কদম ফুল

কদম ফুল

আরোহী গতকালের মত আজও কাক ডাকা ভোরে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাটতে হাটতে সেই কদম গাছটির নিচে এসে দাঁড়াল।আজ তিন দিন হলো আরোহী তার বাবা মায়ের সাথে এখানে একটা নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে।প্রথম দিন বাসা গোছাতে গোছাতেই শেষ। দ্বিতীয় দিন সকালে সে হাটতে বের হয়।প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাটাহাটি করা আরোহীর পুরনো অভ্যাস। এর পিছনে অবশ্য একটা থিওরি আছে আরোহীর। আরোহী মনে করে, শয়তানেরা (বখাটে, গুন্ডা, বদমাশ) সারাদিন সারারাত ধরে শয়তানী করে সকাল আটটা /দশটা পর্যন্ত মরার মত ঘুমিয়ে থাকে। সকালবেলায় শুধু ভালো মানুষগুলোর আনাগোনা থাকে। যতগুলো খুন ও ধর্ষণের ঘটনা শোনা যায় সেগুলো হয়তো দিন দুপুরে নয়তো রাতের আঁধারে ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু কখনো শোনা যায়নি যে কাক ডাকা ভোরে কেউ খুন বা ধর্ষণ হয়েছে।

তাই এই সময়টা একদম নিরাপদ মনে হয় আরোহীর কাছে। তাই সে সকালে হাটতে বের হয় আর পুরো বিকাল বাসায় মায়ের সাথে দুষ্টামি করে কাটিয়ে দেয়। অভ্যাস অনুযায়ী হাটতে হাটতে এদিকে এসে কদম গাছটির কাছে আসে। গাছ ভর্তি কদম ফুল দেখে খুশিতে লাফালাফি করতে থাকে।কদম ফুল আরোহীর খুবই পছন্দ।সদ্য ডাল থেকে ছিঁড়া তাজা কদম ফুল দু’হাতের মুঠোই আলতো করে চেপে ধরলে নাকি আরোহীর দেহ মন শিহরিত হয়ে ওঠে। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। আজকে দুই তিনটার বেশি কদম ফুল পড়েনি। ফুলগুলো হাতে নিয়ে গাছের দিকে তাকাল। কি ভেবে ফুলগুলো আবার নিচে রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে গাছ ধরে ঝাকা দিলো। কিন্তু আফসোস, গাছ বিন্দুমাত্র নড়লো না। ব্যর্থ হয়ে হাত দুটো উঁচু করল ফুলগুলো ধরার জন্য। এখানেও সে ব্যর্থ হলো।

কারণ, ফুলগুলো তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। নিরুপায় হয়ে ফুলগুলো তুলে নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলো। গতকাল থেকে একজোড়া চোখ যে আরোহীর পাগলামিগুলোকে ফলো করছে সেটা আরোহী জানেই না। আরোহী বাসায় ঢুকেই ওর মায়ের সামনে ফুলগুলো রাখল। ওর আম্মু কদম ফুল দেখে বলল, এই সাত সকালে কদম ফুলের খোঁজে বেরিয়েছিস না? এই নতুন জায়গায় যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যেতো! আরোহী বলল, আম্মু আমার থিওরি তোমার মনে আছে! ‘হুম’ আম্মু বলল। ‘তাহলে অহেতুক চিন্তা করে মাথা খারাপ করো না’ বলেই বাবার কাছে ছুটে গেল। আরমান সাহেব সবে মাত্র চা হাতে ব্যলকুনিতে বসেছেন অমনি আরোহী এসে হাজির। ‘বাবা এই দেখো’ বলে বাবার সামনে ফুলগুলো মেলে ধরল। আরমান সাহেব ফুলগুলো দেখে হেসে বললেন, আচ্ছা এই কদম ফুল তোর পিছু ছাড়ে না নাকি তুই কদম ফুলের পিছু ছাড়িস না বল তো আমাকে?

-‘দুটোই’ মুচকি হেসে বলল।
-মাত্র দুই তিনটা কেন!
-বাবা, ডালগুলো একটু উঁচুতে ছিল। তাই পারতে পারিনি। আর এই তিনটা ফুল নিচে পড়ে ছিল। সেগুলোই নিয়ে এসেছি।
-হুমম বুঝেছি।
-আচ্ছা বাবা, এই কদম ফুলের ডাল এতো উঁচুতে থাকে কেন! নিচে থাকলে কত ভালো হতো তাই না বাবা!
-তাহলে তো তোর প্রিয় ফুলগুলো অন্য কেউ পেরে নিয়ে যেত। তখন কি ভালো হতো!
-না বাবা, একদম ভালো হতো না। থ্যাঙ্কু বাবা সুন্দর করে বোঝানোর জন্য।
-‘পাগলী একটা’ বলেই হেসে দিলেন।

প্রতিদিনের মতো আজও পুরোটা বিকাল মায়ের সঙ্গে দুষ্টামি করে মাকে বিরক্ত করে কাটিয়ে দিলো আরোহী। কিন্তু অন্য দিকে এক জোড়া চোখ সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কদম তলায় ঘোরাঘুরি করছে। খুঁজে ফিরছে ‘কদম’ পাগলীকে।সন্ধ্যা হওয়ার পর সেই চোখ জোড়ার মালিক বুঝতে পারল কদম পাগলীর দেখা সকালবেলা ছাড়া পাওয়া যাবে না। সকালবেলা। অভ্যাস অনুযায়ী আরোহী সেই কদম গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। আরে! আজ দেখি একটা ফুলও পড়েনি। তবে কি আজ খালি হাতে ফিরতে হবে! মনটা খারাপ হয়ে গেল আরোহীর।গাছের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই একটা চিরকুট পিনআপ করা দেখতে পেল। অবাক হয়ে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগল। কদম প্রেমী,

দুই সকালে তোমাকে কদম তলায় দেখে বুঝে গেছি কদম ফুল তোমার খুবই প্রিয়। কালকে তুমি কতোই না চেষ্টা করলে তাজা ফুল পারার জন্য। কিন্তু ফুলগুলো বড্ড দুষ্ট, তোমার কাছে ধরাই দিলো না। তাই আজ নিজে ধরে এনেছি তোমার কাছে।চাইলে ফুলগুলো তোমার বাসায় দরজার সামনে রেখে আসতে পারতাম কিন্তু তুমি তখন তোমার বাবা মায়ের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে।অচেনা কেউ তোমাকে ফুল দিতে যাবে কেন! তাই এখানেই রেখে দিলাম। গাছের উল্টা পাশে একটি ফিতা বাঁধা আছে। সেটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দাও, তাহলে ফুলগুলো তোমার হাতে ধরা দেবে। যদি বন্ধু ভেবে থাকো তাহলে ফুলগুলো নেবে আশা করি।

ইতি
অদেখা এক বন্ধু (R)

চিরকুটটা পড়ে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে না পেয়ে গাছের উল্টা পাশে এসে দাঁড়াল।সেখানে একটা ফিতা বাঁধা দেখতে পায়। ফিতাটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলে একগুচ্ছ তাজা কদম ফুল আরোহীর হাতে ধরা দিলো। আশেপাশে কাউকে না দেখে খুশিতে লাফালাফি করল একটু। তারপর দ্রুত বাসায় গিয়ে বাবার সামনে চিঠি সহ ফুলগুলো রাখল। আরমান সাহেব মেয়ের হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আবার চিঠি সহ ফুলের দিকে তাকালেন। তিনি ভালো করেই জানেন যে আরোহী চিঠির জন্য এত খুশি নয় বরং ফুলের জন্য। তিনি ফুলের প্রশংসা করে চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলেন। পড়া শেষে বললেন, ছেলেটাকে কি দেখেছিস ওখানে? ‘না বাবা’ আরোহী উত্তর দিলো। এক কাজ কর। ফুলদানিতে সামান্য পানি দিয়ে সেখানে ফুলগুলো রেখে দে, তাহলে সারাদিন তাজা থাকবে। ‘থ্যাঙ্কু বাবা’ বলে ফুলগুলো নিয়ে চলে গেল আরোহী।

আপনি হয়তো ভাবছেন, অচেনা একজন আরোহীকে ফুল দিলো অথচ তার বাবা তাকে কিছুই বললেন না! এখানে আরমান সাহেবের একটা থিওরি আছে। তিনি মনে করেন, সন্তানদের সব কাজেই বাঁধা দেওয়া উচিত নয় যতক্ষণ না সেই কাজ ভুল অথবা খারাপ প্রমাণিত হয়। এতে করে বাবা মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক থাকে। বন্ধুর মত সবকিছুই শেয়ার করে।সব ব্যাপারেই ভরসা করতে শিখে। আর যদি ভালো মন্দ যাচাই না করেই সব কাজেই বাঁধা দেওয়া হয় তাহলে সন্তানরা পিতা-মাতার অগোচরে অনেক কিছুই করে বসে। তাই আরমান সাহেব মেয়ের ব্যপারে সবসময়ই এই থিওরি কাজে লাগান।

পরদিন ফজরের নামাজ পড়তে আরমান সাহেব মসজিদে গেলেন। বেশ কয়েক জন মুসল্লি এসেছে। কমবেশি সবাই বয়স্ক। সেখানে একটা যুবককে দেখতে পেলেন। তিনি যুবকটির পাশে গিয়ে বসলেন। যুবকটি সালাম দিলে তিনি তার উত্তর দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন। সে উত্তরে বলল, আমি রোহান। তিনি রোহানের সাথে আরও দুই একটা কথা বলে জামাতের সাথে নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে রোহান চলে গেলে ইমাম সাহেবের কাছে রোহানের ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন খুবই ভদ্র একটা ছেলে।

ওর মত দ্বিতীয় কেউ নেই এই এলাকায়। আরমান সাহেব মসজিদ থেকে বেরিয়ে দ্রুত কদম তলার রাস্তা ধরলেন। দূর থেকেই কিছু একটা দেখে মুচকি হেসে বাসায় ফিরে গিয়ে দেখেন আরোহী বের হচ্ছে। আরোহী বাবাকে দেখে বলল, চলো বাবা আজ দুজনেই কদম তলা থেকে ঘুরে আসি। তিনি একটু হেসে বললেন, তোর সাথে আমাকে ওখানে দেখলে তোর অদেখা বন্ধু ভয় পেয়ে আর ফুল পেরে দিবে না। সেটা কি ভালো হবে? ‘না বাবা একদম ভালো হবে না। তুমি বরং নাস্তা সেরে নাও, আমি আসছি’ বলেই আরোহী বেরিয়ে পড়ল। বেশ কয়েক দিন এভাবেই চলতে থাকল। একদিন সেই অদেখা বন্ধু যখন কদম তলায় গেল কদম ফুল পারতে, সেখানে একটা চিরকুট পিনআপ করা দেখতে পেল। ভোরের হালকা আলোতে দেখল সেখানে লেখা ‘যদি আমার কদম পাগলী মেয়েটির জন্য কদম ফুলের একটা বাগান করে দেওয়ার সাহস থাকে তবে তোমার বাবা মাকে নিয়ে এসো’।

—কদম পাগলীর বাবা।

চিরকুটটা নিয়ে চলে গেল সে। আরোহী অভ্যাস অনুযায়ী কদম তলায় গিয়ে দেখে আজ সেই অদেখা বন্ধু তার জন্য তাজা ফুল পেরে রাখেনি। তাই রাতের পড়ে থাকা ফুলগুলো নিয়ে এসে মুখ গোমরা করে বসে থাকল। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে আরমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমার পাগলীটার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
পরদিন সন্ধ্যায় রোহান তার মা বাবাকে নিয়ে আরোহীদের বাসায় গেল। আরমান সাহেব রোহানকে দেখে বললেন, আমি জানতাম তুমি আসবে। আরোহীকে দেখার জন্য রোহান এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। আরমান সাহেব বুঝতে পেরে বললেন, আরোহী রুমে আছে। রোহান বলল, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে এই চিরকুটটা ওকে দিন প্লিজ। মুচকি হেসে চিরকুটটা নিয়ে মেয়ের রুমে গিয়ে দেখেন সে শুয়ে শুয়ে উপন্যাস পড়ছে। তাকে ডাক দিয়ে বললেন, তোর জন্য একটা চিরকুট এসেছে। আরোহী চিরকুটটা হাতে নিয়ে দেখল সেখানে লেখা,
প্রিয় কদম পাগলী, আমি এই দুইদিনে কদম ফুলের ছোটখাটো একটা বাগান তৈরি করলাম। তুমি চাইলে তোমাকে সেই বাগানের মালিক বানিয়ে দেব।

—অদেখা বন্ধু (R)

চিরকুটটা পড়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘বাবা এটা কে দিলো তোমাকে? বাবা হেসে বললেন, বসার রুমে গেলেই বুঝতে পারবি। এক দৌড়ে বসার রুমে গিয়ে সামান্য উঁকি দিয়ে দেখল সেই অদেখা বন্ধুকে।

৪০ বছর পর। রোহান সাহেব তার একমাত্র নাতি রাহুলকে প্রতিদিনের মতো খুব সকালে ঘুম থেকে টেনে তুলে কদম গাছে উঠিয়ে দিলেন ফুল পারার জন্য। পাগলীটার শরীরের বয়স বেড়েছে কিন্তু মনের বয়স একটুও বাড়েনি। কারণ, পাগলীটা যে এখনো কদম ফুল ভালোবাসে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত