পড়ন্ত বিকেলে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন পার্কে চলে আসছি খেয়াল করিনি! আম্মু মারা যাবার পর মাঝে মাঝেই একা একা পার্কে বসে থাকি। আম্মুর কথা ভাবতে ভাবতে পাশে পিচ্চি একটা মেয়ের কথায় আমার ভাবনা আটকে গেল-
-স্যার ও স্যার ফুলগুলো নেন! নিন না, মেডামকে গিফট দিলে খুশি হবে। নিন না স্যার! মেয়েটার কথাতে অসহায়ের করুণ সুর ঝরে পড়ছে, চেহারাটাও মলিন মুখে কোন হাসি নেই একটা আধময়লা ছেঁড়া জামা পরে আছে। মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে মেয়েটাকে না দেখলে আমি বুঝতে পারতাম না! হঠাৎ আমার চোখের সাথে মেয়েটির অসহায় চোখ আটকে গেল! চারটি চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। আমার চোখের ভাষা হয়তো মেয়েটি বুঝতে পারেছিল তাই আমার কাছে এসে বললো –
-আফা ফুলগুলো নেন না আমার টাকার খুব দরকার।
করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একগোছা গোলাপ ও কিছু বেলীফুলের মালা নিয়ে। এরা খুব চালাক হয়, না হলে, এতো ছোট বয়সে গার্লফ্রেন্ডকে ফুল দেওয়ার কথা রপ্ত করার কৌশল, জানত না। মেয়েটার বুদ্ধির একটু পরিক্ষা করতে পারি! তোর নাম কিরে? মেয়েটা উত্তর দিল – আমার নাম সুমি। বাহ্! খুব সুন্দর নাম। আচ্ছা সুমি ফুলগুলো আমি কাকে দিবো, আমি তো মেয়ে আমার তো মেডাম নেই? মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো আপনার মাকে দিতে পারেন! টাইটানিক জাহাজ যেমন বরফ খন্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেছিলো! আমার ভিতরটাও ছোট মেয়েটার কথায় ভেঙে গেল কারণ আমার মা নেই। কিন্তু গোলাপ কি শুধু গার্লফ্রেন্ড ও মাকেই দিতে হয়? বোনকে দেওয়া যায় না? ব্যাগ থেকে একশো টাকা বের করে বললাম,
-এই নে। কত দাম এগুলোর ? ও দাম হিসেব করতে যাবে, এমন সময় আরেকটা পিচ্চি মেয়ে এলো। মেয়েটি সুমিকে বললো- এই সুমি! তুই নাকি কালকের ফুল বিক্রির টাকা হারিয়ে ফেলেছিস, তোকে নাকি মামা খুব মারছে? সুমি কোন কথা বললো না মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটাও আর কোন প্রশ্ন করেনি চলে গেল।
-মেয়েটিকে?
-ওর নাম জরি! আমার সই! আমি সুমিকে চারশ টাকা দিয়ে বললাম এটা তুই রাখ! সুমি দেড়শ টাকা রেখে বাকী টাকাটা আমাকে ফেরত দিতে চাইলো।
-টাকাটা তুই নিচ্ছিস না কেন? আমি খুশি হয়েই তোকে দিচ্ছি!
-এমনি আফা। এই নিন বাকি টাকা।
-তুই কালকে যে টাকা হারিয়েছিস সেটা দিয়ে দিবি কেমন।
-আজকে দিলেই কি আর হবে মাইর তো কালকে খেয়েই ফেলছি!
-তুই স্কুলে যাস?
-না। তবে আমি যে বস্তিতে থাকি সেখানের পোলাপানের পুরোনো বই ফেলে দিলে, সেগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে পড়ি।
-ও! তুই স্কুলে যাসনা, তোর বাবা-মা বকে না বুঝি?
-বাবা মা নেই আফা।
-নেই মানে?
-আগে একটা খালা ছিল। কিন্তু এখন তাকে দেখি না।
-মানে? এখন দেখিস না কেন? তোর মা মারা গেছেন?
-আমার আসল বাবা-মা মারা গেছে!
ঐযে ঐখানে যে ময়লা গুলো আছে, সেখানে আমার চাচারা ফেলে রেখে গেছিল ছোটবেলায়। তারপর এই খালাটা আমায় নিয়ে বড় করেছে। তার নিজেরও তিনটে ছেলেমেয়ে। খালু আমায় নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া করতো খালার সাথে। তাই ঐ খালাটা আবার আমাকে ঠিক ঐখানেই রেখে কোথায় যেন চলে গেছে? আর দেখি না।
-তাই তুই ফুলগুলো বিক্রি করে বেঁচে আছিস?
-না আফা। এই ফুলগুলো দোকানদারে ফুল। সব বিক্রি করলে তিনি আমাকে দুপুরে খেতে দেন।
-দুপুরে খেতে দেন মানে? আর রাতে, সকালে কী খেয়ে থাকিস?
-খাই না আফা। সেন্টারের অনুষ্ঠানগুলোতে মাঝে মাঝে খাবার বেঁচে যায় সেগুলো খাই! তবে আরও টোকাই আছে তাই পেট ভরে সব সময় খেতে পারি না। কখনো কখনো ডাস্টবিনে ভালো শুকনো খাবার খুঁজে পেলে, তাই খাই। চোখ ফেটে কান্না এলো, ধরে রাখতে পারলাম না। একি শুধুই সুমির জন্য নাকি মা হারানোর যন্ত্রনায়? ওর নোংরা মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
-দু’বেলা না খেয়ে থাকিস কী করে? চল সামনের রেঁস্তোরাতে কিছু খাবি। দেখলাম সুমির মুখে সহস্র শতাব্দীর লুকিয়ে থাকা হাসিটা সকালের সোনা রোদ্রের মত ঠিকরে বেরুলো!
-সুমি! কী খাবি বল?
– আফা কোন দিন বড় মাছের মাথা খাইনি। যদি দিতেন আবারও চোখের বাঁধ ভাঙল। কত সীমিত চাহিদা এদের।
-অত কথা বলিস কেন? যা ইচ্ছে খা না। সেদিন সুমিকে খাইয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তার জুড়ি মেলা ভার। পরদিন বাইরে বেরিয়েছি, দেখি ও একটা জারবাড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে।
– আফা এটা আপনার জন্য কিনছি!
-সুমি! খবরদার, এসব আর কখনো করবি না। আমি এসব ফুল দিয়ে কি করব, তুই বিক্রি করে টাকা পাবি। তোর খিদে পেয়েছে?
-নিন না আফা। না হলে আমি কষ্ট পাব।
-ঠিক আছে। আজ নিলাম।
কিন্তু আর কিনবি না, ঠিক আছে? তোর মুখ ভীষণ শুকনো দেখাচ্ছে। কিছু খাসনি সকাল থেকে, না !! চল, কিছু খাবি। এরপর থেকে প্রতিদিনই বাসা থেকে খাবার নিয়ে ওকে খাওয়াতাম। সেই তৃপ্তি ভাষায় বলা কঠিন। আর ও প্রতিদিনই বারণ করতো। শেষমেশ আমার চাপে পরে খেতে হতো। দেখতাম ও আমার জন্য অপেক্ষা করত প্রতিদিন। এই বাচ্চা মেয়েটার কষ্ট দেখে আমি আমার নিজের কষ্ট ভুলে যেতাম! আমার তো শুধু মা নেই, আর সুমির আপন বলতে কেউ নেই! বড্ডো ভালবেসে ফেললাম সুমিকে।
মানুষের জীবনে কতরকম ভাবেই প্রেম আসে। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। পুরোনো ছেঁড়া পোশাক বাদ দিয়ে, আমার দেওয়া লাল টুকটুকে ফ্রক পরে একটা বাগানে লাল প্রজাপতির মত খিলখিল করে হাসছে আর ওড়ে বেড়াচ্ছে। চারপাশে আনন্দের লহর যেন গানের মতো মিষ্টি সুরে ঝংকৃত হচ্ছে ওর হাসির সুরে। একসময় উপলব্ধি করলাম, ওকে না দেখতে পেলে আমার হৃদয় যেন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। আমি যেন কোথাও একটা হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করে আমার জ্বর হলো প্রচণ্ড রকমের জ্বর! আমি সুমির কাছে যেতে পারছি না খুব মিস করতেছি মেয়েটাকে, আজকে একবার দেখা করতেই হবে। আমি জ্বর নিয়েই গেলাম সুমির কাছে! দূর থেকেই দেখতে পেলাম সুমি চুপটি করে বসে আছে! আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো –
-আমি জানতাম তুমি ঠিক আসবে আমার কাছে কারণ আমি জানি তুমি আমাকে ভালবেসে ফেলেছ!
-তোকে কে বলছে আমি আসবো না, আমি সুমির ময়লা কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলাম!
-ওমা! আফা তোমার তো মেলা জ্বর! বলেই সুমি কান্না শুরু করলো।
-ধূর! পাগলী আমার তেমন কিছু হয়নি! কান্না বন্ধ কর না হলে আমি চলে যাবো। মায়াবী দৃষ্টিতে চোখের দিকে তাকিয়ে, সুমি আমাকে একটা বকুল ফুলের মালা নিতে বললো!
-নাও ইমা আফা এইটা আমি নিজের হাতে তোমার জন্য বানাইছি!
সুমির ভালবাসা জড়ানো বকুল ফুলের মালা আমার কাছে মনে হলো সারা জীবনে পাওয়া সব থেকে মূল্যবান উপহার এটা। সুমির ময়লা গালে একটা চুমু খেয়ে বললাম, পাগল কোথাকার। মালাটা হাতে নিয়া বললাম,
-শোন সুমি!আমার শরীর খারাপ বুঝলি তো।
তাই পাঁচ-সাত দিন আসতে পারব না। তুই সাবধানে থাকবি! আর পারলে মানুষের উপকার করবি কেমন! আর সবাইকে ভালবাসবি! জানিস তো ভালবাসলেই ভালবাসা পাওয়া যায়। সুমির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। ব্লাড টেস্ট করে জানতে পারলাম আমার টায়ফয়েড হয়েছে বেশ কিছু দিন সময় লাগবে সারতে। আমার জ্বর ভাল হয়েছে আজ ষোল-সতেরো দিন। এই ষোল-সতেরো দিনেও সুমির কোন দেখা পেলাম না! প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসি কিন্তু সুমি আসে না। হঠাৎ করে আমার ফুলের দোকানের কথা মনে পড়ে গেল! খোঁজ নিতে গেলাম ঐ ফুলের দোকানে।
-মামা এখানে সুমি নামের একটা মেয়ে থাকে না? মামা আমার দিকে বেদনাক্লিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-তুমি কি সুমির ইমা আফা?
-হ্যাঁ। কিন্তু সুমি কোথায়? ও কি আর ফুল বিক্রি করে না? দেখলাম মামা হাউ মাউ করে কাঁদছে।
-কি করে বলবো গো, সুমি যে আর নেই।
-নেই মানে কি হইছে সুমির সব আমাকে বলেন প্লিজ!
-আমার দোকানে আরেকটা মেয়ে ফুল বিক্রি করত।
মেয়েটার নাম জরি, সুমির বয়সি! মেয়েটার বাবা রিক্সা চালক, ছয়টা ছেলে মেয়ে নিয়া অভাবের সংসার! দিন আনে দিন খায়! হঠাৎ জরি অসুস্থ হয়ে পড়ে, ডাক্তারের কাছে লইয়া গেলাম আমি নিজে। ডাক্তার পরিক্ষা নিরীক্ষা করে বললো জরির দুইটা কিডনীই ডেমেজ! জরিকে বাঁচাতে হলে দুইটা না পেলেও একটা কিডনী জরুরী ভিক্তিতে যোগাড় করতে হবে! আমার কাছে জরির কথা শুনে সুমি প্রচুর কান্না করেছিলো। আমার কাছে সুমি জানতে চেয়েছিলো –
-আচ্ছা মামা কিডনী কই পাওয়া যায়?
-এক মানুষের কিডনী যদি অন্য জনের সাথে ম্যাচ করে তবেই কিডনী দিতে পারে। তুই বুঝবি না।
-মামা হুনলাম একটা কিডনী না থাকলে নাকি মানুষ বেঁচে থাকে?
-হ থাকে!
তাঁরপর যা হবার তাই হলো, সুমি জরিকে সেচ্ছায় একটা কিডনী দিয়া দিল! কিন্তু দূর্ভাগ্য সুমি ও জরি দুই জনেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল! এবার আমার কান্না পেল না। বমি পেল! গলগল করে বমি করলাম রাস্তায়। মনে হচ্ছিল বুকের পাঁজরে কেউ পাথর দিয়ে তীব্র আঘাত করে কোন বিষাক্ত বিষ ঢেলে দিয়েছে। চিৎকার করে পৃথিবী ফাটাতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু পারিনি।
-আপনি একটু বসুন সুস্থ হয়ে। এই নিন। সুমি বলেছিলো,
-মামা আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই তবে এটা ইমা আফাকে দিও।’
দেখলাম একটা চিরকুট সেখানে খুব সুন্দর হস্তে লিখা- জানো ইমা আফা আমি লিখতে পারি না! তাই পার্কে বসে থাকা একটা সাহেব কে হাতে পায়ে ধরে অনেক মিনতি করে লিখাইছি! তোমার সাথে দেখা হয় না তাই মনটা বড় খারাপ! তুমি আমায় মানুষের উপকার করতে বলেছিলে আমি করেছি! জরির চিকিৎসার জন্য আমি মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছি! মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়া যে টাকা পাইছি জরির বাপেরে দিয়া দিছি। তুমি মানুষকে ভালবাসতে বলেছিলে তাই আমি আমার সই জরিকে ভালবেসে আমার একটা কিডনী দিয়া দিমু! জানি তুমি খুব খুশি হবা কারণ এই ভালবাসা যে আমি তোমার কাছ থেকেই শিখছি!
আমরা সুস্থ হইয়া দুই সই আবার ফুল বিক্রি করমু! আমার খুব ভালো লাগতেছে আমিও ইমা আফার মতো ভালোবাসতে শিখেছি। ইমা আফা এ যে তোমারই দান!!! চিরকুটটা পড়ে আমি মাটিতে বসে পড়লাম! আমি হেরে গেলাম ছোট্ট সুমির ভালবাসার কাছে। বিবেকের কাঠগড়ায় আমি আজ অপরাধী! আমার জন্য সুমি আজ পৃথিবীতে নেই!!