পিংক কালার

পিংক কালার

ছোটবেলা থেকেই পিংক কালার আমার খুব-ই পছন্দ। এতই পছন্দ যে, বাবা-মা আমার নাম রেখেছেন রুবেল হাসান পিংকু। স্কুলের স্যার, ম্যাডাম এবং আমার সহপাঠীরা আমাকে ডাকতো পিক্কু বলে। পুরো স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ড্রেস ছিলো সবুজ রঙের আর আমার একার ছিলো পিংক কালারের ড্রেস। আমার আপাদমস্তক অর্থাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত যা কিছু লাগতো সব কিছু ছিলো পিংক কালারের। জুতা,মোজা, শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি,স্কুল ব্যাগ এবং কলমও ছিলো পিংক কালারের,শুধু বই খাতা ছাড়া। এক কথায় বলতে গেলে…

“রুবেল হাসানের জীবন—পিংকময় জীবন।” যাইহোক বাদ দেই সেই কথা। কয়েকদিন যাবত বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। কিন্তু আমার পছন্দমত পাত্রী খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি বাবা-মা কে আগেই বলেছি যে, আমি পিংক মেয়ে আইমিন পিংক কালার পছন্দ করা মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবনা। যারফলে তাদের এত হয়রানি। আমিও বাসায় বসে বসে শুধু রিলাক্স করি।

অবেশেষে বাবা-মা আমার জন্য মেয়ে দেখতে সফল হয়েছেন। তাদের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। আমিও অনেক খুশি। মা বলছিলো বিয়ের আগে মেয়ের সাথে কথা বলতে, কিন্তু আমি বলিনি। কারন মেয়ে যেহেতু পিংক কালার পছন্দ করে দেখার কি আছে? একবারে বাসর ঘরেই দেখবো। আমার বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি বাসর ঘরের সামনে। কেমন জানি লজ্জা লজ্জা ভাব চলে এসেছে। ভিতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছিনা। আমি ভাবছি….

“আচ্ছা, আমি যখন বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে তাকে দেখবো আমার বউতো লজ্জা পাবে। তখন তার মুখ কেমন হবে? লাল হবে নাকি পিংক কালারের হবে? মনে হয় পিংক কালারের হবে।” মনে সাহস নিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করলাম। আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলাম। বউ মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। আমি আস্তে করে গলা খাকড়ি দিলাম। বউ সামান্য নড়লো। আমি বললাম…

–আচ্ছা তোমার নাম কি?
-পিংকি।
–শুধু পিংকি?
-পিংক আক্তার পিংকি।
–আমাকে কিছু বলবেনা?
-আপনার সম্পর্কে সব জানি।
–আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
-না হওয়ার কি আছে? আমিতো আপনার মত-ই একজনকে চেয়েছিলাম যে আমার মতো পিংক কালার পছন্দ করে।
–তাই? আচ্ছা তোমাকে আ…আমি দেখতে পারি?
-আমি আপনার বউ,দেখতে কে মানা করছে?

বউয়ের যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমি-ই অবাক হলাম। আবার খুশিও হলাম। মনে মনে বললাম আমি পাইলাম ইহাকে পাইলাম পিংক কালারের বউ পাইলাম। আমি আস্তে করে বউয়ের ঘোমটা টা সরালাম। সরাতেই শক্ড। বললাম….

–একি তোমার মুখের এ অবস্থা কেনো?
-কেনো কি হয়েছে?
–কি হয়েছে মানে। মুখ এমন পিংক কালারের মত দেখাচ্ছে কেমন?
-আসলে মেকআপ আমার একদম পছন্দনা। তাই মুখে পিংক কালার মেখেছি।

এই বলে বউ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। যা ভাবছিলাম তাই, বউয়ের মুখ লজ্জায় পিংক কালার হয়ে গেছে। তখন-ই বুঝলাম বউ আমার বাড়াবাড়ি রকমের পিংক কালার পছন্দ করে। আল্লাহ তুমি আমার পাশে থেকো।

বিয়ে হয়েছে দুইমাস হলো। দুইমাসে যা দেখলাম তাতে বুঝলাম বউ আমার পিংক খোর। কারন সে আমার চেয়েও পিংক কালারের প্রতি বেশি আসক্ত। সব কিছুতেই পিংক। চলাফেরা, ঝগড়াঝাঁটি, মানঅভিমান, রান্নাবান্না যা কিছু আছে সব। সকালে যখন বউ কে বললাম, আমার জন্য আলু ভর্তা বানাতে। বউ আলু ভর্তা বানালো ঠিক-ই কিন্তু সেখানে পিংক কালার মিক্সড। ভাতেও পিংক কালার মিক্সড। পায়েস খাবো, সেখানেও পিংক কালার মিক্সড। ডাল রান্না করেছে তবুও পিংক কালার মিক্সড। রাস্তা দিয়ে দু-জন হেঁটে যাব তখন বলবে…

-এই শোন?
–হুম বলো?
-রাস্তার পাথড় গুলো কালো না হয়ে পিংক কালার হলে ভালো হত না?
–হুমম।
-আচ্ছা পিক্কু, এই বিল্ডিং গুলো,গাছপালা সবকিছু যদি পিংক কালারের হতো তাহলে অনেক ভালো হতো তাইনা?

আমি বউয়ের কথায় শুধু হ্যা/হুম করতাম। কিছুই বলতামনা। রাগ হতো হতো খুব। আবার যখন সে আমার সাথে রাগ করতো তখন পিংকি পিংকি বলে গান গেয়ে তার রাগ ভাঙ্গাতে হতো। ইদানীং বউ পিংক কালারের প্রতি আসক্ত বেশি হয়েছে। সারাদিন অফিসের কাজকর্ম করে যখন সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলাম। তখন-ই পিংকি (আমার বউ)বলল…

-আমার জন্য আইস্ক্রিম এনেছো?
–সরি পিক্কি(পিংকিকে পিক্কি বলে ডাকি) আসলে মনে ছিলোনা।

-তা থাকবে কেনো? আমি তোমার কে? কত করে বললাম অফিস থেকে আসার সময় আমার জন্য পিংক কালারের একটা আইস্ক্রিম আনবা,সেটাও মনে থাকেনা। পিংক কালারের ফুচকা আনতে বললে তাও আনবানা। চটপটি আনতে বললেও আনোনা। (অভিমানী কণ্ঠে)

–আচ্ছা সরি বললামতো।
-সরিতে কাজ হবেনা।
–আচ্ছা ঠিক আছে কাল তোমাকে নিয়ে ঘুড়তে যাবো খুশি?
-হুমমম..অন্নেক।

আমি আর পিংকি নদীর পাড়ে বসে আছি। যারা নদীর পাড়ে বেড়াতে এসেছে তারা সবাই আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কারণ আমার গায়ে পিংক কালারে পাঞ্জাবী। পিংকি পিংক কালারের শাড়ী পরেছে। পিংকি বলল…

-এই শুনছো?
–হুম।
-আচ্ছা বলোতো আমাদের আগে ছেলে হবেনা মেয়ে হবে? আমি অনেক ভেবে চিন্তে বললাম….

–উম…মেয়ে হবে।
-না।
–তাহলে ছেলে হবে।
-না।
–তাহলে কি হবে তুমি বলো?
-আমাদের দু-টো জমজ ছেলে-মেয়ে হবে বুজলে? আচ্ছা এখন বলো আমাদের সন্তান কেমন হবে?
–কেমন হবে আবার, আমাদের সন্তান আমাদের মতো হবে।
-উহু না।
–তাহলে….ওদের দাদা-দাদির মতো হবে।
-উফফফ..তাওনা।
–তাহলে…?
-আচ্ছা তুমি এত বেরসিক কেনো বলতো? আমাদের ছেলে হবে পিংক কালারের বুঝছো?

–আচ্ছা পিংকি তোমার সমস্যা কি বলোতো? সব কিছুতেই পিংক। আমাদের ছেলে-মেয়ে হবে তাও পিংক। এটা বেশি বেশি হচ্ছেনা? পিংক কালার আমিও পছন্দ করি তাই বলে সাথে সাথে পিংকি রাগ করে চলে গেলো।
–আরে কোথায় যাচ্ছো?দাঁড়াওকি হলো? আজব….

বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। পিংকি জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। আমি বিছানায় বসে বসে অফিসের কাজ করছি। হঠাৎ পিংকি বলল…

-এই শোননা, চলো বৃষ্টিতে ভিজি?
–দেখছো না কাজ করছি?
-তাতে কি?চলো বৃষ্টিতে ভিজবো?
–আরে দেখনা, বৃষ্টির পানি কেমন চকচকা। পানি পিংক কালারের হলেনা বৃষ্টিতে ভিজতাম। (একটু বুদ্ধি খাটালাম যাতে বৃষ্টিতে না ভিজতে হয়।) পিংকি কি যেনো ভাবলো। তারপর বলল….

-বাহ, তোমারতো দারুণ বুদ্ধি। আচ্ছা বৃষ্টিতে ভিজবোনা চলো ছাদে যাই?
–বৃষ্টি কমুক?
-আচ্ছা।

আমি আর পিংকি ছাদে বসে আছি। পিংকি আমার কাধে মাথা রেখেছে। পিংকি বলল….

-এই আমাদের ছেলে-মেয়ের নাম কি রাখবে?
–কেনো, রাজা-রানী রাখবো।
-না, এই নাম ভালো না। তুমি আরেক নাম বলো?
–তাহলে, হাসান-হোসেন রাখবো।
-আসলেই তুমি একটা বেরসিক। এই যুগে কেউ এমন নাম রাখে? আমাদের ছেলের নাম রাখবো পুকুপুকু আর মেয়ের নাম রাখবো পিকিপিকি।
–এমন নাম কেনো?(অবাক হয়ে)
-পিংক কালারের সাথে মিল রেখে, পুকুপুকু-পিকিপিকি। খুব সুন্দর নাম না? কত্ত কিউট!

পিংকির এমন কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কোনরকম রাগকে কন্ট্রোল করলাম। হায়রে বউরে! ছেলে মেয়ের নাম রাখবে তাও পিংক কালারের সাথে মিল রেখে। পিংকি বলল….

-এই…?
–কি?
-রাগ করছো?
–না।
-তাহলে কথা বলছো না কেনো?
–এমনি,তুমি বলো আমি শুনছি।
-চাঁদটা খুব সুন্দর তাইনা?
–হুমম তোমার মতো।
-হিহিনি…আচ্ছা পিক্কু চাঁদটা পিংক কালারের হলে কেমন হতো?
–অনেক ভালো হতো। (ভেতরের রাগকে কন্ট্রোল করে)
-হুমম আমিও তাই ভাবছি। চাঁদটা হতো পিংক কালারের চাঁদের আলোও হতো পিংক কালারের। তখন আমরা চাঁদকে বলতাম পাঁদ। আর চাঁদের আলোকে বলতাম পাঁদের আলো। কত্ত কিউট নাম তাইনা?হিহিহি…

–উফফ তুমি এত্ত কথা বলতে পারো। চুপ করো এখন?
-রাগ করলে?(অভিমানী কণ্ঠে)
–নাআআ…..(রেগে)

আজকে শুক্রবার। অফিস বন্ধ, তাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছি। একটু পর পিংকি এসে ঘুম থেকে আমাকে টেনে তুললো। আমি ফ্রেস হয়ে খেতে গেলাম। টেবিলে বসতেই আমার মুখ হা হয়ে গেলো। খাবারের অভাব নেই। রোস্ট, পোলাও,খোরমা যা আছে সব। লাচ্চা রান্না করেছে পিংক কালারের। পায়েস পিংক কালারের। রুটি বানিয়েছে পিংক কালারের। পোলাও ও পিংক কালারের। এগুলো দেখেই আমার পেট খারাপ হওয়ার উপক্রম। পিংকি বলল….

-জানো কত্ত কষ্ট করে এগুলো তোমার জন্য তৈরি করেছি।
–এত্ত কষ্ট করার কি দরকার ছিলো। একটু পিংক কালারের বিষ নিয়ে আসলেই তো হতো। খেয়ে মরে যেতাম,যত্তসব।
-এভাবে বলছো কেনো? আমি কি অন্য কারো জন্য করেছি নাকি?
–না না আমি কি তাই বলছি?(রেগে)
-আচ্ছা তাহলে এগুলো খাও।
–তুমি খাবেনা?
-আমি পরে খাবো।

আমি খাচ্ছি আর মনে মনে আল্লারে ডাকছি “আল্লাগো আমারে তুমি রক্ষা করো। আমার জানি কিছু না হয় গো আল্লাহ।” খেতে খেতে হঠাৎ মনে হলো আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। তারপর কি হলো মনে নেই।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। পিংকি ফুপিয়ে কাঁদছে। আমার মাথায় সে পানি ঢালছে। পানি গুলোও পিংক কালারের। আমি আস্তে করে চোখ বুঝলাম। চোখের সামনে হাসপাতালের ছবি ভেসে উঠলো। আমাকে আই সি ইউ তে নেওয়া হয়েছে। আই সি ইউ রুম পিংক কালারের। অপারেশন করা হবে, অপারেশনের যন্ত্রপাতিও পিংক কালারের।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত