হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি এখন। খুব কষ্ট করে উঠে বসার চেষ্টা করেও পারছিলাম না। রুপা সারাদিন হসপিটালে এসে আমার পাশে বসে থাকে, চেহারাটা মলিন হয়ে গেছে একদম। আমার জন্য মেয়েটা কী না করলো। আজ আমি এক কঠিন অবস্থায়। ডক্টরের দেয়া মেয়াদ অনুযায়ী আর চার দিন মাত্র বেঁচে আছি। ভাবতেই পারছি না আমার রুপা আমায় ছাড়া কি করে বাঁচবে। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। নার্সকে ইশারা করে বললাম আমাকে একটু তুলে বসাতে।
রুপা বাসায় গিয়েছে। আমার মেয়েটা বাসায় বুয়ার কাছে থাকে, কান্নাকাটি করে। ফোন করে শুধু রুপাকে বলে, “মামুনি আমার আব্বুকে তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে আসো।” মেয়েটা এতো বাবা ভক্ত হবে বুঝিনি। নার্সকে বললাম একটা প্যাড আর কলম দিতে। যদিও নার্স একটু ইতস্তত বোধ করতেছিলো দিবে কি দিবেনা। আমি একটু স্বাভাবিক রিএক্ট করে বুঝালাম আমি ঠিক আছি, আর ওটা আমার ইমপর্টেন্ট। তারপর নার্স এনে দিলো। নার্সের সাথে একটা ডিল করলাম কাগজে লিখে লিখেই। কথা বলতে কষ্ট হয় খুব। ডিলটা ছিলো, লিখার পর যেদিন আমি পৃথিবীতে আর থাকবোনা সেদিন যেনো নার্স আমার এই চিঠিটা রুপাকে দেয়। চিঠিটা লিখা শুরু করলামঃ
প্রিয় রুপা,
আমার একটা স্বপ্ন ছিলো, একটা না অনেকগুলোই ছিলো যেগুলোর বেশিরভাগ জন্ম তোমাকে ঘিরেই। আমার তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ ছিলোনা। বস্তিতে মানুষ হয়েছি। এ সাহায্য করতো ও সাহায্য করতো তাই পড়াশোনাটা করেছি। শেষমেশ কিভাবে জানি তোমাকে পড়ানোর দায়িত্বটা পেয়ে গেলাম। স্টুডেন্ট ভালো ছিলাম তো তাই হয়তো! পরে নিজেই কীভাবে কীভাবে যেনো প্রেমে পড়ে গেলা। আমার ধারনার বাইরে ছিলো ব্যাপারটা। আমি তোমাকে কোনভাবেই ডিজার্ভ করতাম না। তুমি বলতে তুমি নাকি আমাকে গুছিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছো। আমিও আবেগে পড়ে সেটাকে সায় দিয়ে দিলাম। তোমার জীবনটা আরো সুন্দর হতে পারতো রুপা। যাক ঠিক আছে আর বলবোনা। ইতিমধ্যে এসব বলে অনেক বকা শুনছি তোমার।
আচ্ছা তোমার মনে আছে, আমরা যখন প্রেম করতাম আমি তোমার কোলে শুয়ে স্বপ্ন দেখতাম আমাদের দোতলা একটা বাড়ি থাকবে? মনে আছে আর অমনি তুমি বাড়ির ভেতর সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে যেতে? “এইটা এইখানে থাকবে, ওইটা কিন্তু সেখানে থাকবে।” আমাকে খুব শাসানি দিতা, “এইগুলাতে হাত দিবানা। এই সাইডে এইটা থাকবে, ওই সাইডে ওইটা থাকবে।” আমি যেন এইটা না করি ওইটা না করি। আরো কতো কি। হাহাহা।
তখন ভাবতাম আহা স্বপ্ন কতো সুন্দর! বাস্তবতাটা কত মধুর হবে ভাবলেই ঘা কাটা দিয়ে উঠে। তখন ধাক্কা দিয়ে আবার বাস্তবতায় আনতা। আবারো বলতাম আমাদের বাড়িটা পূর্ব পশ্চিমমূখী এঙ্গেল হবে। তখনি লাফ দিয়ে বলতে, “শোনো শোনো শোনো বারান্দা কিন্তু বড় করে দিবা একটা পূর্ব দিকে সামনে আর আরেকটা পশ্চিম দিকে পেছনে। আমি সামনের বারান্দায় ফুল চাষ করবো। অর্কিড ফুল। পশ্চিম দিকে যে বারান্দা থাকবে সেখানে শীতের বিকেলে গোধূলি বেলায় দুজন বসে কফি খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখবো। সেখানেও ফুলের গাছ থাকবে। মজা হবেনা?” আমি মনে মনে হাসতাম, এতো কিছু সুন্দর করে ভাবনা কখনো হয় নি। কোন রকম ঘা হেলানোর মতো যায়গায় বেড়ে উঠা এই আমি না জানারই কথা। তাও কল্পনায় চলে যেতাম আর দেখতাম অসম্ভব সুন্দর সে মূহুর্ত। অপেক্ষা করতাম।
আমার প্রতিটি স্বপ্ন এভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে, আমার গেয়ো কল্প শক্তিটাকে তুমি খুব রোমান্টিক আকৃতি দিয়েছিলে রুপা। তারপর এক বসন্তের সন্ধ্যায় আমার হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিলে। উফ!! তোমার বাবা কী দৌড়ানিটাই না দিয়েছিলো! শান্তিতে বাসর রাতও হয়নাই। এই আচ্ছা, আমাদের বাসর রাত হয়েছিলো? দেখো মনেই নাই। এভাবে এভাবেই কেটে গেলো, তাইনা? যাইহোক, তারপর তোমার বাবা বলেছিলেন আর তোমায় ফেরাবেননা। তুমিও তোমার বাবার মতোই বলেছিলে আর ফিরবেনা। একটা বস্তির ছেলেকে কেউ এতো ভালবাসে? আমি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
বকা দিচ্ছো তাইনা? হাহাহা। ঘুরে ফিরে যখন পকেট খালি হয়ে গেলো তখন আমার বস্তির কোণেই ফেরা। মাটির উনুনে আগুন ধরাতে কি যে বেগ পেতে হতো তোমার! যে কিনা কিচেনে উকি দেয় নাই জীবনে। তোমার মায়াবী চেহারাটা ধোয়ায় কালো হয়ে যেত রুপা। আমার খুব কষ্ট হতো জানো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম।
তোমার হাতের পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ডিম ভাজিটাও ছিলো আমার জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার। অনেক মজা করে খেতাম আমরা। সারাদিন হন্নে হয়ে চাকুরীর জন্য ঘুরতাম। তুমি ছিলা আমার সমস্ত কৃতকর্মের পূর্ব প্রস্তুতি আর অবশেষ সফলতা। এভাবে কত দিন ছিলাম মনে পড়ছে না। তারপর আস্তে আস্তে ব্যাবসা ধরলাম এটা থেকে ওটা, ধিরে ধিরে ছোট খাটো স্বপ্ন পূরণ করা। ঘরের টুকিটাকি জিনিস কিনা। একসময় বিলাসবহুল স্বপ্ন ভুলে ওগুলোতেই তুমি খুশি ছিলে। আমি কিন্তু ভুলি নাই আমাদের স্বপ্নের বাড়িটার কথা। অবশেষে আমাদের একটা রাজকন্যা আসলো। বাব্বাহ্ ছুঁয়ে দেখতেও দিতা না। আমি খুব কেয়ারলেস তাই, কিন্তু আমিই মেয়ে চাইতাম তুমি চাইতা ছেলে আর এখন! হাহাহা হাসতেছো তাইনা?
শোনো তারপর ব্যবসায় আমার একটু উন্নতি আসলো আল্লাহ আমাদের দিকে সুদৃষ্টি দিয়েছিলেন, আমি বলছিলাম না আমাদের মেয়েটা লক্ষ্মী? এভাবেই আস্তে আস্তে বাসার একটা জমি রাখা। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সেই স্বপ্নের দোতলা বাড়ি। তোমার খুশি আর এক্সাইটমেন্ট ছিলো আমার ভরসা। তিলে তিলে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলাম আমরা। সব কিছুই তোমার জন্য, আজ তুমি পাশে না থাকলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না। নিজের প্রতিই আমার হিংসে হয়, এতো সুখ আর কয়টা প্রেমিকের ভাগ্যে থাকে বলো? আমি অনেক সুখি রুপা। তুমি আমার শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিলে।
কিন্তু নিয়তির এক অদ্ভুত খেলায় আজ আমি তোমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি নিজেও জানতাম না এই ক্যানসারের মতো একটা অসুখ কখন বাধিয়ে ফেলেছি। বড্ড কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। রুপা আমি তোমার মধ্যেই বেঁচে থাকতে চাই। তোমার চোখে গোধূলি বিকেল দেখতে চাই। তোমাতেই বেঁচে থাকবো চিরদিন। জানি কাঁদতেছো, কান্না আমার একদম সহ্য হয়না কিন্তু। চোখ মুছো, এই যে আমি আছিতো। আমি আর পারছি না লিখতে রুপা। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসতেছে। নিজের খেয়াল রাখবা। আমার রাজকন্যাটার যত্ন নিবা। আর বলবা তার আব্বু তারার দেশে গিয়েছে আবার চলে আসবে। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি রুপা।
ইতি,
তোমার আমি।
আজ পনেরো বছরে রুপা এই চিঠিটা কতবার পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। উপরের সবগুলো কথা তার স্বামীর লিখা। কেমন একটা শুন্যতা, শক্তি, হাসি আর ভরসা যেন মিশে একাকার হয়ে আছে এই চিঠিতে। প্রতিবারই চিঠিটা পড়ে একটা চুমু দিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলে, “আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি রবিন।”
বারান্দায় বসে আছে রুপা। অর্কিড ফুলে ছেয়ে গিয়েছে গ্রিলের চারপাশ। দূরে তাকিয়ে দেখছে, গোধূলির আকাশে একটু পরেই সূর্য অস্ত যাবে।