বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি

বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি

-“বিশ লক্ষ টাকা লাগবে।”

-“(অবাক হয়ে) কিন্তু আমিতো লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছি।কত কষ্ট করে দিনরাত পরিশ্রম করে পাশ করেছি আর আপনারা বলছেন চাকরি করতে হলে টাকা লাগবে?”

-“(বিরক্তির স্বরে) দেখুন,আমাদের যা বলার আপনাকে বলেছি।এখন আপনার ইচ্ছে।টাকা দিলে যোগাযোগ করবেন আর না দিলে অন্য কারোর কাছে এই সুযোগটি চলে যাবে।এ পর্যন্ত সবাই এ নিয়ম মেনেই চাকরি করছে।টাকা দিলে চাকরি আছে না দিলে চাকরি নেই।”

-“(রাগান্বিত স্বরে) নিয়ম?!!!!!! হাহ!!!! এসব বেআইনি নিয়ম আপনাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই আপনারা তৈরি করেন।টাকা দিয়ে যদি চাকরি কিনি,তাহলে আমার চাকরির দরকার কি?

তাহলে সার্কুলারে চাকরির নিলাম তুলতেন ‘বিশ লাখ বিশ লাখ’ লিখে।আমরা টাকা নিয়ে আসতাম চাকরি কেনার জন্য।হাজার স্বপ্ন চোখে নিয়ে আর এক বুক আশা বুকে নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে আসতাম না।”

-“(রেগে গিয়ে) এই আপনি এখান থেকে যান তো।অনেক্ষণ ধরে আপনার ফালতু বকবক শুনছি।এখনি এখান থেকে বেরিয়ে যান।চাকরি করার ক্ষমতা নেই আবার বড় বড় লেকচার।”

অতঃপর আমি হতাশ হয়ে সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম।জীবনে কখনও কাঁদিনি।কিন্তু আজ আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারলামনা।চাকরির স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার সাথে সাথে আমার আর বাকি সব স্বপ্ন,আশাও ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।কি করব আমি?কোথায় যাব?

আমি রিমন।অনার্স,মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছি।সেভাবেই নিজেকে তৈরি করছিলাম।সার্কুলার দেখে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম।ভাগ্যক্রমে পাশও করলাম।যখন পাশের খবর বাসার সবাইকে আর আমার ভালবাসার মানুষ মহুয়াকে জানালাম,তাদের খুশি দেখে মনে হয়েছিল আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ।

এখন আমি কোন মুখ নিয়ে বাসায় যাব?কি জবাব দিব তাদেরকে?তারা যে সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।আমার দুঃখিনী মা,প্যারালাইসিস বাবা,কলেজে পড়ুয়া ছোট ভাই তারা যে বড় আশা করে আছে আমি বিসিএস ক্যাডার হব।আমাদের সংসারের সব অভাব তখন দূর হয়ে যাবে। মহুয়াকে আমি প্রচন্ড ভালবাসি।আমার বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পেছনে ওর অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল।মহুয়াই আমাকে সবরকম সাজেশন,বই,নোট জোগাড় করে দিয়েছিল।

ওর পরিবার যখন আমাদের চার বছরের ভালবাসার সম্পর্ক জেনে যায়,তখন মহুয়ার বাবা আমাকে তাদের বাসায় ডেকে নিয়ে একটিই শর্ত দেয়।আমি যদি বিসিএস ক্যাডার হতে পারি তাহলেই আমার হাতে মহুয়াকে তুলে দিবে।কারণ মহুয়ার বাবার অনেক ইচ্ছে তার একমাত্র মেয়েকে কোনো বিসিএস ক্যাডার পাত্রের হাতে পাত্রস্থ করবে।সেটি আমি হই বা অন্য কেউ। তাহলে কি আমি মহুয়াকে পাব না?আমার এই অপারগতার কথা শুনে মহুয়ার বাবা মহুয়াকে এর মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিবে।

উফফ!!!!!! আমি আর কিছু ভাবতে পারছিনা।চাকরি করতে হলে বিশ লক্ষ টাকা দরকার।কোথায় পাব?কি করব?কিডনিতে একটু সমস্যা আছে আমার।তানাহলে কিডনি বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করতে পারতাম।তাছাড়া গ্রামে আমাদের কোনো জমিও নেই যে বিক্রি করব।এইদিকে মা,বাবা,ছোট ভাই,মহুয়া উফফফফ আল্লাহ!!!!!!!!! নাহ।এই ব্যর্থ জীবন রাখার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল।এই রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।গাড়ি এসে চাপা দিবে ব্যাস…..আমিও থাকবনা আর আমার কোনো আফসোসও থাকবেনা।

এইভেবে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ালাম।জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে আমার।ঠিক তখনি বাবার মুখটা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে।বুকটা চিনচিন করে ব্যাথা করছে।আমি মরে গেলে আমার মা,বাবাও মরে যাবে।আমিই যে তাদের সকল আশা-ভরসা। সামনে দ্রুতগতিতে একটি বাস আসছে।সবকিছু কেন যেন এলোমেলো লাগছে বাস…মা….বাবা….চাকরি….ভাই….মহুয়া….আমি……কি যেন….কি যেন…..

নাহ!!!! পারলাম না।ওদের জন্য মরতে পারলাম না।দ্রুতবেগে সরে গেলাম রাস্তা থেকে।ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে বুকে হার্টবিট করা জায়গায় হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছি।জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হল আজ। পাশে তাকিয়ে দেখি হাত-পা বিহীন এক অসহায় লোক ঘুমাচ্ছে।তা দেখে আমি বেঁচে থাকার সাহস পেলাম।কারণ আল্লাহ আমাকে সবকিছুই দিয়েছে।দুই হাত,দুই পাও আছে।এই লোকটির চাইতে তো আল্লাহ আমাকে অনেক ভাল রেখেছে।

আমাকে বাঁচতে হবে আমার জন্য।আমার মা-বাবা,ভাইয়ের জন্য।জানিনা মহুয়াকে পাব কিনা।তবে ভাগ্যকে মেনে যে নিতেই হবে।আত্মহত্যা সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারেনা তা আমি খুব ভাল করেই বুঝেছি। আমার কাছে আমার সততাই হচ্ছে একমাত্র পন্থা।আমার দৃঢ় বিশ্বাস,আমি আমার নূন্যতম জ্ঞান দিয়ে সততার সাথে কাজ করলে আমার কোনো কাজই বিফলে যাবেনা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত