সারপ্রাইজ

সারপ্রাইজ

সকাল থেকেই কেমন জানি মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করছে। আচ্ছা এই ভালোলাগার উৎস কোথায়?কেনো ভালোলাগা কাজ করছে? নাকি টিউশনির টাকা হাতে পাবো সেই কারনে? হতে পারে যান্ত্রিক শহুর গুলো বড়-ই অদ্ভুত। আশেপাশে কে কি করছে সেদিকে কারোর-ই কোন খেয়াল নেই। সবাই যার যার নিজের কাজে ব্যস্ত। এতটা খামখেয়ালি হলে হয়? একটুতো লক্ষ রাখা উচিৎ যে চারপাশে কি হচ্ছে তাইনা? টিউশনির টাকাটা আজকে দেওয়ার কথা। তাই কেমন জানি একটু ভালো লাগছে। সামনে ঈদ। আজকে সকালে বাসা থেকে আব্বা ফোন করছিলো….

-কেমন আছিস বাবা?
–এইতো ভালো,তোমরা কেমন আছো?
-আমরা ভালো আছি,কিন্তু নিরার (আমার ছোট বোন) শরীরটা একটু খারাপ।
–কেনো,ওর আবার কি হলো?
-কি জানি,ডাঃ বলেছে জ্বর হয়েছে। ঔষধ খেলে ঠিক হবে।
–আচ্ছা ওকে একটু দাওতো….
-ভাইয়া তুমি পচা। (অভিমানী কণ্ঠে)
–ওরে বাবা তাই…তা আমি কি করলাম মহারাণী?
-খবরদার আমাকে মহারাণী বলবানা।

–আচ্ছা বলবনা,সরি। কি হয়েছেগো আমার ছোট আপুর?
-ভাইয়া একটা কথা বলবো?
–বলো মহারাণী, থুক্কু আপু….
-ভাইয়া ঢাকা নাকি খুব সুন্দর সুন্দর জামা পাওয়া যায়। আমার জন্য লাল টুকটুকে একটা জামা নিয়ে আসবা?
–অবশ্যই আনবো। আমার ছোট্ট আপু বলে কথা।
-ভাইয়া আরেকটা কথা। মার জন্য একটা শাড়ী আর আব্বার জন্য সুন্দর একটা পাঞ্জাবী আনবা হ্যা….?
–আচ্ছা আনবোগো, খুশি এখন?
-হুমম অন্নেক,,এইনা আমার ভাইয়া উম্মাহ।

আপনজন গুলো যখন কোন আবদার করে তখন খুব ভালো লাগে। কিন্তু কষ্টটা তখন-ই লাগে যখন তাদের আবদার পূরণ করতে আমরা ব্যর্থ হই। টিউশনির টাকাটা হাতে পেলাম। খুব ভালো লাগছে। ভালোলাগাটা একটু বেশিই কেননা আজ মনে হয় প্রিয়জনদের আবদার গুলো পূরণ করতে পারবো। যাইহোক আমি হাটছি,উদ্দেশ্য হোটেল। অনেক দিন ভালো খাবার খাওয়া হয়না। ঠিক তখন-ই জান্নাতের (আমার বেস্ট ফ্রেন্ড) ফোন….

-রুবেল কই তুই?
–এইতো রাস্তা আছি। কিছু বলবি?
-হুমম আমার সাথে দেখা কর।
–তুই কোথায়?
-আমি এখন আছি বসুন্ধরা রেস্টুরেন্টের কাছে।
–আচ্ছা তুই দাড়া আমি আসছি।

ভার্সিটি ১ম বর্ষ থেকে পরিচয় আমার আর জান্নাতের। প্রথমে টুকটাক কথা, তারপর আস্তে আস্তে বেস্ট ফ্রেন্ড। জান্নাতেরর বাবা এই শহুরের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। বলতে গেলে জান্নাত কোটিপতি বাবার একমাত্র সন্তান। তবে জান্নাত খুবই সাধারণ। চলে আসলাম জান্নাতেরর কাছে। নীল শাড়ী,সাথে ম্যাচিং করে নীল চুড়ি, হালকা লিপস্টিক জান্নাতকে দেখতে একদম পরীর মতো লাগছে।

-কিরে হাদারাম কি দেখছিস এমন করে? জান্নাতেরর ডাকে হুস ফিরলো আমার….
–ন..না..মানে তোকে…
-আমাকে মানে,কি ?(ভ্র কুচকে)
–না মানে তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
-আমাকেতো প্রতিদিনই দেখোস, তখনতো বলতিস না। তাহলে আজ কেনো বলছিস?
–আসলে শাড়ীতে তোকে এই প্রথম দেখলামতো তাই বললাম।
-হয়েছে আর বলতে হবেনা।
–আসলেই তোকে খুব সুন্দর লাগছে।
-চলতো এখন, মেয়ে দেখলেই পটানোর ধান্ধা তাইনা?(মুচকি হাসি)
–সাথের টাকেই এখনও পটাতে পারলাম না।
-কিছু বললি?
–না।

-আচ্ছা চল?
–কোথায়?
-কোথায় মানে, আজকে তুই আমায় ট্রিট দিবি।
–ট্রিট মানে,কিসের ট্রিট?(অবাক হয়ে)
-কেনো তোর মনে নেই, তুই যে বললি টিউশনির টাকা পেলে আমায় ট্রিট দিবি?
–ও হ্যা….(আজকে যে কত টাকা যাবে তাই ভাবছি?
-কি হলো চল?
–কোথায়?
-আজবতো,রেস্টুরেন্টে।
–রেস্টুরেন্ট বাদদে(কারন সেখানে টাকা বেশি লাগবে)। চল আমার পরিচিত এক হোটেল আছে।
-চুপ কর তুই….

তারপর জান্নাত একপ্রকার টানতে টানতে নিয়ে গেলো আমায় রেস্টুরেন্টে। এই প্রথম মেয়েটি আমার কাছে কিছু চাচ্ছে, না দিয়ে পারি? এর আগে সবসময় জান্নাত আমাকে খাইয়েছে। আর আমিতো ওর দিক থেকে অনেক নিম্নের।
তারপর ওর মনমতো অর্ডার করলো। এমন অর্ডার করলো যেগুলোর নাম-ই আমি জীবনে শুনিনাই। জান্নাত খুব মজা করে খাচ্ছে। আমি খেতে পারছিনা। খাবার আটকে আসছে। জান্নাত বলল….

-তোর টাকার খাবারতো খুব মজাররে…আহ কিযে স্বাদ। আমি বললাম….
–আচ্ছা জান্নাত এই সব খাবারের বিল কত হবে? ও খাবার খেতে খেতে বলল…
-কত-ই আর হবে। ১২০০/১৩০০ তো হবেই।

আমি ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যেখানে আমার একমাসের হাত খরচ-ই এত লাগেনা আর সামন্য এক বেলা খেয়েই আমি আর জান্নাত রিকশায় বসা। ও বকবক করে কথা বলছে আর আমি ভাবছি আমার ছোট বোনটার কথা। ওর আবদারের কথা। জান্নাতের ডাকে হুস ফিরলো….

-কিরে কি ভাবছিস?
–কিছুনা, আচ্ছা আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
-শপিং এ।
–শপিং এ কেনো?
-হারামি শপিং এ মানুষ কি জন্য যায় জানিসনা?

আমি আর কোন কথা বললাম না। রিকশায় বসে বসে ভাবছি শালার টাকা মনে হয় সব গেলো। কোন দুঃখে যে ট্রিটের কথা বলছিলাম। এখনসে মজা বুঝতেছি। আমরা দুই জন আছি শপিং সেন্টারে। জান্নাত আমাকে বলল….

-তোর কাছে কত টাকা আছে?
–আছে কিছু।
-হ্যাংলামি বাদ দিয়ে কত আছে তাই বল…?
–৯৬০০ টাকা।
-আচ্ছা এতেই চলবে।

তারপর জান্নাত দোকানদারকে একটা শাড়ি দিতে বলল। দোকানি জান্নাতের কথা মতো অনেক প্রকার শাড়ী বের করলো।

-দেখতো এই শাড়ীটা কেমন?
–ভালোই,তোকে বেশ মানাবে।
-তাই নাকি?…(মুচকি হাসি) আমি বললার….
–জান্নাত আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি।
-আচ্ছা যা…আবার টাকা দেয়ার ভয়ে পালিয়ে যাসনা। হিহিহি…

আমি চলে আসলাম। কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে। শুধু ছোটবোনটার কথা মনে হচ্ছে। বাথরুমে এসে মুখটা একটু ধুলাম। অনেক্ষন পর স্বাভাবিক হয়ে জান্নাতের কাছে গেলাম।

-এতক্ষণ সময় লাগে তোর আসতে? আমি ভাবলাম পালিয়েই গেলি নাকি আবার। হিহিহি….
–হয়েছে তোর শপিং?
-হুমমম এখন বিলটা দে।
–আমি দিবো?
-হারামি তুই দিবিনাতো কে দিবে শুনি? আমার কি বর আছে যে সে এসে দিয়ে যাবে? দোটানায় পরে গেছি। বিল না দিয়েও পারছিনা।

–কত টাকা বিল হয়েছে?
-সব গুলো দে।
–মানে?
-মানে বিল ৯৫০০ টাকাই হইছে আমি পকেট থেকে টাকা বের করলাম।
-কি হলো দে? আমি টাকা দিলাম। মুখটা মলিন হয়ে গেলো। জান্নাতের মুখে হাসি। ও বলল….
-কি হলো মুখটা ওমন প্যাচার মতো করে আছিস কেনো।
–কিছুনা এমনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে চল….

আমি আর জান্নাত রিকশায় বসা। জান্নাতের হাতে তিনটা শপিং ব্যাগ। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও খুব খুশি। আমি ওর দেখাদেখি কৃত্রিম হাসি দিচ্ছি। যার কোন অর্থ নেই। জান্নাত বলল….

-দেখবিনা,কি কি শপিং করলাম?
–দেখে কি করবো। শপিং তো তোর এখানে আমার দেখার কি আছে?
-ও হ্যা তাইতো,,তোর আবার কি। রিকশা থেকে দুজনেই নামলাম। রিকশা বিলটা জান্নাত-ই দিলো। তারপর বলল….
-রুবেল তুই এমন কেনো?
–কেমন?
-তুই যে খুব বোকা সেটা কি তুই জানিস?
–নাহহ,তোর কাছে শুনলাম।
-আচ্ছা রুবেল আমাকে তোর কেমন লাগে?
–কেমন মানে?
-মানে কেমন লাগে?
–কেমন আবার ভালোই।
-শুধু ভালো।
–আচ্ছা তুই কি বলত চাচ্ছিস, সেটা একটু ক্লিয়ারলি বলতো?

জান্নাত আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কিছু বলছেনা। ওর চোখে পানি। আমি অনেকটা অবাক হলাম। বললাম….

–কিরে কি হয়েছো, তোর চোখে পানি কেনো? কি হলো তোর?
-রুবেল তুই আমায় ভালোবাসিস? জান্নাতের আচমকা এমন কথা শুনে অনেকটা অবাক হলাম। কি বলব বুঝতে পারছিনা। তবুও বললাম….
–তুই কি বলছিস এসব?
-দেখ রুবেল আমি হেয়ালি পছন্দ করিনা। আমার কথার উত্তর দে?
–আসলে (বলতে পারলাম না।) জান্নাত শপিং ব্যাগ গুলো আমাকে দিলো তারপর বলল….

-এখানে দুইটা শাড়ি, একটা আমার আরেকটা আমার শাশুড়ির মানে তোর মায়ের। আর এই ব্যাগে দুইটা পাঞ্জাবী আছে। একটা আমার শশুড়ের আরেকটা আমার স্বামীর। আর এই ব্যাগে লাল টুকটুকে দুইটা জামা আছে দুইটাই আমার ছোট বোনের। ভাবছিস আমার আবার বোন আসলো কই থেকে। গাধা তোর বোন বুঝি আমার বোননা?

–(আমি নীরব)

-আচ্ছা তুই কি কিচ্ছু বুঝিসনা। তোর সাথে আমার থাকতে ভালো লাগে, তোর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, এগুলো তুই বুঝিসনা। তুই কি অবুঝ? তুইতো অবুঝনা, তুই হলি হাদারাম,গাধা। আর হ্যা শোন আমি অতো কথা প্যাচাতে পারবোনা, আমি তোকে ভালোবাসি। আর এর উত্তর এখননা…মেসে গিয়ে সুন্দর করে একটা ঘুম দিবি। তারপর ভাববি,ভেবে উত্তর দিবি। তবে না করা যাবেনা নইলে ঘুষি মেরে তোর নাক ফাটিয়ে দিবো হুউউউউ আমি চলি।

এই বলে জান্নাত হনহন করে চলে গেলো। আর আমি মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছি। কি হলো কিছুই বুঝতে পারছিনা। এখনও ঘোরের মধ্যে আছি। মনে হয় স্বপ্ন দেখতেছি। প্রকৃতি মানুষকে হঠাৎ হঠাৎ কিছু সারপ্রাইজ দেও। যে সারপ্রাইজ গুলা আমরা কখন-ই আশা করিনা। আচ্ছা আমারটা তাহলে কি? সারপ্রাইজ হবে? নাকি স্বপ্ন হবে? কি জানি…..

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত