তাঁবুর ভেতর থেকে একটি ডাক এলো ‘এই মাইয়া এইদিকে আয়।’ মুনিয়া টুকরিতে একদলা গোবর রেখে মাথা তুলে তাঁবুর দিকে তাকাল। বিল পাহারাদার তৈয়ব মিয়া ডাকছে তাকে। গোবরের টুকরি আবার মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে তাঁবুর দিকে যায় মুনিয়া। লুঙ্গি পরনে মধ্যবয়স্ক তৈয়ব মিয়া বের হয়ে বলল, ‘ইয়াল্লা, এই দুপুরে মাটি ফাটা রইধে গোবর খুঁজতে বের হইছো মা? রইধে মুখখানা লাল হইয়া গেছে। তাঁবুর ভিতরে আইয়া কিছু সময় জিরান লইয়া যাও মা।’ কথাগুলো বলে তৈয়ব মিয়া নিজেই মাথা থেকে টুকরি নামিয়ে মুনিয়াকে তাঁবুর ভেতর নিয়ে গেলেন। মুনিয়ার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে। সে থুতনি বুকের সাথে লাগিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
তৈয়ব মিয়া বোতল থেকে স্টিলের গ্লাসে পানি ঢেলে বললেন ‘খাও মা পানি খাও।’ মুনিয়ার সত্যিই পানির পিপাসা আর পেটে ক্ষিধে আছে। গ্লাস হাতে নিয়ে একটানে পানি খেয়ে নিল। তৈয়ব মিয়া হাত ধরে খানিক টান দিয়ে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে কেন মা, আয় ব এখানে, এই নে কলা খা।’ বালিশের পাশে রাখা এক হালি কলা থেকে একটি কলা তার দিকে দিলেন। মুনিয়া লজ্জায় নিতে চাইছে না। তৈয়ব মিয়া মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘নেও মা নেও, শরমিন্দার কি আছে কও। তুমি পত্তেক্দিন গোবর খুইজতে আইলে তাঁবুতে আইয়া জিরান লইও।’ লোকটির এমন আহ্লাদ মাখা কথায় মা হারা মুনিয়ার কেমন জানি কান্না কান্না ভাব হচ্ছে। মুনিয়া কলা হাতে নিয়ে খেতে লাগল। তৈয়ব মিয়া তাঁবু থেকে খানিক মাথা বের করে চারদিকে তাকালেন। বেশ দূরে একটি রাখাল ছেলে গরু চড়াতে চড়াতে এদিক আসছে। তৈয়ব মিয়া আবার মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে মুনিয়ার থুতনিতে হাত দিয়ে আদরমাখা গলায় বললেন, ‘আইজকা যাও মা, পত্তেকদিন আইও।’
মুনিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। তারপর তাঁবু থেকে বের হয়ে টুকরি মাথায় তুলে আবার গোবর খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। অনেক দূরে একদল গরু দেখে মুনিয়া সেদিকে যাচ্ছে। সৎ মা লতিফা বেগম জানিয়ে দিয়েছেন গোবর বেশি করে আনতে। নিজের রান্নাবান্নার জ্বালানি শেষে অতিরিক্ত গোবরের মুইট্টা বিক্রি করা হবে। মুনিয়া সেখানে গিয়ে দেখল বেশকিছু গোবরের দলা। সে মাথা থেকে টুকরি নামিয়ে গোবরে হাত দিতেই শুনল, ‘কোন চুন্নিরে আমার গরুর গোবর চুরি করে?’ মুনিয়া মাথা তুলে চারদিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ গাছের দিকে চোখ পড়ায় ফিক করে হেঁসে ফেলল। লাটিম গাছের ঢালে পা দুলিয়ে বসে আছে মিলইন্না রাখাল।
তার নাম অবশ্য মিলইন্না নয়। তার নাম হচ্ছে মোহাম্মদ মিলন উদ্দিন। কিন্তু এই ধরনের ছেলেপেলের নাম রতন হলে রতইন্না মিলন হলে মিলইন্না ডাকতে লোকজন এক ধরনের আরামবোধ করে। ছেলেটিকে মুনিয়ার বেশ আপন মনে হয় যদিও বয়সে অনেক বড়। মুনিয়ার বয়স সবেমাত্র বারো – তেরো আর মিলইন্না রাখালের সতেরো – আঠারো হবে। এতক্ষণে লাটিম গাছ থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল, ‘মুনিয়া তর গরু কই দেখওন যায় না যে।’ মুনিয়া অনেকদূরে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘ঐ যে।’ মুনিয়া টুকরি মাথায় নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। মিলইন্না পেছন থেকে বলল, ‘কি ব্যাপার মুনিয়া, যাইবার লাগছস যে? দুইজন গল্প করি ব।’
‘তাড়াতাড়ি যাওন লাগব মিলন দা, গরুরে পানি খাওয়াইয়া জায়গা পরিবর্তন কইরা দেওন লাগব।’ মুনিয়ার বাড়ি ফিরতে ফিরতে জোহরের আজান হয়ে গেল, ক্ষিধায় পেট চুঁচুঁ করছে। গোবরের টুকরি নামিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে দেখল সৎ মা ঘুমোচ্ছে। রান্নাঘরে যেয়ে প্লেট হাতে নিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা সরিয়ে দেখে ভাত নেই। মুনিয়া প্রচন্ড রাগে চেঁচিয়ে বলল, ‘সে কি, সকালে নিজে চাইরজনের ভাত রাইন্ধা গেলাম এখন হাঁড়ির তলা দেখা যাচ্ছে, ওমা মা, মাআআআ।’লতিফা বেগম হকচকিয়ে ঘুম থেকে উঠে বললেন, ‘বলি বাড়িতে কি ডাকাত পড়েছে রে মুনিয়া, দেখছিস বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে ঘুমাইচ্ছি, আর তুই চেচাঁমেচি শুরু কচ্ছিস।’ ‘চেচাঁমেচি কি আর স্বাদে কচ্ছি মা, ক্ষিধায় পেট চুঁচুঁ কচ্ছে হাঁড়িতে ভাত নাই।’ ‘বলি চেচাঁমেচি করে কি ভাত আইব। ভাত রাইন্ধা গেলি চাইরজনের, দুপুরে হঠাৎ তর বাপ আইছে, তর ভাত খেয়ে এখন সে বাইরে চইল্লা গেছে। ভাত চাট্টা বাসাইদে ফুটতে কতক্ষণ।’
মুনিয়ার ভেতরে ভেতরে আন্দোলন হলেও কোনো কথা না বলে রান্নাঘরে চলে গেল। হাঁড়িতে চাল নিতে নিতে সে আপন মনে বিড়বিড় করছে, ‘সিলান বেটি তর জামাই যক্কন ভাত খাইয়া ফেলাইছে চেপ্টা লাইগা না ঘুমাইয়া ভাত বসাইতে পারস না। আমি বন থাইকা আইয়া রাইন্ধা খাওন লাগে।’ ততক্ষণে মুনিয়া লক্ষ করল বাবা হোসেন মিয়া রান্না ঘরে এসে বিড়ি ধরাচ্ছেন। বিড়ি ধরিয়ে বদনা হাতে তিনি টয়লেটে যাচ্ছেন। হোসেন মিয়া এখন টয়লেটে বসে বসে বিড়ি টানবেন। উনার ধারণা বিড়ি টানলে টয়লেটের কাজটি ক্লিয়ার ভাবে হয়। মুনিয়া তাড়াহুড়ো করে ভাত রান্না শেষ করছে। কারণ খাওয়াদাওয়া করে গোবর দিয়ে মুইট্টা দিবে সে, তারপর গোসল করে সন্ধ্যার আগে গরু আনতে যেতে হবে। অবশ্য হোসেন মিয়া যখন বাড়িতে এসেছেন বলা যায় না গরু আনতে তিনিও যেতে পারেন।
রাতের খাবার শেষে হোসেন মিয়া স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। মুনিয়া গেল গরু ঘরের পাশের রুমে। প্রায় রাতেই মুনিয়ার ঘুম আসে না। তখন চুপচাপ গরু ঘরের দরজা খুলে হারিকেন নিয়ে সেখানে যায়। খানিক্ষণ সেখানে থাকার পর আবার ঘুমোতে যায়, কিন্তু ঘুম আসে না। তারপর আবার চুপচাপ দরজা খুলে বাহিরে যায়। চারদিকে তখন পিনপতন নীরবতাকে ফালাফালা করে ঝিঝি পোঁকার ডাক শুনা যায়। মুনিয়ার সেদিন এই ডাকও ভালো লাগে না। কেমন উদাস গুমোট ভাব চেহারায় চলে আসে। নিজেকে সবার থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন মানুষ লাগে নিজেকে। যখন স্কুলে পড়তো তখন কিছুটা ভালোই দিন কেটে যেত। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পর পড়ালেখা আর হল না।
মুনিয়ার এই ঘুমহীন একলার রাতে মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। টিনে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ শুনা যাচ্ছে এখন। মুনিয়া চুপচাপ দরজার খিল খুলে বারান্দায় পা রাখার সাথে সাথে কেমন শীতল বাতাস গায়ে মেখে গেল। খানিক আগেও আকাশে গুমোট বাঁধা মেঘ ছিল তারপর এলোমেলো বাতাস বইতে বইতে বৃষ্টি। সেদিন রাতেও বৃষ্টি ছিল। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে মুনিয়া। বাবা গেছেন হাওরে মাছ ধরতে। মা খুব ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন। নানার টেপ রেকর্ডারে শুনে শুনে নাকি মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। টিনে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ হচ্ছে, সে আদুরে বিড়ালের মতো মায়ের বুকে মুখ গুজে আছে। তখন ঘুম পাড়ানোর জন্য মা রবীন্দ্র সংগীত ধরলেন, “মেঘের পালক চাঁদের নোলক কাগজের খেয়া ভাসছে ধুক ধুক বুক চাঁদ-পানা মুখচিলেকোঠা থেকে হাসছে। মেঘের বাড়ীতে ভেজা ভেজা বান তা থৈ তা থৈ বরষা কাক ভেজা মন জল থৈ থৈরাত্তির হলো ফরসা।
আমি তুমি আজ একাকার হয়ে মিশেছি আলোর বৃত্তে মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কি যে নাচে গান শুনতে শুনতে মুনিয়া গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে যায়। গানের কোনো কথা না বুঝলেও “কাগজের খেয়া ভাসছে” খুব বুঝে সে। সকাল ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে ঠিক বায়না ধরতো কাগজের খেয়া বানিয়ে দেবার জন্য। পরেরদিন মুনিয়া আবার টুকরি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আকাশে ঝকঝকে রোদ। সকালে বের হলে গোবর পাওয়া যায় না। দুপুরবেলা এর জন্য মোক্ষম সময়। গোবর কুড়াতে কুড়াতে তাঁবুর সামনে চলে এসেছে মুনিয়া। খানিকটা পানির পিপাসা পেয়েছে। তাঁবুতে গেলেই হয়, তৈয়ব মিয়া খুব আদর করে পানি দিবেন৷ কিন্তু মুনিয়ার নিজ থেকে যেতে কেমন লজ্জা লাগছে। লোকটি ডাক দিলে অবশ্য যেতে পারতো। তখনই তাঁবুর পর্দা সরিয়ে তৈয়ব মিয়া বের হয়ে এলেন। মুনিয়াকে দেখে বললেন, ‘আরে মা আইছ, যাও তাঁবুতে বও গিয়া মা। আমি আসছি।’ মুনিয়া ধীরে ধীরে তাঁবুর ভেতর যায়। তৈয়ব মিয়া একটি গাছের আড়ালে প্রস্রাব করে উঠে চারদিকে তাকিয়ে আবার ভেতরে চলে গেলেন। মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহারে, এত্ত রইদ্দের মইধ্যে তোমার কষ্ট হয় না মা?’ কথাটা বলে তৈয়ব মিয়া স্টিলের গ্লাসে পানি ঢেলে বললেন, ‘পানি খাও মা পানি খাও।’
মুনিয়া একটানে পানি খেয়ে ফেলে। অনেকদিন হল এতো আদর করে কেউ কথা বলে না মুনিয়ার সাথে। এই লোকটির এমন আহ্লাদ মাখা মা মা ডাকে মুনিয়ার ভেতর কেমন তোলপাড় করা কান্না আসছে। তৈয়ব মিয়া এবার হাতে ধরে বললেন, ‘বও মা এখানে বও, শরমের কিছু নাই। তোমার লাহান আমার একটা মাইয়া আছে। বউ বাচ্চা রাইখা এইহানে পাহারাদারি করি।’ তৈয়ব মিয়া কথাগুলো বলে ব্রেড আর কলা রাখলেন মুনিয়ার পাশে। তারপর নিজেই কলার খোসা ছাড়িয়ে বললেন ‘খাও মা খাও।’ তারপর ব্রেড এক পিস দিয়ে বললেন ‘এই নেও মা ব্রেডও খাও।’
মুনিয়া লোকটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এই জগতে কিছু ভালো মানুষের আড়ালে শয়তান থাকে। মুনিয়ার মনে হল এই লোকটি মানুষের আড়ালে ফেরেশতা। সরাসরি এতো আদর করলে মুনিয়ার চোখে জল এসে যায়। এখন মুনিয়া চোখের জল খুব যুদ্ধ করে সামলাচ্ছে। তৈয়ব মিয়া মুনিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মুনিয়া বাচ্চা মেয়েদের মতো কলা আর ব্রেড খাচ্ছে। তৈয়ব মিয়ার হাত ধীরে ধীরে মাথা থেকে পিঠে চলে এসেছে। হাত সময়ে সময়ে জায়গা পরিবর্তন করছে। তৈয়ব মিয়া খানিক পর মুনিয়াকে কোলে টেনে এনে বললেন, ‘এই রইদ্দে গোবর কুড়াতে তোমার কষ্ট মা? আহারে মুখখানা লাল হইয়া গেছে’ বলে তৈয়ব মিয়া মুখটা ছুঁয়ে দেন। মুনিয়ার ধীরে ধীরে অস্বস্তি বাড়তে থাকে। তৈয়ব মিয়া আচমকা মুনিয়ার পেটে এক হাত আর বুকে আরেক হাত দিয়ে গালে চুমু খেয়ে নিলেন। মুনিয়া এবার নিজেকে ছাড়ানোর জন্য গা মোচড়াতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে একটি জঘন্য অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হতে শুরু করছে সে। লজ্জায় মুনিয়ার মুখ থেকে কথা বের হয় না। লোকটির দিকে তাকাতে পারছে না এখন। তৈয়ব মিয়ার কাজ ধীরে ধীরে আগাতে থাকে। মুনিয়া এবার ছাড়েন বলছি ছাড়েন বলে হাত
– পা ছুড়াছুঁড়ি শুরু করেছে।
মিলইন্না রাখাল ভেবে পায় না মুনিয়া এই তাঁবুর ভেতর এতক্ষণ কী করে? সে লাটিম গাছের উপর থেকে মুনিয়াকে এখানে ঢুকতে দেখেছে। এই তাঁবু কী মুনিয়ার পরিচিত কারও? মিলইন্না রাখালের আর তর সয়না। সে লাটিম গাছ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে গরু তাড়ানোর লাঠি হাতে এদিকে দৌড়ে আসে। খানিক দূরে থাকতেই মুনিয়ার চিৎকার কানে আসে মিলইন্না রাখালের। তার দৌড়ের গতি আরও বেড়ে গেছে। তাঁবুর পর্দা সরানোর সাথে সাথে তৈয়াব মিয়া সতর্ক হয়ে যায়। এতক্ষণ মুনিয়ার কাপড় খোলার জন্য টানাটানিতে ব্যস্ত ছিল সে। মিলইন্না তৈয়ব মিয়ার দিকে তাকিয়ে মুনিয়াকে ধরে বলল, ‘কি হইছে মুনিয়া?’
মুনিয়া লজ্জায় কোনো কথা বলতে পারে না। থুতনি বুকের সাথে লাগিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মিলইন্না রাখালের বুঝতে আর বাকি থাকে না। সে আচমকা হাতের লাঠি দিয়ে তৈয়ব মিয়াকে বাড়ি মারে। বাড়িটা গিয়ে লাগে গাঢ়ে। তৈয়ব মিয়া পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তাঁবু থেকে বের হয়ে দৌড়ায়। মিলইন্না রাখাল পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে অশ্রাব্য গালিগালাজ ছুঁড়ে দেয় ‘এরে রে বদমাইসের বাচ্চা দাঁড়া, আইজকা এই লাঠি তর পাছা দিয়া না ঢুকাইলে আমার নাম মিলইন্না রাখাল নায়।’
দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন থেকে বেশ কয়েকটা বাড়ি তৈয়ব মিয়ার মাথা আর গাঢ়ে লাগে৷ মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তৈয়ব মিয়া হাত দিয়ে চেপে ধরে দৌড়াচ্ছে। সামনে একটি খাল তারপর আরেকটি গ্রাম। তৈয়ব মিয়া খালে লাফ দিয়ে পড়ে জান বাঁচায়। তারপর বিল পাহারাদারি ফেলে গ্রাম ছেড়ে চিরতরে পালিয়ে যায় সে। এতক্ষণ তাদের পেছন পেছন দৌড়ে এসেছে মুনিয়া। মিলইন্নার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মিলন দা এইবার চল তো অনেক হইছে।’ দু’জন আবার তাঁবুর কাছে এসে গোবরের টুকরি নিয়ে লাটিম গাছের দিকে চলে যায়। লাটিম গাছের নীচে দু’জন অনেক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর মিলইন্না বলল, ‘তাঁবুর ভিত্রে কেন গেছিলে মুনিয়া।’ ‘পানি খাওনের লাইগা।’ ‘আচ্ছা যা, আইজকা বাড়িতে চইলা যা।’ মুনিয়া বাড়িতে চলে আসে। বাবা হোসেন মিয়া আবার চলে গেছেন কাজে। কোনদিন আসবেন ঠিক নেই। কৃষি কাজের সময় কেবল গ্রামে থেকে জমিজমা করেন।
রাতে ঘুমানোর আগে দিনের সবকিছু চোখের সামনে ভাসতে থাকে মুনিয়ার। মিলন দা লাঠি হাতে তৈয়ব মিয়াকে দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে, ‘এরে রে বদমাইশের বাচ্চা, তরে ধরতে পারলে এই লাঠি পাছা দিয়া ঢোকামু’ কথাটা মনে পড়তেই মুনিয়া ফিক করে হেঁসে ফেলল। তারপর এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। মাঝরাতে আচমকা পাশের ঘরে ছোট ভাইয়ের কান্না শুনে ঘুম ভেঙে গেল মুনিয়ার। ঘুম থেকে উঠে মুনিয়ার মনে পড়লো সে একটি স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নটার কোনো মানে বুঝতে পারছে না। সে আর মিলইন্না একটি বিছানায় শুয়ে আছে। মাঝরাতে মিলইন্না বলল, ‘মুনিয়া খালে জাল পাইতা যে আইলাম, জাল তুইল্লা লইয়া আহি, না হইলে চোর নিবগা মাছ আর জাল।’
মুনিয়া তখন বায়না ধরলো, ‘তাইলে আমিও যামু তোমার লগে। রাত্রে ত আর কেউ দেখবো না, আমি ডিঙি নাওয়ে খালি বইসা থাকুম নে।’ ‘না মুনিয়া, মা বুঝতে পারলে গাল্লাইবো। রাত্রে খারাপ বাতাস লাগতে পারে তুমি মাইয়া মানুষ।’ ‘না কিচ্ছু হইব না, আমি যাইমু তোমার লগে।’ তারপর দু’জন চুপচাপ ঘর থেকে বের হল। চারদিকে পিনপতন নীরবতা, ঝিঝি পোঁকার ডাক শুনা যাচ্ছে। মিলইন্নার হাতে লগি আর মুনিয়ার হাতে হারিকেন। মুনিয়াকে ধরে ডিঙি নাওয়ে তুলছে মিলইন্না। তখন কান্না শুনে মুনিয়ার ঘুম ভেঙে গেল।
পরেরদিন আবার রোজকার মতো দিন শুরু হয় মুনিয়ার। সকালে বনে গরু নিয়ে যাওয়া। বাড়িতে এসে রান্নাবান্না করা। তারপর দুপুরে যখন গোবর খুঁজতে গেল তখন গিয়ে দেখল লাটিম গাছের নীচে একটা টুকরিতে গোবর রাখা। মুনিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। এদিকটার গোবর আর কেউ কুড়িয়ে নিলে সে এখন সারা বন ঘুরে কুড়াতে হবে। মিলইন্না এতক্ষণে গাছ থেকে নেমে বলল, ‘মুনিয়া আমি তর লাগি গোবর কুড়াইয়া রাখছি।’
মুনিয়া বলল, ‘কেন মিলন দা?’ মিলইন্না কি বলবে খুঁজে পেল না। শুধু বলল, ‘ব মুনিয়া গল্প করি, গোবর খুইজ্জা যতক্ষণ যাইতু এইসময় লাটিম গাছের ছায়ায় বইয়া যা।’ এরপর প্রতিদিন মুনিয়া গোবর কুড়াতে এসে দেখে লাটিম গাছের নীচে একটা টুকরি রাখা। আর মিলন দা লাটিম গাছে পা দুলিয়ে বসে মুচকি হাসছে। এভাবে দিনকে দিন দুজনের বুকে আশার বাসা বাঁধে, মুখে ভালোবাসার রূপক ভাষা ফুটে।’