তখন ক্লাস থ্রি’তে পড়ি। স্কুলে যেয়ে হঠাত একদিন এক ছেলের কোমরে আমার চোখ আটকে গেল। সেদিন ছেলেটা নীল রঙের একটা হাফপ্যান্ট পড়ে আসছে। নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর সাদা হাফশার্টে ছেলেটাকে দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটির পড়নে যে হাফপ্যান্ট’টা সেটা আসলে কাপড় নাকি অন্যকিছু দিয়ে তৈরি। আমি কিছু না বলে যথেষ্ট কৌতুহল নিয়ে ছেলেটার কোমরের সামনের দিকে হাত বাড়ালাম। সে কি বুঝলো জানিনা আমার হাতের ছোঁয়া লাগার আগেই চিৎকার করে অসভ্য বলে গালি দিয়ে চলে গেল। গালি দিয়ে গেল সেদিকে আমার খেয়ালই নেই।
আমি একদৃষ্টিতে ছেলেটার হাফপ্যান্টের দিকে তাঁকিয়ে রইলাম। দুই পাশে দুইটা পকেট। পিছনেও দুইটা পকেট। সামনে পকেটের দরজায় আরও ছোট ছোট দুইটা পকেট। প্রতি পকেটের উপর কি যেন লেখা। লেখাগুলো দেখতে অনেকটা উল্টা প্যাঁচের জিলাপির মত। শুধু তাই নয় সেইসাথে প্রতি পকেটে সোনার মত কি যেন একটা করে ঝলমল করতেছে। নিচের অংশে আবার বিড়ালের লোমের মত লোম ও বেরিয়ে আছে। পেট পর্যন্ত শার্টের অংশ প্যান্টের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে প্যান্ট’টা যেন সম্পূর্ণ দেখা যায় সেই জন্যই বোধয় ওর মা ওইভাবে প্যান্ট পড়িয়ে দিয়েছে। আর ছেলেটাকেও দেখতে বিড়াল ছানার মতই কিউট লাগছিলো। এর আগে এমন প্যান্ট আমাদের গ্রামে কখনো কাউকে পড়তে দেখিনি তাই মোটামুটি ভিমড়ি খেয়ে গেলাম।
ক্লাসে কিছুতেই মন বসতে ছিলনা। ছেলেটাও আমাদের ক্লাসেই পড়ে কিন্তু সেরকম কথাবার্তা হয়নি কখনো। আমি সব সময় সামনের বেঞ্চে বসি কিন্তু সেদিন একটা ক্লাস করেই পিছনে যেয়ে ছেলেটার সাথে বসলাম। ছেলেটা আমাকে দেখেই আবার অসভ্য বললো। আমি তখনো কিছুই বুঝলাম না। সুযোগ বুঝে ক্লাসের এক ফাঁকে পকেটমারের মত আস্তে করে সে যেন টের না পায় এমন অবস্থায় ছেলেটার প্যান্টে হাত দিলাম। হাত দিয়ে আমার মাথা চক্কর দেওয়ার উপক্রম হয়ে গেল।
এটা তো দেখি কাপড় না কিন্তু কি সেটাও বুঝতেছিলাম না। আমার মত আরও অনেক ছেলেই সেদিন ওই ছেলের প্যান্ট দেখে ভিমড়ি খেয়েছিল। পরে অবশ্য ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারছিলাম ওটার নাম নাকি “ইংলিশ প্যান্ট “। নাম শুনেই কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলাম। সত্যিকথা বলতে সেদিন থেকে ওই ছেলেকে ভয় পেতাম। একেতে ধনীর ঘরের ছেলে তার উপর ইংলিশ প্যান্ট পড়ে স্কুলে আসে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভয় বেশিদিন থাকলো না। আজ এই ছেলে ইংলিশ প্যান্ট পড়ে আসছে। কাল ওই ছেলে ইংলিশ প্যান্ট পড়ে আসছে এভাবে অনেক ছেলের পড়নেই তখন ইংলিশ প্যান্ট। আমার পড়নে তখনো সুতি কাপড়ের দর্জি দিয়ে সেলাই করানো কুচি দেওয়া হাফপ্যান্ট।
যেহেতু সবার পড়নেই ইংলিশ প্যান্ট আমিও একদিন স্কুল থেকে যেয়ে বাবার কাছে আবদার করলাম আজকেই যেন আমাকে একটা ইংলিশ প্যান্ট কিনে দেওয়া হয়। নয়তো আমি আর স্কুলেই যাবো না। বাবা তো প্যান্টের নাম শুনেই যা তা অবস্থা। ইংলিশ প্যান্ট কিনতে অনেক টাকা লাগবে যেইটা আছে সেইটা পড়েই স্কুলে যেতে থাক বাবা। বাজার করারই টাকা নাই এখন ইংলিশ প্যান্ট কিনা সম্ভব নয় বাবা। ঈদের সময় কিনে দিবো রাগ করিস না বাবা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমিও নাছোড়বান্দা, যা তা অবস্থাকে হ্যাঁ না ব্যবস্থা করার জন্য পড়নের হাফপ্যান্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠানের মাঝখানে খাঁটি বাংলায় কিছু গালাগালির পাশাপাশি গড়াগড়ি দেওয়া শুরু করলাম। উপায় অন্ত বেগতিক দেখে বাবা রাজি হলেন এবং সেই দিনই ইংলিশ প্যান্ট কিনে আনলেন। বাবা কি করে যেন ঠিক ওই ছেলের হাফপ্যান্টের মতই আমার প্যান্ট’টাও কিনে অানে। খুশির আতিশয্যে রাতের বেলায় বই পড়া বাদ দিয়ে ছালার চটের চেয়েও মোটা কাপড়ের ইংলিশ প্যান্ট পড়ে এবাড়ি সেবাড়ি দুইটা চক্কর দিয়ে ভাব দেখিয়ে আসলাম। পরেরদিন থেকে আমিও স্কুলে হয়ে গেলাম ইংলিশ বয়।
এরপর সাধু সন্ন্যাসীর মত হঠাত করে আরেকদিন আরেক ছেলের পড়নে, আবার একই কাহিনী। এবার আর হাফপ্যান্ট নয় এবার একদম ফুলপ্যান্ট পড়া ফুল বাবুর আগমন। সেই প্যান্টের নাম জানতে পারলাম “জিন্সপ্যান্ট”। কিছুদিনের মধ্যে সেটাও সয়লাব হয়ে গেল। আমি ও একদিন বাড়িতে যেয়ে আবার আগের নাটক করে বাবাকে আটক করলাম। সেদিন অবশ্য পড়নের প্যান্ট খুলিনি। প্যান্ট পড়েই গড়াগড়ি দিয়েছিলাম।
প্রাইমারি শেষ করে যখন হাইস্কুলে গেলাম তখন সবাইকে ফুল প্যান্ট পড়তে হয়। স্কুলের নিয়ম অনুসারে স্কুলের দেওয়া নির্ধারিত রঙ এবং ডিজাইনের শার্ট প্যান্ট পড়ে স্কুলে যেতে হবে। সবই ঠিক ছিল কিন্তু জিন্সপ্যান্টের রঙ স্কুল থেকে যে রঙ এবং ডিজাইন নির্ধারণ করেছে সেটার সাথে না মিলায় আমি সহ সবার সাধের জিন্সপ্যান্ট পড়া বাদ হয়ে গেল। আবার সেই দর্জির সেলাই করা প্যান্ট। তবে এবার আর সুতি কাপড়ের কুচি দেওয়া হাফপ্যান্ট নয়। এবার যে ফুলপ্যান্ট সেটা জিন্সের প্যান্টের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এভাবেই আস্তে আস্তে প্যান্ট পড়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। স্কুলে যেতেও প্যান্ট, খেলাধুলা করতে গেলেও প্যান্ট, বাড়িতে থাকা অবস্থাতেও প্যান্ট।
সেইসব দিন এখন অনেক দূরের অতীত। প্রথমে দেখে এবং নাম শুনেই ভয় পেলাম। তারপর পড়তে পড়তে অভ্যস্ত হলাম। এরপর তার আসল স্বাদ যখন পাওয়া শুরু করলাম তখন আমরা সভ্যের আগে “সু” এর বদলে “অ” লাগিয়ে নিয়েছি। এটা আসলে পোশাককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ আমাদের শিক্ষার এবং নৈতিকতার। এসব বিদেশী পোশাক আমাদেরকে বিশ্ব দরবারে সুসভ্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই সভ্যতাটা ওই থ্রি’ক্লাসের ছেলেটার গালিকে বাস্তবায়ন করতে আমরা একটুও পিছপা হইনি।
আমরা এতবেশি সুসভ্য হয়ে গেছি যার প্রতিফলন আমাদের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আজ প্রতীয়মান। শত শত বিদেশি কালচার আমরা এখন অনুসরণ করি। কিন্তু যেটা অনুসরণ করতেছি সেটা করতে যেয়ে আমাদের পরিণাম কোথায় যেয়ে পৌঁছেছে সেইদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করিনা। সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু ছেলেদের ইংলিশ বলুন আর জিন্স বলুন এই প্যান্ট নিয়ে যদি বলি তাহলে বলতে হয় এই বিদেশি পোশাক পাওয়াটা আমাদের অত্যন্ত দরকারি ছিল। সেটা পেয়ে আমাদের অত্যন্ত উপকার হয়েছে। যেখানে আমাদের উপকৃত হওয়ার কথা সেইটা আমরা নিজেরাই হিতে বিপরীত করতেছি। উপকার যেটুকু হয়েছে সেটুকু আমাদের সানন্দে গ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে আমরা উপকারের ঘাড়ে পা রেখে নিজেদের মুণ্ডু মুড়িয়ে দিতেছি। আজকে রাস্তায় বের হলে কিছু কিছু আধুনিকমনা শিক্ষিত ছেলেদের কুকর্ম দেখে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে। একটা কুকুর যখন প্রস্রাব করে তখন এক পা উপরের দিকে উঁচিয়ে দেয়।
পা উঁচিয়ে প্রস্রাব করার কারণ তার শরীরে যেন সেইটা না লাগে। সৃষ্টিকর্তা সেরকমভাবে প্রস্রাব করা কুকুরের জন্য নিয়ম করে দিয়েছেন তাই কুকুর সেইভাবে প্রস্রাব করে। শুধু তাই নয়। কুকুর যেখানে সেখানে প্রস্রাব করেনা। একবার যেখানে করেছে কিংবা অন্যকুকুরে করে গেছে সেখানে প্রস্রাব করে। রাস্তা দিয়ে চলার সময় দেখবেন কুকুর চলতে চলতে হঠাত করে গাছের গুড়ি শুঁকতেছে আর ছুটে চলছে। যেখানে তাদের প্রস্রাবের গন্ধ নেই সেখানে সে প্রস্রাব করেনা। যেই গন্ধ পেয়ে যায় সেখানে সে প্রস্রাব করার কাজ সেরে ফেলে। অনেকে বলে পথ চিনে রাখার জন্য কুকুর এরকম করে। তাই যদি হয়, কুকুর যদি পথ চিনে রাখার জন্য এরকম করে তাহলে আমাদের মানুষ হিসেবে প্রস্রাব করার জায়গাটা চিনে রাখা প্রয়োজন নয় কি?
আফসোস একজন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষিত “মানুষ” হয়ে রাস্তার পাশে যেখানে ইচ্ছা সেখানে শত শত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে। অথচ এরাই সকল সৃষ্টির সেরা মানুষ যাকে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে সিজদা করিয়েছেন। অন্যসব জাতির কথা বাদ দিলাম। একজন মুসলিম ঘরের সন্তান হওয়ার পরও, একজন উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরও এরা কিভাবে এই কাজটা করতে পারে সেটা মাথায় আসেনা। আল্লাহ মুসলিমদের জন্য তাদের জীবন ব্যবস্থা কি রকম হতে হবে তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পবিত্র আল-কোরঅান’এ পুরোপুরিভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। এসব মূর্খদের জানার কথা নয়। যারা শিক্ষিত তারাই জানতে পারবে তাদের কিভাবে চলতে হবে, কি করতে হবে, কি পরিহার করতে হবে। কিন্তু এরা কি ধরনের শিক্ষিত? এদের শিক্ষার শিখাটা কোথায়? এদের শিক্ষার কাজটা কি? এদের শিক্ষিত তো দূরে থাক এদের মানুষ বললেও কুকুরকে অপমান করা হবে। এরা কুকুরের চাইতে ও নিকৃষ্ট। কুকুর ও নিয়ম মেনে চলে কিন্তু এরা নিয়ম মেনে চলেনা।
রাস্তার পাশে এরকম দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে দেখলে লজ্জা ভুলে জিজ্ঞেস করে দেখবেন ভাই দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলেন কেন? দেখবেন কেউ মাথানিচু করে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ বুক ফুলিয়ে উত্তর দিবে, ভাই জিন্সের প্যান্ট পড়ে বসা যায়না। যত দোষ তখন ওই ইংলিশ প্যান্টের। পারলে ওর পশ্চাৎদেশে সজোরে একটা লাথি মেরে দিবেন। (এখন বলবেন আপনি করেন?) হ্যাঁ আমি পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে এটা করতে না পারলেও প্রশ্ন করতে ছাড় দিইনা। পরিচিত কেউ হলে ওর জন্য লাথি মঞ্জুর একশোভাগ। ওরা আসলে মিথ্যা কথা বলে। ওদের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেছে। সালাত আদায় করতে যেভাবে হাটুভেঙে বসতে হয় তার চেয়ে সুচারুভাবে আর কোনো কাজের জন্য বসার প্রয়োজন হয়না। জিন্সের প্যান্ট পড়ে অনায়াসে সালাত আদায় করা যায়, আমি করি। ওরা নিজেদের যতই শিক্ষিত দাবী করুক ওরা আসলে মূর্খের চেয়েও মূর্খ।
একটা মূর্খ লোককে কখনো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে দেখা যায়না। এসব শিক্ষিত নামক মূর্খ, অসভ্য জানোয়ারের দলের জন্য আজকে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পঁচন ধরে গেছে। একজন সুশিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে সু কাজ, সুচিন্তা, সু ভাবনা, সু শিক্ষা আশা করা যায়। কিন্তু কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট এসব শিক্ষিতদের কাছে থেকে ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায়না। ওরা ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ তথা পুরো জাতী ধ্বংসকারী। প্রস্রাব করার অন্যান্য নিয়মনীতি অনেক দূরে রাখুন। আগে অন্তত লাথি মেরে হলেও ওদেরকে বসে প্রস্রাব করা শিখানো উচিত। অন্তত প্রস্রাব করা শিখে ওরা নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবী করুক। যে সঠিকভাবে প্রস্রাবই করতে জানেনা সে ভালো কিছু জন্ম দিবে কিভাবে আর সে শিক্ষাটাই গ্রহণ করলো কি??
আধুনিক নামিদামী পোশাক পড়ে ওরা মর্ডান, সুসভ্য, শিক্ষিত, দামী মানুষ হয়ে গেছে। আরে ভাই দামী পোশাক পড়লেই যদি দামী মানুষ হওয়া যেতো তাহলে অশিক্ষিত মূর্খ একটা মেথর ছেলে আর আপনার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকতো না। একটা মেথর ছেলেও অনেক ক্ষেত্রে আপনার চেয়ে দামী দামী শার্ট প্যান্ট পড়ে। মিছামিছি পোশাককে দায়ী করে নিজেকে আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ করবেননা। আপনারা শিক্ষিত মানুষ। আপনারা পথহারাদের পথ দেখাবেন। দেশ ও জাতি আপনাদের দেখানো পথে এগিয়ে যাবে। আপনারা আগে সঠিক পথে ফিরে আসুন। তারপর দেশ ও জাতির পথ প্রদর্শক সাজুন।
প্রস্রাবের কথা তুলে ধরার কারণ এটাই দুনিয়াতে এরচেয়ে সহজ আর কোনো কাজ নেই। অথচ এই সহজ কাজটা যদি সঠিকভাবে আমরা না করতে পারি তাহলে জীবনের শতশত গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন কাজগুলোই বা কতটা সঠিক হবে? কিভাবে আসবে আমাদের সফলতা? পার্থিব সফলতার কথাও নাহয় বাদই দিলাম। নিজের আত্মশুদ্ধিই যদি না হলো কি হবে এই ঘুণে ধরা শিক্ষা দিয়ে?