বৃদ্ধ মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে, বাসে উঠলো শিহাব। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, যাক অবশেষে আজাইরা জামেলা থেকে রেহাই পেলাম’ নিশ্চুপ শব্দে কথাটি বললো। চোখ বন্ধ করে, বাসের সিটে গা হেলিয়ে দিলো শিহাব। কয়েকদিন ধরেই ভেবেছিলো মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে কিন্তু অফিসের কাজের চাপে সময় বের করা হচ্ছিলো না। সংসারের খরচ, দুই ছেলের স্কুলের খরচ, আবার মায়ের ঔষধের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো। খরচ দিনে দিনে বাড়তেই লাগলো। তমা ও দিনে দিনে খুব রাগী স্বভাবের হয়ে যাচ্ছিলো শিহাবের উপর। পরিবার ঠিকমতো রাখতে, কিছুটা খরচ কমাতে মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার জন্য শিহাব কে বলে তমা। শিহাব প্রথমে রাজি না হলেও পরিবারের সুখের কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলো। আর আজ, তমার কথা মতো মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসলো।’
আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। মনে হয় যেনো বৃষ্টি হয়ে আকাশ ভেঙে পড়বে। সন্ধ্যা নেমে আসছে। বিশাল এক জ্যামে আটকে আছে বাস। শিহাব ক্লান্তি অনুভব করলো। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই থমকে গেলো শিহাব। ফুটপাতে চায়ের দোকান নিয়ে বসা এক মাঝ বয়সী মহিলা দোকান চালাচ্ছে, আর তার পাশেই এক তিন কি চার বছরের বাচ্চা কান্না করছে। শিহাব বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো, একটু পর পর মহিলাটি বাচ্চাটির কাছে গিয়ে আদর করে আসছে। আর মহিলাটির আদর পেয়ে বাচ্চাটি মুহুর্তের মধ্যে কান্না থামিয়ে এক গাল হাসি ফুটিয়ে দিলো ছোট্ট মুখে।’ মহিলার আর বাচ্চাটির খুনসুটি দেখে চোখ সরিয়ে ফেললো শিহাব। কোন কারন ছাড়াই পকেট থেকে ফোন বের করে হাতে নিলো। ফোনের মধ্যে ডুব দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে আবারো গা হেলিয়ে দিলো শিহাব।’
– তোর তো বয়স খুবই কম, বেশি হলেও সাত কি আট বছর। এ সময় তো তোর স্কুলে যাওয়ার কথা, স্কুল রেখে কেনো ঠান্ডা পানি বিক্রি করে বেরাচ্ছিস।
– স্যার, আমি স্কুলে যাই। এতদিন তো মায় কাম কইরা আমারে পড়াইছে, খাওয়াইছে এহন আজ এক মাস ধরে মায় অসুস্থ, খুব টাকার দরকার ঔষধের জন্য। ঔষধের টাকার জন্য এহন পানি বেইচা টেকা জোগাড় করতেছি।
– তুই ছাড়া কি আর কেউ নাই তোর মায়ের?
– না স্যার। তয় মার কাছে শুনছি ছোট বেলায় নাকি আব্বা, আমারে আর মারে রেখে পালিয়ে যায়। তারপর থেকেই আমি আর আমার মা একলগে। স্যার একটা পানি লন, লইলে খুব উপকার হইবো।’
জোড় করে চোখ বন্ধ করে কথা গুলো শুনলো শিহাব। স্যার একটা পানি লন, লইলে খুব উপকার হইবো’ কথাটুকু কানে এসে লাগাতেই চোখ না খুলে পাড়লো না শিহাব। ময়লা জামা পড়া এক মেয়ে মাথায় পানির ব্যাগ এক হাত দিয়ে ধরে রেখে দাড়িয়ে আছে, আর এক হাতে বোতল নিয়ে এক উৎসুক ব্যাক্তির সাথে কথা বলছে। বাসের মধ্যে কয়েকজন পানির বোতল কিনলো মেয়েটির কাছ থেকে। কেউ আবার কিছু টাকা বাড়িয়েও দিলো। শিহাব ও কিছু না ভেবেই পানির বোতল নিলো।’ বাস চলছে, মাথা ভনভন করে ঘুরছে শিহাবের। পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলো। তবুও কোন শান্তি লাগছে না। শিহাব অপেক্ষা করে আছে গন্তব্য স্থানে পোছানোর জন্য।’ বাস থেকে নেমেই মিষ্টি নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো শিহাব। কিছুদূর হাটাঁর পর পকেটে ফোনের রিংটোন বাজছে অনুভব করলো। পকেট থেকে ফোন বের করেই দেখলো কলিগ রবিনের কল। কল রিসিব করে শিহাব বললো ;
– কি খবর রবিন ভাই, কেমন আছেন?
– ভাই ভালো নাই, মা’য়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি।
– কি হইছে রবিন ভাই?
– সকাল থেকে মা’কে নিয়ে হসপিটালে আছি।
জরুরি এ+ (পজেটিব) চার ব্যাগ রক্ত লাগবে। অনেক খোজাখুজি করেও এখন পর্যন্ত এক ব্যাগও জোগার করতে পারিনি। ভাই, আপনি যদি একটু দেখেন আপনার আশেপাশে পাওয়া যায় নাকি। রবিন কোন কথা না বাড়িয়ে বললো, ঠিক আছে আমি দেখছি।’ রাত নেমে আসছে। তমা ঘুমাচ্ছে, শিহাবের চোখে ঘুম নেই। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে কলিগ রবিন কল দিলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর অপর পাশ থেকে কল রিসিব করলো। শিহাব বললো ;
– রবিন ভাই,
– আব্বু কাছে নাই।
– কোথায় তোমার আব্বু?
– দাদুর কাছে বসে আছে।
‘শিহাবের চোখ টলমল করতে লাগলো। একের পর এক ঘটনা অপরাধী করে তুলছে। বাসের মধ্যে মহিলা আর বাচ্চার খুনসুটি মনে হওয়ার সাথে সাথে শিহাবের শৈশব মনে পড়ে গেলো। কি দুরন্তই ছিলো শৈশব। মা’য়ের সাথে সবসময়ই লেগে থাকতাম। মা খাইয়ে দেওয়ার জন্য পিছন পিছন দৌড়াতো। কথা গুলো ভাবতেই চোখের জল অজান্তেই গাল বেয়ে পড়তে লাগলো।’
শিহাব সব ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। চোখে ভেসে উঠলো পানি বিক্রি করা মেয়েটির কথা। মায়ের ঔষধের খরচের জন্য যে পানি বিক্রি করতে নেমে গেলো। শিহাব চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে অতীত মনে পরে গেলো। যেখানে শিহাব একবার জ্বরের ঘোড়ে মৃত্যু পর্যায় চলে গিয়েছিলো তখন যত্নে, সেবায় সুস্থ করে তুলেছিলো মা।অসুস্থতার অনেক রাত মা পাশে ছিলো নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে।’
শিহাব রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় চলে আসলো। চিৎকার করছে তবে কোন আওয়াজ হচ্ছে না। কলিগ রবিন যদি আমার সমান বেতন পেয়ে তার বিশাল পরিবার সামলাতে পারে, মায়ের জন্য চিকিৎসা করতে পারে সেখানে কেনো আমি পারবো না। মা তো আমার থেকে কিছই চায়নি, চেয়েছে শুধু আমার সাথে থাকতে। চেয়েছে শুধু সকালবেলা অফিসে যাওয়ার সময় একটা সালাম। এর বেশি তো কিছুই না।’
খুব ভোরেই ঘুম ভাঙ্গলো রাহেলা বেগমের। চোখ খুলেই দেখে শিহাব পায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। রাহেলা বেগমের চোখ থেকে জল পড়তেই লাগলো। শিহাব কে দেখে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে রাহেলা বেগমের।’
‘ঘুম ভেঙে চোখ খুলেই দেখে মা বসে আছে। শিহাব মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মা আমার কিচ্ছু চাই না, তুমি থাকলেই আমার হবে। তোমাকে ছাড়া ভালো থাকবো না আমি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহর কাছে একটা জিনিসই চাইবো তুমি বেঁচে থাকো আজীবন। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন যেনো সকালবেলা অফিসে যাওয়ার সময় তোমায় সালাম দিয়ে যেতে পারি।’