বেশ সময় করেই পাত্রীকে সামনে আনা হলো। পাত্রীর ঘোমটা সরানোর পরে তাঁর কৃষ্ণকলির চেহারা টা বেরিয়ে এলো। কৃষ্ণকলি কালোদেরই বলা হয়। মায়াবতী কালো মেয়েদের মায়া করে বা করুণা করে ডাকা হলেও। কৃষ্ণকলি ডাকা হয় খুব বেশি কালো মেয়েদেরই। আমার জননী পাত্রীর মুখ দেখে বেজায় বিরক্ত হয়েছেন ঘটকের প্রতি। তা উনার চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। মা জননী খুব অপমানবোধ করলেন। এমনই অপমানবোধ করলেন যে পাত্রীর নাম টা পর্যন্ত না জিজ্ঞেস করে উঠে গেলেন! আমি বোকার মতো কেন যেন বসে রইলাম!
পাত্রীর চোখে তাকানো যাচ্ছে না। আসলে চোখের পানি টুপটুপ করে পড়ছে। কাজল দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি তাঁর। এমনিতেই তাঁর চোখটাও বেশ কালো। চোখের পানি বলে দিচ্ছে সে কতবার এই পাত্রীর আসনে বসে অপছন্দের ছাপ নিয়ে উঠেছে। কেউ পছন্ধ করেনি। আমি অবিবাহিত যুবক। দেখতে যেমনই হই না কেনো, বিয়ের ক্ষেত্রে আমার প্রথম পছন্দ হচ্ছে কোনো সুশীলা সুন্দরী। নাহলে ভদ্রসভ্য কোনো শ্যামবর্ণের মেয়ে। কালো মেয়ে বিয়ে করবো স্বপ্নেও ভাবি না। এমনিতেই নিজে কালো। তার উপর যদি কালো মেয়ে বিয়ে করি তাহলে আমাদের বাচ্চাকাচ্চা ও কালো হবে।
মেয়ে হলে দারুণ সমস্যায় পড়ে যাব। ভালো পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারবো না। কোনো সুন্দরীকে বিয়ে করলে বাচ্চাকাচ্চা সুন্দর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কালো মেয়ে বিয়ে করলে তো একদমই সম্ভাবনা নেই।
আমি কোনো কালো মেয়েকে করুণাও দেখাই না। করুণা করে কালোদের গুণগান গায় গল্পে লেখকেরা। বাস্তবে কোনো পুরুষ করুণা করে একটা কালো মেয়েকে বিয়ে করেনি। গল্পের নায়কদের দেখা যায় তা করতে। আমি গল্পের নায়ক ও না৷ করুণা করে এই মেয়েকে বিয়েও করতে পারবো না। শুধু মেয়েটার চোখের পানি বুকে কষ্টের দাগ কাটছে। সে দাগ আমার অনেক অসহায় মানুষদের দেখে ও কাটে। মা জননী বাহিরে গিয়ে হয়তো খেয়াল করছেন আমি সাথে নেই৷ তাই আবার বাড়ির বড় রুমটায় ফিরে আসলেন। এসে দেখলেন আমি কালো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। মা জননী কোনো কিছু উপেক্ষা করলেন না। বলে দিলেন
— এই কালো মেয়ের সামনে কেনো বসে আছিস বাবা? তাড়াতাড়ি ওঠ, নাহয় অলক্ষুণে লেগে যাবে।
পাত্রীর মা পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। কোনো কথা বলার পরিস্থিতির উনার ছিলো না। পাত্রী এবার কেদারা ত্যাগ করে পাশের রুমে দৌড় দিলেন। বোবা কান্না এবার শব্দে রূপান্তরিত হলো!
আমি মা জননীর পিছু পিছু বেরিয়ে আসলাম। উনি বকবক করেই যাচ্ছেন। না বকবক না এটা। ক্ষোভ ছাড়ছেন ঘটকের প্রতি। এতো কালো মেয়ে তাঁর ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য কোন সাহসে ঘটক বেটায় দেখায়? মা জননীর এই রাগ টা শরীর ছেড়ে বেরোচ্ছে না। আসলে মা জননীর ভয় টা অন্য জায়গায় আমি জানি। যেভাবে পাত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। না জেদ করে বসি তাঁকে বিয়ে করার জন্য। তাহলে নিজের ছেলের বৌকে নিয়ে বাহিরে বেরোনো যাবে না। ছোট বেলা থেকে আমার জেদ একটু বেশি তো। কোনো কিছু জেদ করে বসলে তা করেই ছাড়ি।
তবে অবশ্যই আমি এই কালো মেয়েটাকে বিয়ে করবো না। তাঁকে আমার পছন্দ হয়নি। কারণ একটাই। সে কালো, ভীষণ কালো। রাস্তার মাঝে জননীকে একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম— আচ্ছা মা, বাবা কী তোমাকে বিয়ে করে ঠিক করেছে? মা জননী চুপ হয়ে গেলেন। আর কোনো কথা বললেন না। উনার কাছে এই প্রশ্ন টা তো অপ্রত্যাশিত। বাড়িতে এসে দাদীর আঁচলে মাথা ঢেকে একটু আহ্লাদ করে জিজ্ঞেস করলাম— আচ্ছা দাদু, তুমি দেখতে কালো কেনো? দাদী একটুও অবাক হলেন না৷ মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বললেন— তোর দাদা বিয়ে করেছে তাই।
— তুমি বেশ বুদ্ধিমতী দাদু।
— তা তো একটু আছিই, তা আজকে পাত্রী পছন্দ হয়েছে তোর?
— একদম না। এতো কালো একটা মেয়ের প্রশংসা ঘটক কত সুন্দর করে করেছে জানো না। কয়লার চেয়েও কালো মেয়ে টা৷ তাকানোর মতো অবস্থা নেই।
— তাই বল। কিন্তু তোর বিয়ে টা যে কবে হবে! জানিস এই কালো মেয়ে নিয়ে একটা গল্প আছে।
— গল্প? বলো না। দাদী একটু আস্তে আস্তেই বললেন— তোর বাবাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম। পাত্রীর গায়ের রং এতোই কালো ছিলো যে আমার প্রায় বমি চলে এসেছিলো। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে চলে আসি।
— তারপর?
— তারপর আর কী? তোর বাবা জেদ করে পরেরদিনই সেই মেয়েটাকে বিয়ে করে বাড়িতে হাজির হয়।
— তারমানে! সেই মেয়েটাই আমার মা?
— তোর বাবা তো একটাই বিয়ে করেছে!
আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। মাকে দাদী আজও মেনে নিতে পারেনি মন থেকে। কারণ একটাই, মা কালো। কিন্তু আজব ব্যাপার হচ্ছে। দাদীও মায়ের থেকে কম কালো নয়! আজকে যে মেয়েটাকে মা তাঁর বাড়িতেই অপমান করে এসেছে, তাঁর অপরাধ একটাই, সে কালো। মা বোরকা খুলে রান্নাঘরে গিয়েছে৷ আমি গিয়ে মাকে সাহায্য করতে করতে বললাম— আচ্ছা মা, তোমার খারাপ লাগছে না? মা খুব স্বাভাবিক উত্তর দিলো— খারাপ লাগবে কেনো? শোন সন্তান পাশে থাকলে কোনো মায়ের খারাপ লাগে না।
— তুমি অমানুষ মা, অমানুষ। একটা মেয়ের মুখের উপর তাঁর চেহারা নিয়ে খারাপ কথা বললে যে তাঁর কতো খারাপ লাগে তা তো তোমার জানার কথা। তুমিও তো দেখতে খুব ভালো না তাই না মা? এখন তুমি আমাকে বেয়াদব বলতে পারো। বলতে পারো ছেলে বড় হয়ে গেছে, মুখে মুখে তর্ক করতে শিখে গেছে। আর এমন একটা কারণে মেয়েটার মায়ের সামনে কথা টা বলেছিলে যেখানে তাঁর কোনো হাত নেই। আল্লাহ্ তো মানুষকে বানিয়েই দুনিয়াতে পাঠায়, পাঠিয়ে তো আর বানায় না। মা জননী থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাবতে পারছে না তাঁর একমাত্র ছেলে তাঁকে এতো কড়াকড়া কথা বলছে। মায়ের কাছে কোনো জবাব নেই। আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম— আচ্ছা বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে বিয়ে করে কী কেউ সুখি হতে পারে?
— একদম না বাবা, কেউ সুখি হতে পারে না বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে।
— তুমি তো দিব্যি ভালো আছো, বাবা তো দাদা দাদীর অবাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করেছিলো, না মা? ভালো আছো তো তুমি? মায়ের চোখে পানি টিপটিপ করছে।
— তোমার চোখে পানি মা। অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার। যে ছেলেকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছো। নিজে না খেয়ে খাইয়েছো, যে ছেলের জ্বর হলে তোমার দুনিয়ায় স্বস্তি বলে কোনো শব্দ থাকতো না। সে ছেলে কষ্ট দিয়েছে তোমাকে মাত্র, তাই চোখে পানি এসেছে না?
মা মুখ লুকালো। কিন্তু চোখের পানি লুকাতে পারলো না। যে ছেলেকে মানুষ করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। সে ছেলে তাঁকে আজকে অমানুষ বলেছে। আজকের দিন টা হয়তো তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন, শোকের দিন হবে। আমি থেমে থাকলাম না। বললাম— আমি যদি এখন জেদ করে ঐ কালো মেয়েটাকেই বিয়ে করি। যা বাবা করেছিলো, তাহলে কী আমি ঠিক করবো মা? আমরা কী সুখে থাকতে পারবো তোমাকে কষ্ট দিয়ে? মা কান্না কান্না মুখে জবাব দিলো— তুই কী ঐ কালো মেয়ের হয়ে ওকালতি করছিস?
— না মা, ওকালতি করছি না। মেয়েটাকে সত্যি বলতে আমার পছন্দ হয়নি, হবে কীভাবে? সে তো কালো। তাই বলে তুমি যে কথা টা বলে এসেছো তা কী কোনো নারী অন্য কোনো নারীকে বলতে পারে?
— তুই কী চাচ্ছিস বল তো?
— মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইবে, তাঁর মায়ের কাছেও।
আজকে যদি তোমার কালো মেয়ে থাকতো, তোমার সামনে মেয়েটাকে যদি কেউ এভাবে অপমান করে যেতো? তখন তোমার মনে হতো না কালো মেয়ে জন্ম দিয়ে তুমি কী ভুলটাই না করেছো, বা তোমার মায়ের কথা চিন্তা করো। যেদিন দাদু তোমাকে দেখে বমি করে দিয়েছিলো প্রায়। কালো হয়েও কালো বুঝো না তুমি, তাহলে সুন্দরেরা কী কালো বুঝবে? মা জননী শব্দ না করে আর কাঁদতে পারলেন না। আমি ইচ্ছে করেই কাঁদিয়েছি। তাঁর জানা দরকার যা কিছু মানুষের হাতে থাকে না। তা কিছু নিয়ে যখন কেউ কাউকে অপমান করে তখন কতো খারাপ লাগে।
মা কান্না করলেও যায়নি সে মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে। আমি গিয়েছি, তবে ক্ষমা চাইতে নয়। বাবার পথ অনুসরণ করতেই। কালো মেয়ে টা শুধু একটা কথাই বলেছিলো কবুল বলার আগে— আপনি কী আমাকে করুণা করছেন?
আমি বলেছিলাম— দেখো তোমাকে আমি করুণা করছি না, তোমাকে আমার পছন্দও হয়নি। পুরুষ হিসেবে আমি সুন্দরী একটা বৌ ই চেয়েছি। কিন্তু তোমার সাথে আল্লাহ্ আমার কপাল বেঁধে রেখেছে, সেই বাঁধ টা কী ভাঙতে পারবে? আমার কথা তোমার ভালো লাগছে না না? ছোট বেলা থেকেই তেতো তেতো কথা বলা আমার অভ্যাস। কিছুই করার নেই। এই চিরতার রসকেই আজ থেকে তোমার সহ্য করতে হবে।
মেয়ে টা তারপর হাসে, অজান্তেই হাসে। বিয়ে পড়ানোর সময় জানতে পারলাম মেয়েটার নাম আনিকা। অবাক লাগলো খুব। আনিকা নামের অর্থ সুন্দরী। আর আনিকা নামের মেয়েরা কালো ও হয় না। কিন্তু আমার আনিকা কালো, খুব বেশিই কালো। মায়ের সামনে আনিকাকে নিয়ে হাজির হলাম৷ মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। কিন্তু একটাও উঁচু গলায় কথা বলতে পারেনি পরে। সেও এভাবে একদিন এই বাড়িতে পা দিয়েছিলো। এবং তাঁর মতে বাবা ঠিক কাজটাই করেছিলো, সুতরাং আমিও ভুল করিনি।
মা জননী আনিকাকে মেনে নিতে পারছে না। আনিকা শত চেষ্টা করেও মায়ের মন পায়নি৷ আমাদের একটা ছেলে হলো। সে দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেলো। চোখের সামনে থাকলে মানুষের বেড়ে উঠা তেমন চোখে পড়ে না। তারপর অনেক দিন কেটে যায়। পাশের রুমে ছেলে টা তাঁর মাকে বুঝাচ্ছে সে একটা মেয়েকে ভালবাসে। আনিকা বললো— সম্ভব না। ছেলে বললো— ও খুব ভালো মেয়ে মা। শিক্ষিত, ভদ্র, নামাজী, পর্দা করে, রান্নাবান্নাতে চমৎকার, আর ঘরের সব কাজ একাই করে অভ্যস্ত। আনিকা চিৎকার করে বললো— সব বুঝেছি, মেয়ে টা দেখতে অনেক কালো। আমি দেখেছি তো। ঐ মেয়েকে ভুলে যা।
— শুধু গায়ের রং’টাই তোমার চোখে পড়লো মা? আর অন্য কিছু পড়লো না?
— না। আমার ছেলেকে আমি কালো মেয়ে বিয়ে করাতে পারবো না।
বলে সরাসরি আনিকা আমার কাছে এসে বললো— বুড়ো তো হয়ে গেছেন। ঘরের খবর কিছু রাখেন? আপনার গুণধর পুত্র এক কালো মেয়েকে ভালবাসে। কত্ত বড় সাহস চিন্তা করছেন? ভালবাসবি ভালো কথা। ভালবাসা হয়েই যায়। তাই বলে জগতে কী শুধু কালো মেয়েই আছে? আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার লম্বা দাড়িগুলো পেঁকে সাদা হয়ে গেছে। আনিকার চুলগুলোও পাঁকতে শুরু করেছে। আনিকা আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো— কথা কানে যাচ্ছে না? সংসারে যে আগুন লাগছে দেখতে পারছেন?
আমি আনিকার চোখে চোখ রেখে বললাম— তোমাদের চরিত্রে না, মনে না, রক্তে সমস্যা আনিকা। এতে তোমাদের কোনো দোষ নেই, বিশ্বাস করো। এটা জন্মগত। আনিকা অবাক হয়ে বললো— মানে? কী বলতে চাচ্ছেন? আমি আস্তে করে বললাম— বলতে চাচ্ছি, আয়নায় একটু নিজের মুখ টা দেখো, সংসারের আগুন নিবে যাবে! আনিকা চুপ হয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই চোখে পানি চলে আসলো! আর আমি ভাবছি, এখন যদি বলি ” জগতে কালো মেয়েরাই বেশি কালো মেয়েদের দেখতে পারে না। ” তাহলে লোকে আমাকে পাগল বলবে ঠাঁই!