অস্পষ্ট অনুভূতি

অস্পষ্ট অনুভূতি

ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে হাসি পেলে, ২ঘন্টা আগে চলে আসলাম ৷ কি আর করার শাড়ি পরতে দেরি হবে বলেই তাড়াতাড়ি সাজতে বসলাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নি ৷ আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে ৷ মেঘের গর্জন আস্তে আস্তে বেড়েই চলেছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে ৷ রিক্সা থেকে নেমেই সোজা পার্কের সেই বেঞ্চটাতে চলে গেলাম ৷ শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে নিলাম ৷ এই হচ্ছে সমস্যা, মনে হচ্ছে শাড়ি পরা হয় নি ৷ এইদিকে আকাশের অবস্থা তেমন একটা ভালো না ৷

একদল সাদা বক আকাশের ভেসে বেড়াচ্ছে ৷ লাইন ধরে দল বেঁধে যাচ্ছে ৷ খুব রাগ লাগছে আজ আকাশ মেঘলা হওয়ার কি খুব দরকার ছিলো ? কত সুন্দর করে সাজলাম সব নষ্ট হয়ে যাবে ৷ বেঞ্চটাতে ছাওনি আছে বৃষ্টি থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যাবে ৷ অন্য সময় হলে এতোটা চিন্তা করতাম না ৷ তবে আজ একটা স্পেশাল দিন ৷ কিন্তু বদের হাড্ডিটার কি এই দিনটার কথা মনে আছে? যা মন ভুলো ছেলে ৷ সব সময় বলতো, এইসব দিন মনে রাখা মেয়েদের কাজ ৷ মাঝে মাঝে রাগ হলেও ভালো লাগে ৷ যখন বলতাম,

— বলতো আমাকে কয় তারিখে ভালবাসি বলেছো ? উত্তরে, মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলতো,
— আমি তো তোমায় প্রতিদিনই ভালবাসি বলি ৷ সবদিন কি মনে রাখা যায় নাকি?

তবে এই দিনটা আসলে, যখন সেজে ওর সামনে যেতাম ৷ সাথে সাথেই কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো ৷ আর ওইরকম পাগলামি করলে না হেসে পারতামনা ৷ আজ খুব সুন্দর করেই সেজেছি ঠিক ওর মনের মতো ৷ হলুদ আর সবুজ মিশ্রনের শাড়ি, কানে বড় ঝুমকো আর হাত ভরা সবুজ হলুদ সংমিশ্রনের চুরি ৷ চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, ও যেমনটি চেয়েছিলো ৷ তখনি বাদামওয়ালা ছেলেটা বাদাম গুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

— আপা আজ কিন্তু আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে ৷ হাসতে হাসতে বললাম, তুই কখন এলি?
— এইতো মাত্রই আসলাম, অপেক্ষায় ছিলাম আপনার ৷
— কেনো রে?
— সকাল থেকে কোনো বাদাম বিক্রি হয় নি৷
— আচ্ছা, আজ বেশি করে বাদাম দিবি ৷ ছেলেটা একগাল হেসে বলল,
— আপা আপনি এতো ভালো ক্যান?
— হইছে আর পাকনামো করতে হবে না, এই নে ধর টাকা ৷

ছেলেটা হাসতে হাসতে চলে গেলো ৷ বাদাম গুলো পাশে রেখে ছুলতে শুরু করলাম ৷ যতক্ষণ না আসবে ঠিক ততক্ষণ বাদাম ছুলতে থাকবো ৷ অজান্তেই হেসে উঠলাম ৷ এখনো মনে আছে সেই দিনটার কথা, দেখা করার কথা ছিলো দুইটায় ৷ ওর আগেই চলে এসেছিলাম ৷ বাদাম খুব প্রিয় ছিলো ওর ৷ কথা অনুযায়ী বাদাম কিনে ওর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু আসার নাম নেই ৷ ফোন দিয়েছিলাম ৷ উত্তরে বলেছিলো,

— তুমি বাদাম ছুলতে থাকো ততক্ষণে আমি চলে আসবো ৷
— মনে থাকে যেনো ৷

বাদাম ছোলা শেষ হয়ে গেলো তাও আসতে পারে নি ৷ আরো বাদাম কিনলাম আর ছুলতে থাকলাম, হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো পরে যদিও নানা অযুহাত দেখিয়েছে ৷ তবে আমি ওতোটা ছেড়ে দেয়ার পাত্রী না ৷ সব বাদাম গুলো খাওয়ার পর ছেড়েছি ৷ তারপরের দুইদিন ঠিকমতো কথা হয় নি, টয়লেটে ছিলো বেশিরভাগ সময় ৷ কানে ধরে বলেছিলো,

— বুড়ি আর কোন দিন দেরি করে আসবো না ৷
— হি হি মনে থাকে যেনো হঠাৎই গোধূলি দৌঁড়ে এসে পাশে বসলো ৷
— ও মা আন্টি আজ তোমাকে এত্তো গুলো সুন্দর লাগছে ৷ মুচকি হেসে বললাম,
— পাকা বুড়িটাতো একদম ভিজে গেছে, আঁচল দিয়ে মাথাটা মুছে দিলাম ৷ পাশে বসতে বসতে বলল,
— এই সব বাদাম আমার জন্য?
— হ্যাঁ, খাও তবে বেশি না ৷ মা কি বলল? মনে আছে তো?
— উফফ!! এতো মায়ের বানী শুনিয়েও না তো ৷
— আচ্ছা তবে খাও

অল্প করে ৷ পাগলি মেয়ে একটা, প্রত্যেক সপ্তাহের শুক্রবার এখানে আসি ৷ বাদাম ছুলে রেখে যেতাম কিন্তু পরে এসে আর পেতাম না ৷ একদিন বেঞ্চে বসে বসে বাদাম ছুলছি ৷ বাচ্চা মেয়েটি আস্তে আস্তে পাশে বসল ৷

— প্রতিবার কি তুমি বাদাম ছুলে রেখে যাও? (গোধূলি) অবাক হয়ে উত্তর দিলাম,
— হ্যাঁ, কেনো বলো তো ৷ মাথা নিচু করে বলল,
— তোমার বাদাম গুলো আমি খেয়ে ফেলি, সরি আন্টি ৷
— ভালো তো খেয়ে নিছো তা সরি বলতে নেই ৷

তারপর কথা বলে জানতে পারলাম, মেয়েটার নাম গোধূলি, পাশেই নাচ শিখে ৷ ওর মা আসতে দেড়ি করে তাই এইখানে অপেক্ষা করে ৷ পরে বেশিরভাগ সময়ই ওর সাথে কাটাতাম, ওর মা এসে ওরে নিয়ে যেতো আমার কাছ থেকে৷

— ও আন্টি কি ভাবছো?
— উমম, ভাবছি আমিতো আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে আসছি কিন্তু গোধূলি কেনো এতো সুন্দর করে সেজেছে?
— আজ আমরা ঘুরতে যাবো তাই,

মেয়েটি বাদাম খাচ্ছে আর আমি ছিলে দিচ্ছি ৷ হাত ঘড়িটার দিকে তাঁকালাম, চারটা বেজে গেলো ৷ অপেক্ষা যে কতটা ভয়ংকর তা শুধু যারা অপেক্ষা করে তারাই বুঝে ৷ ঘুরে তাঁকাতেই দেখি ধ্রুব আসছে ৷ আমি জানতাম, ও এই দিনটা কিছুতেই ভুলবে না ৷ ঠিক আগের মতোই আছে, শুধু পেট কিছুটা বেড়ে গেছে ৷ মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল ৷ হঠাৎই গোধূলি দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ধ্রুবকে ৷ গোধূলি একের পর এক আদর দিয়ে যাচ্ছে ধ্রুবকে ৷ সে এক বাবা মেয়ের আনন্দের মুহূর্ত ৷ তার সাথে যোগ হয়েছে গোধূলির আম্মু ৷ নিজের চোখে দেখা দৃশ্য বিশ্বাস হচ্ছে না ৷ হাতের বাদাম গুলো কখন যে পড়ে গেলো খেয়ালই করি নি ৷ চোখের জল আটকানোর অনেক চেষ্টা করেও হলো না ৷ গোধূলির ডাকে ঘোর কাটলো ৷ এতক্ষণে ধ্রুবর খেয়াল হলো ৷ কিরকম করে তাঁকিয়ে আছে ৷ গোধূলি কোল থেকে নেমে ওর বাবাকে বেঞ্চে নিয়ে বসালো, আর বলতেছে

— জানো আব্বু আমি এই আন্টিটার বাদাম খেয়েছি ৷ তুমি না বললে অপরিচিত কারো জিনিস খাওয়া ঠিক না, আমাকে আর বকতে পারবে না ৷ এই আন্টি আমার খুব পরিচিতো ৷

ধ্রুব গোধূলির মাথায় হাত বুলিয়ে এদিক ওদিক তাঁকাচ্ছে ৷ সেই একই ভঙ্গি, যখন চোখে চোখ রেখে বলতাম, এমন একটা চোখ চাই ৷ যে চোখে আমাকে হারানোর ভয় থাকবে ৷ ঠিক তখনি এই ভাবে এদিকওদিক তাঁকাতো ৷ চোখের জল লুকানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতো কিন্তু আমার কাছে সেটা কখনো পারে নি ৷ আজও পারলো না ৷ দুজন মুখোমুখি বসলাম, গোধূলি আমার পাশে বসে সবাইকে বাদাম ভাগ করে দিচ্ছে ৷ মাথা নিচু করে আছি, তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারছি ৷ একজোড়া চোখ আমার উপর নজর রাখছে ৷ গোধূলির আম্মুর ঝাঁঝালো মিষ্টি শাসনে ওদের দিকে তাঁকালাম,
গোধূলির মা মানে আরিসার আঁচল দিয়ে ধ্রুবর মাথা মুছে দিচ্ছে আর বকছে, “তোমাকে কত বার বলেছি ছাতা নিয়ে বের হতে, গুরুত্ব দিলে না ৷ নিজের অজান্তেই চোখে জল এসে গেলে ৷ পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়বে কয়েক ফোঁটা লোনাজল ৷ ঠিক একইভাবে ধ্রুবর মাথা মুছে দিতাম আমি ৷ খুব হিংসে হচ্ছে আরিসার উপর ৷ ওমনি গোধূলি বলে উঠলো

— তুমি কাঁদছো কেনো আন্টি?
— কই না তো, চোখে কি একটা গেলো আরিসা ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— তোমাকে তো বলাই হয় নি, এই হচ্ছে বেলা ৷ যার কথা গোধূলি তোমাকে সবসময় বলে ৷ আর বেলা এই হচ্ছে ধ্রুব গোধূলির বাবা ৷ শুকনো হাসি দিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম ৷ এবার আমাকে যেতে কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা ছিলো ৷ আজ তা জানা হয়ে গেলো ৷ উঠে দাঁড়ালাম ঠিক তখনি আরিসা বলল,

— আরে আরে কোথায় যাচ্ছো?
— এবার আমাকে যেতে হবে ৷ (আমি)
— তোমার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করবে না?
— অপেক্ষার প্রহর শেষ ৷
— উফফ! তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝি না ৷

জানো ধ্রুব ,কত রকমের ভালবাসা আছে ৷ সেখানে তোমার আমার ভালবাসা তুচ্ছ ৷ বেলা আজ ৭ বছর যাবত অপেক্ষা করে যাচ্ছে ৷ তার ভালবাসার মানুষটির জন্য ৷ এই পার্কেই নাকি তারা প্রথম ভালবাসি বলেছিলো ৷ তাই সপ্তাহের ১টা দিন এইখানে আসে ৷ ধ্রুবর দিকে তাঁকালাম, ওরো মনে হচ্ছে গলার ভিতরে কিছু একটা আটকে আছে৷ যেমনটি আমারো হচ্ছে ৷

— বেলা বসো, আজ আমরা তোমার জীবন কাহিনী শুনবো, কি বলো ধ্রুব?

বলল, আরিসা ৷ হালকা কাশি দিয়ে ধ্রুবও হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালো ৷ কিছু কথা নিজের মধ্যে রাখতে রাখতে ভারি হয়ে আছি ৷ এবার নিজেকে হালকা করতে হবে ৷ উঠে দাঁড়িয়ে ছাউনির বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলাম ৷ বৃষ্টি ফোঁটায় চুরির উপর জল গড়িয়ে নিচে পড়ছে ৷

তখনো খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো ঝুম বৃষ্টি ৷ সেই প্রথম একজোড়া চোখের মাঝে হারিয়ে গেছি ৷ রিলেটিভের বিয়েতে গিয়েছিলাম, পুরো বাড়িটা মাতিয়ে রাখছিলাম আমরা পাঁচজন ৷ একেকজনকে ধরে বোকা বানানো ছিলো মূল উদ্দেশ্য ৷ নানান ভঙ্গিতে বর বউয়ের ছবি তোলা হচ্ছে ৷ তারমধ্যে একটা ছেলেকে দেখে চোখ আঁটকে গেলো ৷ কিরকম বড় বড় চোখ, বরকে বেশ জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছে ৷ সে কি মুড নিয়ে ক্যামেরা ম্যানের দিকে তাঁকিয়ে আছে ৷ হাতের মধ্যে থাকা ছোট খেলনার তেলাপোকা ছুড়ে মারলাম ছেলেটার দিকে ৷ আর সাথে তেলাপোকা বলে চিৎকার ৷ পড়লো গিয়ে ছেলেটার মাথায় ঝাঁকড়া চুলে ৷ তখন কোন গান হচ্ছিলো না কিন্তু মিউজিক ছাড়াই খুব সুন্দর একটা নাচ দেখেছিলাম ৷ বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

— মিতালী, মিউজিক ছাড়া ঝাঁকানাকা ঝাঁকানাকা নাচটা কিন্তু সেই হয়েছে ৷
— বেলা দেখ ছেলেটা কিরকম তাঁকিয়ে আছে, মনে হয় এক্ষনি গিল্লা খাইবো ৷
— লবন আর মরিচ লইয়া আয় তো মিতা ৷ খাইতে স্বাদ পাইবো ৷ (আমি) এবার ছেলেটি দাতে দাত চেপে কটমট করে তাঁকিয়ে আছে ৷

এই চাহনিতে বেশিক্ষণ মজা করা গেলো না দিলাম ভোঁ দৌঁড় ৷ তবে শেষ রক্ষা হলো না ৷ মাঝরাতে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি, সবার নজর এড়িয়ে চলে গেলাম ছাদে ৷ হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ দিয়ে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছি ৷ তুড়ির আওয়াজে চোখ খুলে তাঁকাতেই দেখি সেই ঝাঁকড়া মাথার সেই ভীতুটা ৷

— আআআপনি এখানে? (আমি)
— চিনতে পারছো?
— হ্যাঁ, সেই ভীতুরাম আবার সেই কটমট করে তাঁকিয়ে অাছে, পরিস্থিতি সামলাতে বললাম,
— আপনি বৃষ্টি পছন্দ করেন?
— হ্যাঁ আরো অনেক কিছু ৷
— কি?
— কেউ আমাকে ভয় দেখালে আমিও তার শোধ তুলি ৷
— সবাই কি আপনার মতো ভীতুরাম নাকি ৷ নিজের ভিতর শক্তি এনে বললাম, আমি কেউকে ভয় পাই না ৷
— ভয় পাও না?
— উহু

ওমনি ছেলেটার চাহনিটা পাল্টে গেলো ৷ এমন ভাবে তাঁকিয়ে আছে মনে হয় সত্যই গিলে খাবে ৷ যতোটা সহজ সরল ভেবেছিলাম ততোটা না ৷ ভীতুরাম এক পা করে সামনে আগাচ্ছিলো আর আমি এক পা পিছে ৷
যখন দেয়ালের সাথে আটকে গেছি ৷ ছেলেটা একদম কাছে চলে আসছে ৷ তখন চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলাম, “”ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝিঁ ভীতুরাম সামনে থাকলে করবে আমায় কি?”” কোন সাড়াশব্দ পেলামনা, আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই দেখি ৷ কোমরের হাত দিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে ৷ সুযোগটা হাত ছাড়া করলাম না ৷ একদৌঁড়ে চিলেকোঠায় এসে দাঁড়ালাম ৷

— ঐ কই যাও? (ভীতুরাম)
— লবন আর মরিচ আনতে,

গিলে খেতে আসছিলেন ৷ স্বাদ পেতেন না, তাই লবন মরিচ আনতে যাচ্ছি ৷ বলেই চলে আসলাম ৷ এর পর বেশ কয়েকবার দেখা হলেও সমান দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম ৷ যখন সে ঢাকা চলে যাচ্ছিলো, যোগাযোগের একটা মাধ্যম হিসাবে ছোট চিরকুটে লিখে ছিলো, ” সুযোগ করে কল দিও ” আর তার নিচে মোবাইল নম্বর দেওয়া ৷ সেই থেকে শুরু কথা বলা ৷ কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি লাইফ শুরু হলো ঢাকায় ৷ ভীতুরামের সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হতো ৷ ওরে আমি হ্যাকার বলতাম, কারন কি করে যেন মনের কথা সবটা বুঝে যেতো ৷ কখন মন খারাপ, কখন কি বলতে চাচ্ছি বা বোঝাচ্ছি সব বুঝে যেতো ৷ তবে শেষের দিকে যোগাযোগ কমিয়ে দিচ্ছিলো ৷ ফোন দিলে রিসিভ করতো না ৷ দেখা করতে চাইলে সেকি অজুহাত! হুট করে এক দিন ফোন দিয়ে বলে,

— যদি আমায় খুজে না পাও তাইলে কি করবে? (ভীতুরাম মানে ধ্রুব)
— মানে কি বলতে চাচ্ছো?
— খুব ভালবাসি পাগলি৷
— জানি তো কিন্তু কি হয়েছে বলবা তো?
— অপেক্ষা করতে পারবে?
— পারবো তো
— দেখা করবো কাল বিকাল চারটায়, শাড়ি পরে আসবা
— আচ্ছা যথা সময় আসলাম, আমাদের চিরচেনা সেই পার্কে ৷ ভীতুরাম আগেই চলে আসছে ৷
— কি ব্যপার আজ সূর্য কোন দিক দিয়ে উঠলো? মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
— বসো, শাড়িতে খুব ভাল মানায় তোমাকে ৷
— হইছে এবার বলো তো কি হইছে তোমার? এরকম শুকিয়ে গেছো কেনো? হাতটা শক্ত করে ধরে আছে ৷ আর এদিক ওদিক তাঁকাচ্ছে ৷ মানে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা ৷ ওরে স্বাভাবিক করতে বললাম,

— চলো হাটি
— হুম

সেদিনই ছিলো আমাদের শেষ দেখা, যাওয়ার সময় কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে বলেছিলো, “অপেক্ষা করো” আমি তখনো বুঝি নি, এতোদিন অপেক্ষা করতে হবে ৷ ভেবেছিলাম কোন কাজে গেছে, তাই অপেক্ষা করবো ৷ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো, কিন্তু ভীতুরামের দেখা পেলাম না ৷ কতবার যে কল দিলাম কিন্তু ফোনে পেলাম না ৷ রাত ৯টার দিকে বাসায় আসলাম ৷ বাসায় এসে আবার কল দিলাম, বন্ধই বলে যাচ্ছে ৷ সেই ফোন আজও অন হলো না৷ পরে বুঝে ছিলাম যে, “অপেক্ষা করো” মানে আমাকে ওর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৷ তাই আজও করে যাচ্ছি ৷
তখন আরিসা বলল,

— তোমার কি মনে হয়, সে কি এখনো বিয়ে করে নি? ধ্রুবর দিকে তাঁকালাম, কিরকম নড়েচড়ে বসলো ৷ চোখে চোখ রাখতে পারছে না ৷ মুচকি হেসে বললাম,

— ভালবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমন তো কথা না ৷ আমি এখনো ওরে ভালবাসি, ভীতুরামের জায়গা আমি অন্য কেউকে দিতে পারবো না ৷ হয়তো ভীতুরামের ক্ষেত্রেও তাই ৷ তবে ফেসবুক ঘেটে ভীতুরামের এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি ৷ ভীতুরাম বিদেশ চলে গেছে ৷ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরে, যে রোগ ধরা পরে তার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই৷ চিকিৎসা করার জন্যে বিদেশ গেছে ৷ তার পর আর যোগাযোগ করতে পারি নি তার সাথে ৷ আজও পারলাম না ৷ আসলে ভালবাসার পাগলামি হলো অভ্যাস ৷ ভীতুরামের বেলায়ও তাই হয়েছে ৷ কিছুদিন বা কয়েকমাস কথা হয় নি তাই হয়তো অভ্যাসটা কেটে গেছে ৷

ধ্রুব এবার আমার চোখে চোখ রাখলো, ইশারায় বললাম, ব্যপার না ৷ এটাই নিয়তি ৷ ধ্রুব আর চোখে জল আঁটকে রাখতে পারলো না ৷ সেই জলের ফোঁটা গুলোও আমার নজর এড়ায়নি ৷ নাহ এই জলের মায়ায় জড়ানো যাবে না ৷ আরিসার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভীতুরামের দিকে তাঁকিয়ে, চোখের চাহনিতে বুঝালাম , “ভালো থেকো” গোধূলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, এবার আসি রে আন্টি ৷ ভালো থেকো হয়তো দেখা হবে না ৷ আর বেশি চকলেট খেও না মা৷ ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আপন নীড়ে ৷ পিছনে ফেলে আসছি সাত বছরের চাপা কষ্ট ৷ হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠলো, ফোনটা বের করে দেখলাম তাশফিয়াকের ফোন,

— হ্যাঁ বলো (আমি)
— কই তুমি?

এখনো বাসায় যাও নি? জলদি বাসায় যাও ৷ আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি আসছি ৷ না হলে এই মেঘলা দিনে তোমার হাতের ভুনা খিচুড়ি সাথে বেগুন ভাজি, উফ্! মনে পড়লেই জিভে জল চলে আসে৷ দাতে দাত চেপে বললাম, বেগুন ভাজি?

ওপাশ থেকে আর কোন শব্দ পাচ্ছি না, নিশ্চই জিভে কামর দিয়ে বসে আছে ৷ আস্তে করে বললাম, তবেই রান্না করবো যদি আমার জন্য একগুচ্ছ কদম ফুল আনো ৷ ওপাশে অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলাম, “পাগলি একটা” হ্যা আমিও আমার সংসারে ডুবে আছি, ১বছর হলো ৷ ভীতুরামকে ভালবাসছিলাম সবটা জুড়েই ৷ কথাও দিয়েছিলাম ছেড়ে যাবো না কখনো কিন্তু বাস্তবতার কাছে হেরে গিয়ে কথা রাখতে পারি নি কেউ ৷ হয়তোবা ভীতুরাম আগে আর আমি পড়ে ৷ তবে জীবন থেমে থাকে নি ৷ সে তার আপন গতিতে চলছে ৷ আর অতীত? সে তো থাকবেই তাই বলে বর্তমানে কেনো অতীতের প্রভাব পড়বে? তবে কিছু স্মৃতি স্পষ্ট হয় না, থেকে যায় অস্পষ্ট অনুভূতি হয়ে সারাজীবন ৷

 সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত