খুব ছোটবেলা থেকেই মোবাইলে আ্যাকশন গেইম খেলতে পছন্দ করি , বিপক্ষ দলের শত্রুদের গুলি খেয়ে গেইম ওভার লেখাটা দেখলে খুব বিরক্তি লাগত। একদিন ভাইয়াকে জিঙ্গাসা করলাম , আচ্ছা ভাইয়া নিজকে নিরাপদে রেখে কোন পদ্ধতিতে শত্রুদের সবচেয়ে সহজে আক্রমন করা যায়।
ভাইয়া বলল , আকাশ থেকে বোমা ফেললে অথবা গুলি করলে শত্রুরা তোমার কিছুই করতে পারবে না। ভাইয়ার মুখে এই কথা শুনে মনের ভেতরে পাইলট হত্তয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগল। আমি সবে মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ি। ক্লাসে একদিন ম্যাডাম সবাইকে দাড় করিয়ে জিঙ্গাসা করল , বড় হয়ে কে কি হতে চাত্ত ?
আমি বললাম , ম্যাডাম আমি পাইলট হতে চাই। আমার মুখে এই কথা শুনে ম্যাডাম মনের ভেতরে ছোট-খাট একটা ধাক্কা খেলো। বাসায় আসার পর বাবা যখন আমার মুখ থেকে আমার পাইলট হত্তয়ার ইচ্ছের কথা শুনল , শুনে তো বাবা মহাখুশি। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল , খোকা তোমার স্বপ্নটা তো অনেক বড়। তবে লক্ষ্যটা যতো বড়ই হউক না কেন , চেষ্টা করলে তুমি একদিন পাইলট হতে পারবে।
বাবার মুখে এই কথা শুনে তখন থেকেই নিজেকে পাইলট মনে হতে থাকল। কিন্তুু বাবা যদি জানত আমি মোবাইলের গেইমসের মতো নিরাপদে শত্রুদের আক্রমন করার জন্য পাইলট হতে চাই , তাহলে নিশ্চয় কখনো এই কথা বলত না।
প্রাইমারী স্কুলে ফাইনাল পরিক্ষা দেত্তয়ার পর আমার রেজাল্ট খুব খারাপ আসলো। টানা-টানি করে কোন রকমে পাশ করেছি। পাশ করার পর বাবার ক্ষমতার জোড়ে চট্রগ্রামের সবচেয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি হত্তয়ার সুযোগ পাই। স্কুলে ভর্তি হত্তয়ার দু-মাসের মাথায় স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে স্কুলে মারা-মারি করার অপরাধে বহিস্কার করে দেয়।
স্কুল থেকে বহিস্কৃত হত্তয়ার পরে ও বাবা আমাকে কিছুই বলে নি। আমাকে নিয়ে বাসা থেকে খুব কাছের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। লেখাপড়ায় কোন ভাবেই মনযোগ বসত না। এই রকম অমনোযোগীতার মাঝেই আমি বড় হতে লাগলাম। আস্তে আস্তে ফ্রেন্ড সার্কেল বাড়তে লাগলো। একই স্কুলে পাঁচটি বছর কাটিয়ে দিলাম , এই পাঁচ বছরের মাঝে যদি ও ভিবিন্ন অপরাধে আমি আরো দু-বার বহিস্কৃত হয়েছিলাম। কিন্তুু বাবার রিকোয়েস্টে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে রাখতে বাধ্য হয়। স্কুল থেকে এসএসসি পরিক্ষা দেত্তয়ার পর নিজকে অনেক বেশি মুক্ত মনে হতে লাগলো। এক্সাম শেষ হত্তয়ার পর রাতের বেলা ঘর থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে সারারাত বাইরে আড্ডা দিতাম। বাইরে আড্ডা দেত্তয়ার অপরাধে পুলিশ আমাকে সহ আমার সাথে আরো ছজন ফ্রেন্ডকে জেলখানার ধরে নিয়ে আসে।
জেলখানায় নিয়ে আসার কিছুক্ষন পরেই বাবা এসে আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। বাসায় আসার পর বাবা আমাকে কড়া শাসন করে , বাবা রাতের বেলা আমাকে ঘর থেকে বের হত্তয়া নিষেধ করে দিলো। বাবার কথা না শুনে আবারো রাতের বেলায় ঘর থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে সময় দেত্তয়া শুরু করলাম।
এর মাঝেই খবর পেলাম আমাদের এস এস সি এক্সামের রেজাল্ট দিবে। ফলাফল জানার জন্য স্কুলে এসে শুনি আমি দু-সাবজেক্ট ফেল করেছি। দু-সাবজেক্ট ফেল করার পরে ও বাবা আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলল , খোকা এটা কোন ব্যাপার না , দেখিস ঠিকভাবে পড়াশুনা করলে সামনে পাশ করতে পারবি।
তারপড় থেকে প্রতিদিন রাতেই বাইরে এসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। রাতের বেলা বাইরে পেয়ে পুলিশ আবারো গ্রেফতার করে জেলখানায় নিয়ে যায়। জেলখানায় নিয়ে আসার পর বাবাকে খবর দেত্তয়ায় বাবা আমাকে মুক্ত করানোর জন্য না আসার কারনে আমাকে দু-দিন জেলখানায় থাকতে হলো।
এই দু-দিনে জীবনের প্রথম অনুভব করেছি বাবাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়। দু-দিনে কতবার কান্না করেছি তার কোন হিসেব নেই। জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে এসে দেখি বাবা চুপ করে বসে আছে। আমার সাথে কোন-প্রকার কথা বলছে না। আমি রুমে এসে দড়জা বন্ধ করে সেদিন না ঘুমিয়ে সারারাত কেদেছি। আমি আস্তে আস্তে উপলদ্ধী করতে পারলাম , জীবন কতটা কঠিন। জীবনের লক্ষ্য পৌছতে হলে কতটা সংগ্রামী হতে হবে। নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য খুবই মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া শুরু করলাম।
এক বছর পর এসএসসি পরিক্ষা দিয়ে যখন আমি এসএসসি তে গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম , জীবনের ফাষ্ট বাবাকে এতোটা আনন্দিত হতে দেখলাম। তারপড় এইচ এস সি পরিক্ষায় চট্রগ্রাম বোর্ডে প্রথম হত্তয়ার কারনে কানাডায় একটা ম্যাডিক্যাল কলেজে সরকারী স্কলারশীপ পেয়ে পড়ার সুযোগ পাই।
চার বছর মেয়াদী ম্যাডিক্যাল কোর্স সম্পন্ন করব বলে আমি কানাডায় যাত্তয়ার জন্য বাবার সাথে চট্রগ্রাম এয়ারপোর্টে এসে পোছেছি। বাবার কাছ থেকে বিদায় নেত্তয়ার সময় বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম , সরি বাবা তুমি রাগ করো না , তোমার ছেলে পাইলট হতে না পারলে ও দেশের সেবা করার জন্য অনেক বড় ডাক্তার হবে।
বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো , বাবার চোঁখে পানি দেখে জিঙ্গাসা করলাম , বাবা কাঁদছ কেন ? বাবা বলল , খোকা এটা সুখের কান্না , পৃথিবীতে সকল বাবারাই সুখের কান্না কাঁদতে চায়। আমি বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে ডুকে যাচ্ছি , পিছনের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। কারন আমি জানি , পিছনের দিকে তাকালে কোনভাবেই নিজের চোঁখের পানি ধরে রাখতে পারব না।