“ঘুমোনোর সময় আমার স্ত্রী আয়েশা অনেক প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমায়।” এই যেমন শাড়ির কুঁচি ঠিক করবে, ক্লিপ দিয়ে চুল আটকাবে। বিছানার চাদরের সাথে মেচিং করে হালকা লিপিষ্টিক পড়বে। শরীরে কাঁথা জড়িয়ে ফুল পাওয়ারে সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি একটা টেবিল ফ্যান ছেড়ে দিবে। তারপর হাই তুলতে তুলতে বলবে, “গুড নাইট”। আজ আমি অফিস থেকে ফেরার পর সে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। খাবারের টেবিলে চাপচ এবং কড়াইয়ের সাথে অকারণে ঠনঠন শব্দ করেছে৷ টিভিতে সাউণ্ড দিয়ে কিছু একটা দেখছিল, আমি সাউণ্ড কমাতে বললে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলেছে, “দেখছ না নাটক দেখছি?” আমি বললাম, “কী নাটক?” সে বিরক্তির রেখা চোখে মুখে ফুটিয়ে বলেছে, “নাটকের নাম চাঁদের বুড়ি অথচ চাঁদের বুড়ির কোনো দেখা নেই। সব সস্তা প্রেম কাহিনীতে ভরপুর।”
“তাতে তুমি বিরক্ত হচ্ছ কেন?””উল্টাপাল্টা কাহিনী দিয়ে এত সুন্দর নাটকের নাম দেবে কেন?” “ডিরেক্টরের ইচ্ছে করেছে তাই দিয়েছে।” “তুমি ডিরেক্টরের হয়ে কথা বলবা না। একদম চুপ থাকো।” “তুমি দেখি রীতিমতো রেগে যাচ্ছ। এত ছোট বিষয় কেউ রাগারাগি করে নাকি? “আয়েশা রাগে ফোঁপাতে লাগল। টিভি অফ করে বিছানার চাদর বদলে সাদা চাদর বিছাল। কিন্তু বালিশ এবং কোলবালিশের কাভার কালো রঙের বিছালো। কাপড় বদলে সাদা রঙের শাড়ি পড়ে লাল টকটকে লিপস্টিক দিল। আমি মনে মনে বললাম, “হচ্ছেটা কী?” আয়েশা বলল, “কালো রঙের লিপস্টিক পাওয়া যায় কোথায় বলতে পারো? কালো রঙের লিপস্টিক পড়তে খুব ইচ্ছে করছে। চাঁদের মধ্যে যে বুড়ি দেখা যায় তার ঠোঁটে যদি লাল লিপস্টিক দেওয়া হতো অবিকল আমার মতো লাগতো।”
আয়েশার ছেলেমানুষী কাজকর্ম এবং কথাবার্তার সাথে আমি অভ্যস্থ। জবাব দেবো না দেবো না করেও অন্য প্রসঙ্গে বললাম, “তোমার মায়ের শরীরের অবস্থা এখন কেমন? আজ কথা হয়েছে?” আয়েশা আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমার মা বছরের পর বছর ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কখনও তুমি তার শরীরের অবস্থা জানতে চাও না। আজ জিজ্ঞেস করলে যে?” আমি জবাব না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। বের হয়ে দেখি আয়শা বিছানায় শরীর এলিয়েশুয়ে পড়েছে। কেন জানি আমার সেই মুহূর্তথেকে অস্থিরতা বাড়ছে। আমি ঘরের বাতিবন্ধ না করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আয়েশা চোখ বন্ধ অবস্থায় বলে উঠল,
“এ্যাই শাদবিন, কী দেখছ?” চোখ বন্ধ অবস্থায় একজন মানুষ এত নিখুঁত ঘুমের অভিনয় করতে পারে আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি বললাম, “তুমি ঘুমাও নি?” “উঁহু। চোখে আলো লাগে। বাতি বন্ধ করে দিয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়।” আমি আয়েশার কথামতো বাতি বন্ধ করে শুয়ে পড়ার সাথে সাথে সে বলল, “বললে নাতো কী দেখছিলে?”
“আকাশ দেখছিলাম।”
“দেখতে কেমন?”
“সুন্দর?”
“আমি বেশী সুন্দর নাকি আকাশ বেশী সুন্দর?”
“তুমি বেশী সুন্দর।”
আয়েশা বড় নিঃশ্বাস নিল। তার নিঃশ্বাসের শব্দে মনে হল আকাশকে বেশী সুন্দর বললে সে খুশি হতো। সে তার বাম হাত আমার শরীরের উপর রেখে বলল, “আকাশে চাঁদ ছিল না?” “ছিলো।” “চাঁদের বুড়ি ছিলো?” “ছিলো।” “চাঁদের বুড়ি দেখতে কেমন?” “তুমি কী কথা বলার জন্য আর কিছু পাচ্ছ না?” “আহা ! বলোই না, বুড়ি দেখতে কেমন?” “কুৎসিত।” “বুড়ির হাতে একটা কাঁথা আছে তাকি তুমি জানো?” “না জানি না।” “সেই কাঁথা যুগযুগ ধরে বুড়ি সেলাই করার চেষ্টা করছেন অথচ সেলাই শেষ হচ্ছে না।” “ভালোই তো।” “আমি এত কিছু কীভাবে জানি তোমার জানতে ইচ্ছে করে না?” “আমি জানতে না চাইলেও তুমি বকর বকর করতে থাকবে আমি জানি।” “তুমি ঠিকই ধরেছ। তোমাকে একটা গোপন কথা বলি শোনো। আমি তোমার স্ত্রী আয়েশা নই।
আমি চাঁদের বুড়ি। তোমার পাশে তোমার স্ত্রীর রুপ ধারন করে শুয়ে আছি।” “প্লিজ ঘুমাও। এত ছেলেমানুষী কথা কীভাবে বলো তুমি?” “তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না কেন?” “বিশ্বাস করার মত কথা হলে অবশ্যই করতাম।” “তুমি চাইলে সত্যতা যাচাই করতে পারো। তুমি আজ অফিস থেকে ফেরার আগে তোমার স্ত্রী মায়ের অসুখের খবর পেয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। রাস্তায় তার ব্যাগ ছিনতাই হওয়ায় সে আর তোমাকে ফোন-টোন দিতে পারেনি। তুমি এখন বিছানা থেকে ওঠ। তোমার শ্বশুর বাড়ির কারোর নাম্বারে ফোন দাও। তোমার শ্বাশুড়ি হাসপাতালে কেমন আছেন খবর নাও। আমারতো মনে হচ্ছে না তিনি বাঁচবেন।” আয়েশার প্রতি রাতে বানানো গল্প শুনতে আমার খুবই বিরক্ত লাগে।
আজ তাকে কিছু কঠিন কথা বলতে যাচ্ছিলাম সাথে সাথে বালিশের নিচ থেকে ফোনের রিং বেজে উঠল। আমি মোবাইল অন্ধকারে হাতে নিয়ে দেখি আমার শ্যালিকা আনিকার নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। আমি রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে আয়েশার কাঁদো কাঁদো কন্ঠস্বর ভেসে এল। আয়েশা বলল, “তুমি এমন কেন গো। তুমি এমন কেন? অফিস থেকে ফেরার পর কী তোমার একবারও আমার খোঁজ করার কথা মনে পড়েনি? আমার মাকে হাসপাতাল পর্যন্ত আনার আগেই তিনি পরপারে চলে গেলেন আর আমি বুঝতেও পারিনি। তুমি চলে এসো। এখুনি চলে এসো।”
আয়েশা এখন হাউমাউ করে কাঁদছে। আমার সমস্ত শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তখনও আমার শরীরের উপর পাশের মানুষটির ঠাণ্ডা হাত অনুভূতি হচ্ছে। তার নিশ্বাসে আমার শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের হালকা আলো জানালা থেকে এসে পাশের মানুষটির মুখের উপর পড়ছে। আমি কোনোমতে তার দিকে ঘাড় ঘুরালাম। সে অবিকল আয়েশার মত মুচকি করে হাসলো।