইরে তাকালাম। বাইরে অনেক অনেকটা দুরে নীল আকাশের কোনায় একখণ্ড মেঘ। সাদা মেঘ। কালো মেঘ ঝরে গিয়ে বৃষ্টি হয়, এটাকে কালো মেঘের মৃত্যু বলা যেতে পারে। সাদা মেঘে বৃষ্টি হয়না। আচ্ছা, সাদা মেঘেরও কি মৃত্যুভীতি আছে?
ঘুম থেকে উঠে টের পেলাম দশটা বেজে গিয়েছে দশমিনিট আগে। এখন দশটা বেজে এগারো মিনিট। শুভ ফোন দিয়েছে প্রায় পঁচিশটার মতো। শুভর সাথে একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ছিলো। শীট! যাওয়া হলোনা। ভার্সিটিও বন্ধ। অথৈকে ফোন দিব কিনা ভাবছি। নাহয় দেখা করে আসি। বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগেনা। অথৈ এই মুহূর্তে বসে আছে সামনে। এই মেয়েটিকে অভ্র দু’চক্ষে দেখতে পারতো না। অভ্রকে ক্ষেপানোর জোর দায়িত্বটা অথৈ নিজ দায়িত্বে নিজ কাঁধে নিয়েছিলো। অভ্রকে ওর ভয় পাওয়া রোগটা নিয়ে কিছু একটা বললেই ক্ষেপে যেতো। অভ্রকে রাগানো সহজ ছিলো। অথৈ আমার সামনে চুপ করে বসে আছে। এই মেয়েটি মোটেও চুপচাপ নয়, বকবক করে কান ঝালাপালা করা টাইপের মেয়ে। সময় বদলে দেয় পরিস্থিতি, আর পরিস্থিতি এত বদলে দেয় মানুষকে! মেয়েটি হঠাৎ আমার কাঁধে মাথা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— রাত্রি কেমন আছে জানো?
— না। ও আমার সাথে কথা বলেনা, আমাদের কারো সাথেই বলেনা। আমাদের সাথেই নয় ইভেন কারো সাথেই কথা বলেনা! অথৈ’র চোখে জল, ছলছলে দৃষ্টি নিয়ে কিরকম অসহায়ের মতোন তাকায় মেয়েটি। বলি,
— কাঁদছো কেন? এতো নরম কেন তুমি? রাত্রি একটা বারের জন্যে চোখ থেকে জল ফেলেনি জানো, ভয়ংকর রাগ দেখেছি ওর চোখে যতবার তাকিয়েছি। কেঁদোনা, আমাকে দেখো। আমি কাঁদছি? আমি তো কাঁদছিনা। রাত্রি অভ্রর বন্ধু। অভ্রকে প্রচণ্ডরকম ভালোবেসেছে; অভ্র জানেনি, জেনে যেতেও পারেনি। এটা জানি আমি এবং অথৈ। অথৈ কাঁধে মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি পাশের খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে আছি। ওখানে কিছু ছেলে খেলা করছে। আমার চোখেও জল। লুকোনোর চেষ্টা করছি। অশ্রু লুকোনোর সবচেয়ে সুন্দরতম উপায় হলো, অশ্রু বিসর্জনের গল্পটি বলা এসো, একটা গল্প বলি। পৃথিবীর সবচেয়ে ভীতু মানুষটির গল্প। অভ্র। এটা অভ্রের গল্প।
অভ্রের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান দেড় বৎসর। বয়সে দেড় বৎসরের বড় হলেও আমি ও কে ভাইয়া ডাকিনা এবং আমার থেকে দেড় বৎসর আগে জন্ম নেয়ার সামান্য প্রাপ্য সন্মানটুকুও দিইনা। আমাদের বাসায় সারাক্ষণ ঝগড়া হয়। ভয়ংকর সব ঝগড়া। মা সারাদিন ঝগড়া সামলাতে ব্যস্ত থাকে। এই ঝগড়ায় আমি জিতে যাই। আশ্চর্যজনকভাবে অভ্রও জিতে যায়। অদ্ভুতভাবে মা হেরে যায়। ঝগড়া গুলো যেকোনো সুত্র ধরেই হয়ে যেতে পারে। সেটা অতি ক্ষুদ্র কারন হোক অথবা বৃহৎ কারন। না! আমরা মোটেও ছোট নই। অভ্র বছর দু’য়েক হলো একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে, ভালো বেতনের চাকুরী। বিয়ের বয়েস হয়েছে কিন্তু বিয়ে করবেনা। রাত্রি নামের একটা বন্ধু আছে ওর, মেয়েটি ভালো। পছন্দ করে ও কে। অভ্র কখনো এই ব্যাপারটার দিকে সামান্যও নজর দেয়নি। কি জানি কেন দেয়নি। আমি ভার্সিটিতে পড়ছি।
আমার পকেট খরচ থেকে শুরু করে পুরো সংসারের সবকিছু অভ্রের হাতে। অভ্রের সাথে ঝগড়াটা আমার হাতে। ঝগড়ার মধ্যে আমার কাছে ও কে রাগিয়ে দিয়ে হারানোর একটাই উপায় থাকে। ওর ভয়রোগ সম্পর্কে কিছু তেতো কথা বলা। অভ্রের এই ভয়রোগটা অস্বাভাবিক রকম বেশি ছিলো। বাসে উঠতোনা, সিএনজিতেও না। আবার পায়ে হেঁটেও চলতোনা রাস্তায়। রিকশা… ওর আসা যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিলো এটা। অভ্রের ধারণা, পৃথিবীর সবচেয়ে সেইফ গাড়ির নাম রিকশা। অভ্র কোথাও বেড়াতেও যেতে চাইতোনা। একবার জোর করে কক্সবাজার নিয়ে গিয়েছিলাম। বাসে করে ও যাবেনা, ট্রেনে করেও না। বললো, রিকশা নিয়ে গেলে যাবে। মা হা হয়ে অভ্রের দিকে তাকায়। আমি রাগান্বিত চোখে তাকাই মায়ের দিকে। মায়ের অতি আদরের ফল এগুলা, এটা আমার কাছে মনে হয়। অতি আদরের সন্তানগুলো কিউটের ডিব্বা হয়।
অনেক ঝক্কি ঝামেলা শেষে জোর করে, বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসে করে নিয়ে গিয়েছিলাম কক্সবাজার। দুইদিন ছিলাম। প্রথম দিন ঘুরতে বের হয়ে ও পানিতে নামেনা, সাঁতার জানেনা, ডুবে যাওয়ার ভয়। বালিতেও হাঁটেনা, চোরাবালির ভয়। ঠায় একজায়গায় বসে ছিলো সারাক্ষণ। পরের দিন হোটেল থেকেই বের হয়নি আর। ওর উচ্চতা ভীতি আছে, কখনো ছাদে উঠতোনা। সারারাত ওর রুমে লাইট জ্বলতো, ভুতের ভয়ও ছিলো প্রচণ্ড। ভীতু ছিলো একটা। মহা ভীতু। এই মুহূর্তে আমি অভ্রের রুমে বসে আছি। ভাত খেয়ে এসেছি একটু আগে। এখন সামান্য পরিমান ঝগড়া না হলে ভাত ঠিক হজম হবেনা। শুরু অভ্রই করলো,
— অথৈর সাথে কথা হয়েছে?
— হুম। তোর কি দরকার জেনে?
— আমার সম্পর্কে বাজে কথা বলতে নিষেধ করবি ও কে..
— কি বাজে কথা বলবে তোর সম্পর্কে?
— কাল রাত্রি কে বলছে, আমি নাকি মাকড়সা ভয় পাই।
— পাস তো। মিথ্যে কি?
— চুপ করবি? আরো বলেছে, আমার নাকি একটা স্পাইডার ওম্যান বিয়ে করা প্রয়োজন।
— ঠিকই তো বলছে। যেটা ভয় পাস ওটারে গলায় বেঁধে রাখ, ভয় কেটে যাবে। মনোবিদ্যায় এটার একটা দারুণ তথ্য আছে অভ্রের মুখ টকটকে লাল হয়ে আসে। চিৎকার করে,
— এই মেয়েটা আরেকদিন বাসায় আসুক, ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবো ওর আমি। আমি যে ওর হবু বরের দেড় বৎসরের বড় ভাই এটা ওর মাথায় রাখা উচিৎ। আমি ঘরদোর কাঁপিয়ে হো হো করে হাসলাম। বললাম,
— কদমবুসী করতে বলবো?
অভ্র কড়মড় করে তাকিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। অভ্র, তোর ঝগড়াগুলি মিস করছি… তুই কি শুনতে পাচ্ছিস ভাই? তোর কান্না পায়না? বাইশে অক্টোবর আমার এক্সিডেন্ট হয়। গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট! মাথায় ভয়ানক আঘাত পাই। মাথার এক তৃতীয়াংশ ড্যামেজড! তেরোদিন মেডিকেলের বিছানায় পড়ে থাকার পর কোমায় চলে যাই। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দেন। এক্সিডেন্টের পর আমার কিছুই মনে ছিলোনা, এসব শুভ’র কাছ থেকে শোনা। হুট করে এসে ঝটকা দেয়া ভয়ংকর এক অবস্থায় পড়ে থেকে মা একটু পর পর কান্না করে জ্ঞান হারাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরে আসলে বলছেন,
— মুনীর কই? এই অভ্র, এই শুভ… চুপ করে থাকবিনা। তোরা কেউ যদি একবার বলিস মুনীরের কিছু হইছে, কাউরে বাসায় ঢুকতে দেবোনা আমি। আমার বাবুটারে আইনা দে… ওই
মা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন আস্তে আস্তে। মাকে শান্তনা দিচ্ছেনা অভ্র, দেয়ার চেষ্টাও করছেনা। কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে ওর শরীরটাও, নাড়াছাড়া ও নেই। পাল্টেও যাচ্ছে কেমন যেন একটু! আহা সময়, আহা পরিস্থিতি! বিকেলে মেডিকেলের বাইরের ব্যস্ত রাস্তা ফেরিয়ে বাইরের টং দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে একটানে দু’টো সিগেরেটও খেয়ে আসলো। অভ্র সিগেরেটের গন্ধও সহ্য করতে পারেনা। শুভ হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো অভ্রের দিকে। মাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আছে শুভ তখনো। অভ্র ঐ রাতেই বাসায় ফিরলো। রাত দু’টোর দিকে ফোন দিলো শুভকে। বাসায় যেতে বললো। শুভ একদৌড়ে বাসায় যায়, ভয় পায় কি না জানি হয়েছে। অভ্র রুমের ভেতরে ও কে নিয়ে গিয়ে বসায়। তারপর বলে,
— শুভ। কাউকে কিছু বলতে পারছিনা। মাকে তো নয়ই।
— কি হয়েছে ভাইয়া?
— আমি কিছু একটা করবো। আমার পুরো বিশ্বাস আছে এটা সম্পর্কে, এটা হবে। অবশ্যই হতে হবে।
— কি?
পরের দিন মেডিকেলে ভাইয়া আমার পাশে গিয়ে বসে। এ্যাই অভ্র, ভাইয়া বলছি তোকে। মানাচ্ছে না রে। থাক, অভ্রই বলি। অভ্র আমার পাশে বসে হাত ধরে রাখে অনেকক্ষণ। চোখ থেকে অশ্রু টপটপ করে আমার হাতে এসে পড়ে। বাংলা সিনেমা হলে ঠিক তখনি আমার কোমা থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ ছিলো। কিন্তু এই সিনেমায় অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এখনো। পুরো দু’ঘন্টা আমার হাত ধরে বসেছিলো অভ্র। বাইরে শুভ চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তারপর বাসায় ফিরে যায় অভ্র। দেড় ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা পায়। মায়ের এমন আনন্দময় মুখ আমি কখনো দেখিনি। ঈশ্বর, পৃথিবীতে প্রচণ্ডরকম দুঃখগুলো কি এই আনন্দময় মুখচ্ছবি দেখানোর প্রথম শর্ত হিসেবে তুলে রাখো তুমি? আমি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি। মা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— অভ্রকে ফোন দিই, শুভটাও যে কই গেলো? অভ্র ফোন ধরছেনা। কয়েকবার কল দেয়ার পর মা শুভকে ফোন দেয়। শুভও ফোন ধরেনা। অনেকটা সময় চেষ্টার পর ফোন রিসিভ করে, মা চিৎকার দিয়ে বলে,
— শুভ, আমার বাবুটার জ্ঞান ফিরেছে। অভ্র কই, মেডিকেল আসতে বল…
ওপাশ থেকে কাঁদতে কাঁদতে শুভ কিছু একটা বলে… মায়ের হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে যায়।
আমার হাত ধরে শক্ত করে বসে থাকে মা। আমি কিছু বুঝতে পারিনা। অভ্র, এ্যাইইই অভ্র.. তুই কই? অভ্র মারা গেছে! আমার জ্ঞান ফিরে আসার পর আমি যখন ভয়ানক পিপাসায় আকন্ঠ ডুবে একগ্লাস পানি চাচ্ছি, অভ্র ঠিক তখন আমার রুমের ছোট্ট পড়ার টেবিলে মাথা নিচু করে বসেছিলো। প্রান ছিলোনা ওর শরীরে। আমি বিশ্বাস করিনা! আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনা। অভ্র আগের রাতে একটা কিছু করেছে। অযু করে নামায পড়েছে। তারপর সারারাত দু’হাত তুলে কান্না কাটি করেছে,
— ঈশ্বর, ভাইটা কে সুস্থ করে দাও। ভাইটার সমস্ত অসুস্থতা আমায় দাও, সমস্ত কষ্ট আমায় দাও, মৃত্যু যদি লেখা থাকে তবে ওটাও আমায় দাও। আমি আমার জীবনের বিনিময়ে ভাইটার জীবন চাচ্ছি!
ঈশ্বর কবুল করেছে অভ্রের বলা প্রতিটা শব্দ। বিজ্ঞান বিশ্বাস করেনা এটা। ইমোশনে বিজ্ঞান চলেনা। বিজ্ঞান ইমোশনে দুর্বল। পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল এই ইমোশনের জায়গাটায় বিজ্ঞান বারবার মানুষের কাছে হেরে গিয়েছে! শুভ পুরো ঘটনার একমাত্র স্বাক্ষী। প্রথম পাঁচদিন ভয়ে আমার মুখোমুখি হয়নি। ফোনে বলেছিলো সব। ছয়দিন পর আমার সামনে আসে। সামনে আসার পর আমার এই অসুস্থ শরীরটাকে কোনোরকমে বসিয়ে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় দিই ও কে। শুভ কাঁদোমুখে আমার বামহাতটা শক্ত করে ধরে বসে থাকে। ওর সত্যিই কিছু করার ছিলোনা। ওর উপর করা অভ্রর অন্ধ বিশ্বাসটা সবদিক দিয়ে আটকে দিয়েছিলো ও কে। আমি বাসায় ফিরে আসি চারমাস পর।
চারমাসে মা আমার সাথে দেখা করেছে সাত দিন। দেখা করতে আসতোনা, কেন জানিনা। একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে এমন পাথর হয়ে যেতে পারে আমার জানা নেই। এই চারমাস শুভ ছিলো আমার সাথে, আর অথৈ। অথৈ এক্সিডেন্টের খবর শুনেনি, অথবা বলতে পারি শোনায়নি। কেউ ভয়ে জানায়নি তাকে। গ্রামে ছিলো ও। চারমাস পর বাসায় ফিরে দেখি বাসাটায় একটুও চেঞ্জ নেই। একদম আগের মতো। এখনো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই বাসায় আমরা তিনজন থাকি। আমি মা আর অভ্র। অভ্র? আমার প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। অভ্রের রুমে গিয়ে অনেকক্ষণ বসলাম। তারপর নিজের রুমে এসে ছোট্ট টেবিলটা দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো। এখনো টেবিল চেয়ার একিই রয়ে গিয়েছে। কেউ হাতও দেয়নি। এই চেয়ারে বসে অভ্র শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলো। অথৈ কাঁধে হাত রাখলো আমার। টেবিলে একটা চিঠি, শুভ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
— এটা ভাইয়া লিখেছে, তোর জন্য। এটা লিখতে লিখতেই….
শুভ কাঁদছে, আমি চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। “মুনীর, মা অসুস্থ হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। আজ বাসায় এসে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তুই ছাড়া বাসাটা কি ফাঁকা লাগছে রে। আমি একের পর এক পাগলামো করছি। অথৈকে কিছুই জানাইনি, ও গ্রামে গিয়েছে বিশ পঁচিশ দিন হলো। জানাইনি, অযথা কান্না কাটি করে হাঙ্গামা বাঁধাবে। তুই কি আর মারা যাচ্ছিস? শুধু শুধু সবাই কাঁদবে কেন? তুই তো আজই সুস্থ হবি। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি সারারাত। কেন জানি প্রচন্ডরকম বিশ্বাস ছিলো, ঈশ্বর কবুল করবেন। করেছেন।
এই যে, তোকে চিঠিটা লিখছি আমি এখন খুব ভালো নেই, কিন্তু আমি ঠিকই জানি তোর জ্ঞান ফিরবে একটু পর। আচ্ছা, এসব বাদ দে। তোর মুখ থেকে শেষবারের মতো ভীতু ডাকটা শুনতে ইচ্ছে করছে। পারবোনা রে, এই ডাকটা শোনার পর আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে ভীষন। মুনীর, ভালো থাকিস খুব। মাকে ভালো রাখবি, মা যেনো এসব কিছুই জানতে না পারে। কেউ যেন জানতে না পারে। অথৈ মেয়েটা একটু ফাযিল টাইপের, তবে তোকে বড্ড ভালোবাসে। আমি জানি। মেয়েটাকে কষ্ট দিবিনা। রাত্রিকে কিছু বলিনি, শুনলে মরে যাওয়ার আগে ওই মেরে ফেলবে আমায়। আচ্ছা, কি যেন বলতে চাচ্ছিলাম, ভুলে গেছি.. ভালো থাকিস। অভ্র” আমি চিঠির কালো কালিমাখা শব্দগুচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখে জল জমেছে ফোঁটা খানিক, শুভকে জিজ্ঞেস করলাম,
— মা এই চিঠি পড়েছে?
— না। আন্টি এই রুমে আসতো ও না।
অভ্রের রুমে বসে থাকতো। তবে রাত্রি এসেছিলো বাসায়, অভ্রের রুমে চুপচাপ বসে ছিলো অনেকক্ষন। হয়তো এই রুমেও এসেছে, চিঠি পড়লেও পড়তে পারে। আমি সিউর নই আট বৎসর পরঃ বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। আমি অথৈ আর অভ্র বারান্দায় বসে আছি। আমাদের ছেলেটার অথৈ নাম রেখেছে অভ্র! অভ্র লাফ দিয়ে বৃষ্টি ছুঁতে চাইছে। দু’হাত বারান্দার বাইরে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। তারপর কি মনে হলো, হঠাৎ আমার কোলে ছুটে আসলো। এসে বললো,
— আব্বু, আমি মাকড়সা ভয় পাই, এজন্য স্কুলের বন্ধুরা আমায় ভীতু ডাকে। আবার বলে, অভ্র অর্থ নাকি ভীতুর ডিম!
আমি একবার অথৈর দিকে তাকাই। তারপর অভ্রের তুলতুলে গালটায় হাত রেখে বললাম,
— ওদের কথায় কান দিওনা বাবু। তোমার নামটা খুব স্পেশাল। আমি এমন একজনকে চিনি, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষগুলোর মধ্যে একজন ছিলেন। তার নামও ছিলো অভ্র। অভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, আমি ওর গাল টিপে দিয়ে বললাম,
— ঐ মানুষটাও মাকড়সা ভয় পেতো, বুঝেছো?
অভ্র হাসে। হাসতে হাসতে মাথা দুলায়। পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষটি কেন মাকড়সা ভয় পেতো ওর ছোট্ট মাথায় খেলছেনা। ওপাশের চেয়ারে অথৈ বারান্দা দিয়ে ছিঁটকে আসা বৃষ্টির ফোঁটায় অল্প অল্প করে ভিজছে৷ ওর চোখে জল। আমি ভেজা চোখে বাইরে তাকালাম। আসমানেরও কি স্মৃতি আছে অমন কোনো? এরকম ঝুম বৃষ্টি অনেকদিন দেখিনি।