ভাগ্যের লিখন

ভাগ্যের লিখন

নীলের বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায় যখন নীলের বয়স ছিল ২ বছর ৷ স্বামীকে হারিয়ে বিধবার জীবনকে বেছে নিতে হয় আমাকে ৷ বিয়ের জন্য জোরাজুরি করছিল আমার মা, বাবা ৷ কিন্তু ছেলেকে তো কষ্টের সাগরে ফেলে দিতে পারিনা এজন্য কোনো পুরুষকে আর জীবনসঙ্গী করে নিতে পারিনি! যে সময়ে বাচ্চারা কথা বলা শুরু করে সেই সময় পার হয়ে যায় এরপরও আমার ছেলেটা কথা বলেনা ৷ কয়েক মাস পরই বুঝতে পারলাম বোবা সন্তান জন্ম দিয়েছি আমি ৷ নীলের বয়স যখন ৮ তখন তার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বুঝতে পারলাম সে অন্যসব ছেলেদের মত নয় ৷ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের নিকট নীলকে নিয়ে এলাম ৷ ডক্টর বললেন আমার ছেলে অটিস্টিক! আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার মাথার উপর ৷

আমার পৃথিবীটা অন্ধকারে ঘিরে ধরলো ৷ সমাজের লোকজন আগে থেকেই বিধবা বলে আমাকে বিদ্রুপ করতো, আর এখন যোগ হলো অটিস্টিক শিশুর মা ৷ ছেলেকে বোবা বলে আগে থেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো, ৷ নতুন সমস্যাটির কারণে ছেলেটার প্রতি সমাজের লোকদের আরো নাক ছিটকানি বেড়ে গেল ৷ ছেলেটা কারো সাথে খেলতে পারতোনা ৷ খেলতে গেলেই মাইর খেয়ে চলে আসতো ৷ একা হয়ে গেল সে ৷ বন্ধু আর খেলার সাথী বলতে আমিই রইলাম ৷ সমাজের মহিলাদের ভাষ্য আমার মত মেয়ের কারণেই এমন ছেলে জন্ম হয়েছে ৷ আমি নাকি অপয়া, অলক্ষ্মী! বিধবা হবার কারণে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে সম্পর্কটা নষ্ট হয়েছিল ৷ বান্ধবীর আম্মার কথা বিধবা মেয়ের সাথে মেলামেশা করলে তার মেয়েরও একইরকম সমস্যা হতে পারে ৷

এজন্য বান্ধবীর সাথেও সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়! এবার ছেলে অটিস্টিক ও বোবা হওয়ায় অন্তসত্তা মহিলাদের সাথে ওঠাবসা বন্ধ হয়ে গেল ৷ তারা আমার সাথে মিশতে চাইনা আর ৷ দর্জির কাজ করি ৷ আমার নিকট অনেক মহিলাই আর কাপড় বানিয়ে নেবার জন্য আসেনা! এভাবেই চলছিল জীবন ৷ দর্জির কাজ করে মা ছেলে মিলে কোন রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে রইলাম! কিন্তু ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতে দর্জির কাজ দিয়ে চলছিলনা ৷ শেষমেষ গার্মেন্টসে ভর্তি হলাম ৷ নাইটেও কাজ করতে হতো ৷ যেদিন রাতে কাজ থাকতো সেদিন ছেলেটা আমার আম্মার কাছে থাকতো ৷ একদিন রাত ১১ টার দিকে গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফিরছিলাম! রাস্তায় পুলিশ গাড়ি টহল দিচ্ছিল ৷ আমাকে ধরে বলল,

___দাঁড়া, তুই কোন মহিলা হোস্টেলের বেশ্যা? আজ কত কামাই করে এলি? কতজন কাস্টমার পেয়েছিলি? আর কি পারবি, সহ্য হবে? পারলে বল? ৫০০ টাকা দিব! কিছুই বললাম না ৷ মুখ বুজে সহ্য করলাম ৷ পুলিশ অফিসার আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল,

___এটা রাখ, দরকার পড়লে চলে আসবি ৷ টাকা নিবি, আমাকে তুষ্ট করবি, ব্যাস! কার্ড নিয়ে চলে এলাম! এর তিনদিন পর আবারো রাত্রীতে ডিউটি করতে হলো ৷ রাত্রে ডিউটি করার সময় হঠাৎ ম্যানেজার ডাক দিল ৷ তার রুমে গেলাম ৷ সে মিটমিট করে হেসে বলল,

___দেখতে তুমি অনেক সুন্দর ৷ লেখাপড়া কত পর্যন্ত পড়েছ যেন? জবাব দিলাম,
___এইচএসসি পাশ করতে পারিনি!
___সমস্যা নাই প্রোমশন পাইয়ে দেব, শুধু আমাকে খুশি করবা!
___কি স্যার?
___কালকে রাতে একটা হোটেলে আমাকে ৩টা ঘন্টা সময় দিবা!

এর বেশি কিছু শুনতে হলোনা, আমি বুঝে গেলাম সে কি বলতে চাচ্ছে?৷রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম ৷ ডিউটিও করলাম না ৷ গার্মেন্টসের কাজ বাদ দিলাম! ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিলাম স্কুলে ৷ বাস থেকে নেমে দেখা হয়ে গেল সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুপ্তির সাথে ৷ তার কোলে বাচ্চা! মেয়ে সন্তান! সুপ্তিকে দেখে খুশি হয়ে বললাম,

___সুপ্তি তুই! কেমন আছিস? সুপ্তি হাসিমুখেই জবাব দিল,
___ভাল ৷ তুই কেমন আছিস?
___এইতো আছি, এরকম ৷ বিধবারা খুব একটা ভাল থাকেনা! এটা শুনে সুপ্তির মুখটা ছোট হয়ে গেল! সুপ্তিকে ফের বললাম,

___কই যাচ্ছিস?
___শ্বশুর বাড়ি গেছিলাম ৷ ৬মাস পর একটু দেখা করে এলাম!
___কেন, শ্বশুর বাড়ি থাকিস না আর? আলাদা বাসা নিয়েছিস? সুপ্তি বিবর্ণ মুখে কাঁপা গলায় বলল,
___আমার স্বামী মারা গেছে রে ৷ আমি তোরই মত আজ বিধবা!

শুনে খুব কষ্ট লাগল ৷ মনে মনে বললাম আমি তো কখনো সুপ্তির মায়ের কথায় কষ্ট পেয়ে সুপ্তির অনিষ্ট হোক কামনা করিনি ৷ এরপরও তার এমনটা হলো? নিয়তি সত্যিই নিষ্ঠুর ব্যবহার করে যার তার সাথে! সুপ্তির সাথে বেশি কথা বলতে পারলাম না আর ৷ ওর ফোন নম্বর নিয়ে স্কুলের দিকে চলে গেলাম ৷ আজ নীল চারুকলা প্রতিযোগিতায় অংশ নিবে ৷ সে খুব ভাল ছবি আঁকতে পারে! প্রতিযোগিতায় নীল আজ আমার ছবি এঁকেছে ৷ হুবহু আমার ছবি ৷ প্রতিযোগিতায় নীলই প্রথম হলো ৷ অটিস্টিক স্কুল থেকে পাশ করে নীল চারুকলায় ভর্তি হলো!

১৪ বছর পরের ঘটনাঃ নীল আজ অনেক বড় চিত্রশিল্পী ৷ প্রতি সপ্তাহে আর্টগ্যালারিতে নীলের ছবি প্রদর্শনী হয় ৷ এই সপ্তাহে নীল একটা অন্তসত্তা মহিলার ছবি এঁকেছে ৷ কাল্পনিক মহিলা! মোনালিসার ছবিটা যেমন রহস্যে ঘেরা ছিল ৷ নীলের আঁকা অন্তসত্তা মহিলার ছবিটাও সেরকম রহস্যময় ৷ ছবিটা দেখে মনে হয় মহিলাটা বিশেষ কোন কারণে কষ্টে আছে, তবে হাসির কারণে কষ্টটা বোঝা যাচ্ছেনা ৷

অন্তসত্তা মহিলাদের চেহারায় একধরণের স্নীগ্ধতা বিরাজ করে ছবিতেও সেরকমটা প্রকাশ পেয়েছে ৷ কিন্ত মহিলাটির গায়ে সাদা শাড়ি থাকায় বুঝা যাচ্ছে সে বিধবা ৷ নাকে নাকফুলও নেই ৷ হাতে বালাও নেই ৷ শুধু কানের দুল আছে! ছবিটা দেখতে প্রচুর মানুষ আর্ট গ্যালারিতে ভিড় করলো! পরেরদিন সকালে ঘটে গেল আশ্চর্য রকমের ঘটনা ৷ যেটা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি ৷ আমাদের বাসায় একটি মেয়ে এসে হাজির হয়েছে ৷ মেয়েটি অন্য কেউ নয়, নীলের আঁকা ছবিটির সেই মহিলাটি! অবাক হয়ে গেলাম আমরা! মেয়েটা অভিযোগ করল যে নীল কেন অনুমতি ছাড়া তার ছবি পেইন্টিং করেছে? নীলের হয়ে আমি বারবার বললাম যে ছবিটা কাল্পনিক ছিল এরপরও মেয়েটা কোন কথায় শুনলোনা ৷ মেয়েটা বলল সবগুলো ছবি নষ্ট করে দিতে হবে, অন্যথায় পুলিশের নিকট ষড়নাপন্য হবে!

নীল শেষপর্যন্ত ছবিগুলো নষ্ট করে দিল! পরের সপ্তাহে নীল পাহাড়, পাহাড়ে মেশা নদী, ঝর্ণা ও গাছপালা এসব নিয়ে অত্যান্ত আকর্ষণীয় একটি পেইন্টিং করল ৷ পেইন্টিংটা সেই মেয়েটির পছন্দ হবার কারণে আবারো বাসায় চলে আসল সে এবং নীলের নিকট ক্ষমা চাইল পূর্বের ব্যাবহারের জন্য ৷ নীল তাকে মাফ করে দিলো! নীল ও মেয়েটার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল ৷ বন্ধুত্ব হতে হতে নীল মেয়েটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেল ৷ ভালবেসে ফেলল তাকে ৷ নীল লজ্জা শরম ভুলে আমাকে কথাটি কাগজে লিখে প্রকাশ করল ৷ নীলকে বললাম সাহস করে চিঠিতে মনের কথাটি লিখে মেয়েটাকে দিয়ে দেবার জন্য ৷ নীল সেই মোতাবেক কাজ করল ৷ মেয়েটাকে প্রোপজ করলো ৷ কিন্তু মেয়েটা সোজা প্রত্যাখান করল ৷ কারণ আমার ছেলে বোবা ও অটিস্টিক ৷ নীলকে বন্ধু ভাবা যায়, প্রেমিক নয় ৷ নীলের সাথে মেয়েটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙ্গে দিল ৷ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল ৷ পরে জানতে পারলাম মেয়েটি আমার বান্ধবী সুপ্তির একমাত্র মেয়ে তন্নি!

নীল তন্নির জন্য যেন পাগল হয়ে যায় এমন অবস্থা ৷ ওদিকে তন্নির বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে! নীল সবকিছু উপেক্ষা করে তন্নির বিয়ে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়! বোবা হয়ে কি আর করতে পারে সে? মুখে না বলে তন্নিকে মানুষ ভর্তি লোকের সামনে জড়িয়ে ধরে ৷ তন্নি রেগে নীলকে জুতা দিয়ে পিটাতে থাকে এবং বিয়ের আসর থেকে নীলকে বের করে দেয় ৷ এই ঘটনাটা জানতাম না ৷ এও জানতাম না যে তন্নির বিয়ের দিন নীল তার বাসাতে গিয়েছিল ৷ সব ডায়েরী পড়ে জানতে পারি!

নীল মারধর খাবার পর তন্নিকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে! ৩ বছরের মধ্যে নীল আন্তর্জাতিক চিত্রশিল্পী হয়ে যায় ৷ ইতালিতে নীলের পেইন্টিং প্রদর্শিত হয়! দর্জির কাজ করে সংসার চালিয়ে গিয়েছি সেই আমার সন্তান আজ কোটি কোটি টাকার মালিক! সেদিন ছিল শুক্রবার ৷ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা মা ছেলে দুজনে ৷ নীলকে বিড়ম্বনায় যেন পড়তে না হয় এজন্য সে কালো সানগ্লাস আর মাথায় টুপি পড়ে আছে ৷ পিছন থেকে ডাক দিল কে যেন? ফিরে দেখি সুপ্তি! আমাকে দেখে বললো কেমন আছিস? আমি উত্তর দিলাম ৷ তাকেও বললাম তুই কেমন আছিস ? সে উত্তর দিল,

___আমি ভাল নেই ৷ এই যে আমার মেয়েটা মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে গেছে! শুনে কষ্ট পেলাম ৷ সুপ্তিকে বললাম,
___কেমনে হলো?
___তন্নির বিয়ে হয় ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ৷

ছেলেটা অসংখ্য নারীতে আসক্ত ছিল ৷ তন্নির হাতে একদিন ধরা পড়ে যায সে় ৷ তন্নি তাকে মেয়েদের সাথে মিশতে নিষেধ করে ৷ ওর স্বামী মেনে নেয়না তন্নির কথা ৷ তন্নি রেগে গিয়ে ওর স্বামীর গায়ে হাত তোলে ৷ ওর স্বামী তন্নির আচরণে রেগে গিয়ে স্টোর রুম থেকে রড এনে দুটা বারি দেয় মাথাতে ৷ মাথা ফেটে যায় তন্নির ৷ এরপরও আল্লাহর রহমতে যথাসময়ে হাসপাতালে নেওয়ায় এবং অপারেশন ঠিক ভাবে হওযায় তন্নি বেঁচে যায়৷ কিন্তু মানসিকভাবে আজও সুস্থ্য হয়নি সে! ওর স্বামী ভুল তো স্বীকার করেইনি উল্টা ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে!

তন্নির নির্মম ঘটনাটি শুনে সত্যি কষ্ট পেলাম! নীল তন্নির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! আর তন্নি কেমন করে যেন হাসছে ৷ সুপ্তি তার মেয়েকে সাথে করে নিয়ে গেল! আর নীল বিষাদময় দৃষ্টি নিয়ে তন্নির যাওয়া দেখছিল! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যদি সুযোগ হয় তবে তন্নিকে ছেলের বউ করে ঘরে আনব! হ্যাঁ, সেটাই হয়েছিল!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত