মার্চ মাসের ঝলমলে রৌদ্রজ্জল দিনে জন্ম ছেলেটার। ঠিক একটা গলুমলু টাইপের ছেলে। হৃষ্টপুষ্ট ছেলেটাকে যে কেউ দেখলেই আদর করতে চাইতো। মায়ের কাছে দুধপান ছাড়া সারাটি সময় তার কাটতো বড় বোনের কাছে। গোসল করানো, অন্যান্য খাবার খাওয়ানো,সুন্দর সুন্দর জামা পড়ানোসহ সবকাজ করতেই বোনটা তার শান্তি পেতো আত্মায়। বাসার সবচেয়ে ছোট মানুষ তাই আদরের কমতি নেই যাকে বলে সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো পুত্রধন যার ক্রন্দন কেউ সহ্য করতে পারতোনা আর যার ফিক করে দেয়া হাসিতে সকলের খারাপ মন ভালো হয়ে যেতো।
স্কুলে যাবো স্কুলে যাবো বলে সারা বাড়ী মাথায় তোলা, বয়স চারেক সময়কার তার নিত্যদিনের কাজ। জুতো মুজো পড়ে বই, খাতা, ফ্ল্যাক্স আর টিফিনবক্স ব্যাগে ঢুকিয়ে মা বের হবার আগেই সে দিতো দৌড়। হিজাজ প্রি- ক্যাডেট এন্ড হাই স্কুল, জীবনের প্রথম স্কুলে পদার্পণ।
একদৌড়ে স্কুলে যেয়ে পি.টি.র লাইনে দাঁড়ানো, সূরা ফাতিহা পড়তে সবার আগে সামনে দৌড় দেয়া, হুড়মুড় করে ক্লাসরুমে ঢুকে সামনের বেঞ্চে বসা তার জন্য এক মজার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাকে পড়ানোর জন্য মায়ের তৈরী করা সিস্টেমটা ছিলো একটু ভিন্নরকম। স্কুলের টীচার যা পড়াতো, এরসাথে দু’ চার বই ঘেঁটে মা নোট তৈরী করে দিতো তাকে, সে” দয়া করিয়া “ মুখস্থ করতো।তাকে পড়ানো দেখে অনেকে ঠাট্টা করে তার মাকে বলতো “ ছেলে তো আর পড়েনা, পড়ে আসলে তার মা”। বিকেলে খেলতে গেলে সারাক্ষণ বারান্দার পর্দা অল্প একটু সরিয়ে রেখে ছোট ভাইয়ের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা ছিলো তার বোনের রোজকার সান্ধ্য বিকেলের কাজ। নীচে কোন কিছু করতে হলে উপরে তাকিয়ে কমান্ডার ম্যাডামের ( বোন)নির্দেশ নেয়া লাগতো তার।
সমবয়সী এক খালাতো আর মামাতো ভাইয়ের সাথে সখ্যতা ছিলো তার অনেক বেশী। রুবেল আর সিফাত ছিলো মোটামুটি একপাতে ভাত খাওয়া ভাইয়ের মতো যাদের বাসায় আসা যাওয়াতে ছিলো না কোন বাঁধা ধরা নিয়ম।
ওহ গল্পের সেই ছেলেটার তো কোন নাম দেয়া হয়নি, তাইনা? আচ্ছা, হাসান নাম দেয়া যাক তার( গুণবাচক নাম)।
আইডিয়াল কিন্ডারগার্ডেনে মামাতো ভাইয়ের সাথে ভর্তি হলো সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তার মামাতো ভাই সিফাত ছিলো চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আর সে ছিলো দ্বিতীয় শ্রেণীতে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে তখন বৃত্তি দেবার নিয়ম ছিলো। দিনরাত পড়াশুনা,বাবুল স্যারের কাছে প্রাইভেট, জামান স্যারের কাছে কোচিংয়ে গিয়ে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হাসান। দূর্দান্ত রেজাল্ট করে বেরিয়ে আসলো স্কুল থেকে। সিফাত ছিলো বড্ড পড়ুয়া আরেক মানুষ যার রুমের দরজায় সবসময় একটা নোটিশ টাঙানো থাকতো যেটাতে লেখা থাকতো “ পরীক্ষা চলছে, ডিস্টার্ব করিবেন না”। ভাইটা ডেন্টিস্ট হয়ে বিসিএস পরীক্ষাও দিয়েছে,এক প্রাইভেট ক্লিনিকে জয়েনও করেছে।
আর সেই খালাতো ভাই রুবেল, খেলা পাগল একটা মানুষ,সুযোগ পেলেই খেলতে দিতো দৌড়।তুখোড় মেধাবী ছেলেটা হারুন নামক এক স্যারের কাছে সেই ছোটকাল থেকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত পড়েছিলো। ক্লাসে সবসময় ফার্ষ্ট হওয়া, ক্যাডেট কলেজ শেষে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সে আজ পুরোদস্তুর এক শিক্ষিত বাবু হয়ে গেছে। হঠাৎ পরিবর্তন। হাসান আর সিফাতকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয় তাদের বাবা -মা,স্বপ্ন আলেম হবে তাদের সন্তান। মাদ্রাসাটা তৎকালীন সময়ে একটু ভিন্ন ধাঁচে গড়া যেখানে ছাত্রদেরকে এরাবিক সাবজেক্টের সাথে সাথে জেনারেল কারিকুলাম ফলো করেও পড়ানো হতো। দাখিল,আলিম পরীক্ষা দেয়া যেতো অর্থ্যাৎ এখনকার ক্যাডেট মাদ্রাসার মতো ছিলো। সিফাত আর হাসান পড়তে শুরু করলো। হাফেজী কোরআন হতে হবে তাদের।দু’ চোখে স্বপ্ন দেখতেন বাবা- মায়েরা, ভাই – বোন সহ সকল শিক্ষকেরাও। মাদ্রাসাতে তখন হাফেজী পড়াটা আবশ্যক ছিলো সবারই জন্য।
হাসান ছিলো অত্যধিক দুষ্টু। হেন আজাইড়া কাজ নাই যার লিষ্টে তার নাম নাই। ধুম করে কারো পিঠে কিল বসিয়ে সারা মাদ্রাসা জুড়ে দৌড়ানো, শেষমেশ অন্যকে ধরিয়ে দিয়ে নিজে হুজুরের পিটানো থেকে বাঁচা, খেলতে গিয়ে চুলের বাহারি স্টাইল করা ইত্যাদি ইত্যাদি তার ছিলো নিত্য দিনের কাজ। আর সিফাত? নাদুসনুদুস ছেলেটা সারাদিন শুধু পড়তো। তানজিম, সাকিব, সাদেক, মাহমুদ পেত্নী, সাজিদ, সাকিব, ফরহাদ,আব্দুস শাকুর অনেক পোলাপান ছিলো তাদের বন্ধু। তানজিমের সাথে খাতির ছিলো বেশি হাসানের। ওহ হো গাজী ওরফে পাজির কথা তো না বললেই নয় যার তানজিম, হাসানের সাথেই বেশি সখ্যতা ছিলো। যাই হোক, হাসিব আর হাসান হাফেজী পড়তো এক হুজুরের কাছে আর সিফাত পড়তো আব্দুস সালাম হুজুরের কাছে।
হাফেজীর সাথে সাথে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ফেললো তারা সবাই। হেফজ করা শেষ। হাফেজ অমুক আর তমুক তাদের নাম। একত্রে সিফাত আর হাসানের পড়াশুনার এখানেই সমাপ্তি। সিফাত থেকে গেলো সেখানেই আর হাসান ভর্তি হলো ক্বওমী মাদ্রাসায়, আলেম হতে হবে না? পড়াশুনা, হইহুল্লোড় আর দুষ্টুমি করেই দিন কেটে যেতো হাসানের। ছাত্র হিসেবে ছিলো সে মোটামুটি তবে হুজুরের চোখে চোখে থাকতে হতো সারাক্ষণ তার,দুষ্টু বলে কথা। ক্লাসের পর ক্লাস পেরিয়ে হুট করে তার ভগ্নিপতি আর বড় ভাইয়ের অনুরোধে দাখিল পরীক্ষা দিতে হবে তার। দাখিল হচ্ছে এসএসসি সমমানের পরীক্ষা।
এদিকে মাদ্রাসার পড়া আর ওদিকে দাখিলের প্রস্তুতি, নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়লো তাকে। শেষমেশ এ- প্লাস পেয়েই শেষ করলো তার দাখিল পর্ব। তার দুই বছর পর দাওরায়ে হাদীস ক্লাস শেষ করে মাদ্রাসা লাইনে স্বাভাবিক ধারার পড়া শেষ করলো হাসান। হুট করে বড় ভাইয়ের বহু অনুরোধে মাদ্রাসায় পড়ার পাশাপাশি কলেজেও এডমিট করানো হলো তাকে। “ দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার হে “ অবস্থা আরো ভয়াবহ। কলেজ শেষে ভার্সিটিতে পড়া। আইনবিদ হবার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
ডেন্টিস্ট সিফাত। ইঞ্জিনিয়ার রুবেল। হবু ইমাম+রাজনীতিবিদ + আইনবিদ হবার স্বপ্নে বিভোর হাসান এগিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্ন পূরণে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ যেন জেঁকে বসছে তার উপর। ছোট কোন অসুখ নয়, সব বড় বড় অসুখ। দু’ চোখ ভরা স্বপ্ন তার যেটাকে কর্মে বাস্তবায়ন করা তার ইচ্ছা। দেশের সার্বিক পরিবর্তনে একদল নিষ্ঠাবান মানুষকে কাছে পাওয়া তার স্বপ্ন। মিথ্যাকে পর্যদুস্থ করত সত্যের পতাকাবাহী হওয়া যার স্বপ্ন। এগিয়ে যাচ্ছে সে সম্মুখপানে,স্বপ্ন পূরণে।