ভয়!
৩য় বেবিটা পেটে আসার পর থেকেই রেহানা’র মনে শান্তি নেই, হারানোর ভয়, মৃত্যু ভয়ে সে পুরাই ভীত সন্ত্রস্ত ।
মা হবার আনন্দ সে কোনোভাবেই উপভোগ করতে পারছেনা।
না চাইতেও কি সে, সবকিছুর মূলে সন্তানটাকেই দায়ি মনে করছেনা ?
কিন্তু তার কি দোষ! নিষ্পাপ এই ভ্রুণ কিভাবে কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে?
এরপরও মৃত্যু বা হারানোর ভয় যেন তাকে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
না, তার মৃত্যুভয় নয়, তার বর এর মৃত্যুভয়ে সে ভীত, খুব ভীত।
কেনো যে বাচ্চাটা পেটে আসলো!
তাও এক যুগ পর, না চাইতেই।
সে চায়নি, কেউই চায়নি।
ব্যস, এসে গেলো, আর মনুষ্য সন্তান, একটা জীবন কিভাবে নষ্ট করে?
কিন্তু…
কিন্তু কি? কি সমস্যা?
সমস্যা কিছুই নয়, শুধুমাত্র মনের ভয়। হয়তো বলা যায়, শুধুমাত্র কিছু কুসংস্কার, যার কোনো ভিত্তি নেই। যা বিশ্বাস করাও গোনাহের কাজ। হয়তো তার বেলায় এমন কিছুই ঘটবেনা।
রেহানা’রা চারবোন। রেহানা তিন নাম্বার।
বড়বোনের চার নাম্বার সন্তান যখন দুই বছরের,হ ঠাৎ করেই দুলাভাইয়ের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। ভালোভাবে চিকিৎসা করাও সম্ভব হয়নি, একদম নাকি লাস্ট সময়ে ধরা পড়লো। একমাসের মধ্যে মারা যান তিনি।
মেজবোনের ৩য় বাচ্চা একমাসেরও হয়নি, আপা দুলাভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে যায়।
কি কারণে তা সবার কাছে এখনো অজানা।
তবে কিছুনা কিছু নিয়ে তাদের সবসময় ঝগড়া ঝাটি লেগেই থাকতো।
সবচেয়ে ছোট বোনের দ্বিতীয় সন্তান ভালোই ভালো পাঁঁচবছরের হয়ে গেলো। কিন্তু গতবছরই তার হাজব্যান্ডের কিডনি’র সমস্যা ধরা পড়ে। দুটো কিডনিতেই নাকি সমস্যা। সবসময় শরীরে পানি এসে যাচ্ছে।
অর্থাৎ, অসুস্থ হয়ে পড়লো। কাজ টাজ সব ছেড়ে ঘরে পড়ে আছে, চিকিৎসা চলছে।
এসব কারণে,রেহানা’র ধারণা হয়েছে,তাদের সব বোনদের ভাগ্যই হয়তো একই। আর সবার বাচ্চা ছোট থাকতেই তারা তাদের পিতার আদর, ভালোবাসা, যত্ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তার বেলায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবেনা তো? তার ছোট সন্তানটিও বঞ্চিত হবেনা তো বাবার আদর ভালোবাসা থেকে?
সে কারণে রেহানা খুব ভয় পাচ্ছে। তার ঠিকমতো খাওয়া হয়না। ঘরের সবার দেখাশোনা কিছুই সে ঠিকভাবে করতে পারছেনা।
রেহানা তার ভয়ের কথা কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছেনা।
স্বামীকে বললে হয়তো হাসবে, পাত্তাই দেবেনা, একেবারে উড়িয়ে দেবে।
কিংবা মনে মনে তারও হয়তো মৃত্যু ভয় এসে যেতে পারে। কি দরকার?
তাই সে বলেনা। ভেতরে ভেতরে একাই তা সহ্য করে। আর সহ্য করতে না পারলে তখন সব উল্টাপাল্টা হয়ে যায়, অমনোযোগী হয়ে পড়ে সে।
স্বামী, বাচ্চারা ভাবছে সে অসুস্থ, তাই সম্ভবত এমন ভুলভাল হচ্ছে। তাই তারা যতোটা পারে সাহায্য করে দেয় কাজে।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়।
হয়তো একটু বয়স হওয়ায় বাচ্চার জন্ম দিতে অনেক কষ্ট পায় রেহানা। রীতিমতো যুদ্ধ করে, নরমাল প্রক্রিয়ায় বাচ্চাটির জন্ম দেয় সে।
মেয়ে সন্তান হয়েছে। খুব খুশি পিতা, সে কন্যা সন্তান খুব ভালোবাসে। এখন তাদের দুই কন্যা। দুই কন্যাই বাপের দুই চোখের মনি।
দুইটা বছর পার হয়, সব স্বাভাবিক।
কিন্তু তারপর…
না, তেমন কিছু নয়। রেহানা’র স্বামী’র ডায়াবেটিক ধরা পড়ে।
অনেকদিন পর, আবার হঠাৎ করে ধ্বক করে উঠে রেহানা’র বুক। ভয়ে এতোটুকুন হয়ে যায় সে।
কালো দিনটি তার জীবনেও আসছে নাতো!
আবার নিজেই নিজের মনকে বুঝায় , তা হবে কেনো?
স্বামী’র চল্লিশ পেড়িয়ে গেছে, ওজন বাড়তি, তাই হয়তো এই রোগের জন্ম। এটাতো বর্তমানকালে স্বাভাবিক একটি অসুখ। ধরতে গেলে প্রতিটি ঘরে একজন এর আছে। নিয়ম মেনে চললে, এটা কোনো রোগই নয়। রেহানা সান্ত্বনা দেয় নিজের মনকে।
তবুও ভয় যায়না।
স্বামী যেদিন খুব রোমান্টিক হয়, সেদিনও ভয় করে তার।
কখনো যদি বলেন,
আজ একটু বাচ্চার সাথে আমাকেও খাইয়ে দাওনা, হাতে খেতে মন চায় না..
রেহানা’র বুক ধড়ফড় বেড়ে যায়, এতো ভালোবাসা, কাছে আসাতে। তাকে হারাবার ভয় যেন আরো জোরালো হয়।
তাদের ছোট মেয়ের আজ বিয়ে। ঘর ভর্তি মানুষ। বড় ছেলের বউ, নাত নাতনী, মেয়ের স্বামী, সন্তান সবাই ঘরময় হৈহৈ রৈরৈ করছে।
রেহানাও আজ সবুজ কাতান পরেছে। বড় বউ পার্লার থেকে সেজে এসে খুব যত্ন করে তাকেও সাজিয়েছে। রেহানা’র স্বামী, তিনিও বউয়ের সাথে মিলিয়ে সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি পরে ইয়াং হয়ে ঘুরঘুর করছেন।
না, তার কিছুই হয়নি।
রেহানা’র ভয় কেটে গেছে, সে খুব খুশি আর সুখি। মেয়ের বিয়েতে রেহানা ততোটা কষ্ট পাচ্ছেনা, যতোটা খুশি সে, তার স্বামী বেঁচে আছে সেজন্য।
স্বামী তো দেখি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই অস্থির। দুই দুইটা বুকের ধন এক এক করে পরের বাড়ি চলে যাচ্ছে। কি করে তিনি স্বাভাবিক থাকবেন!
রেহানাও কাঁদে কিন্তু তা সুখের। পরিবারের সবাই একসাথে এক জায়গায় আছে, এই দৃশ্যের চেয়ে সুখকর আর কি হতে পারে।