মিম্রতা

মিম্রতা

একটা প্রশ্ন করি আপনাকে?
– করুন।
– প্রশ্নটা যদিও ব্যক্তিগত, তবু না করে থাকতে পারছিনা।
– করে ফেলুন।
– আচ্ছা! আপনি কি সত্যি ই পার্সেল গুলো খুলে দেখেন?

প্রশ্নটা শুনে অপ্রস্তুত হলাম খানিকটা। বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম- আমি কি সত্যি ই পার্সেল গুলো খুলে দেখি। ভেতর থেকে আমার মাস্টারক্লোন জবাব দিল ” না, আমি খুলে দেখিনা”। কুরিয়ার সার্ভিসের মেয়েটা প্রশ্নটার উত্তরের অপেক্ষায় অপলক তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। কি উত্তর দেব? না বলব নাকি হ্যা? দ্বিধা কাটার আগেই মেয়েটা বলে দিল উত্তরটা।

– আপনি পার্সেলগুলো খোলেন না তাইনা? এখান থেকেই নিয়েই ফেলে রেখে দেন। আমি শিওর।
– আপনি কিভাবে বুঝলেন?
– খুব সিম্পল।
– কেমন সিম্পল?
– গত তিনমাসে মোট পঁচিশটা পার্সেল এসছে আপনার নামে।

তার সবগুলোই আমার ইস্যু করা। পার্সেলগুলো যে পাঠায় সে একজন মেয়ে কিংবা নারী। আপনি যদি পার্সেলগুলো খুলে দেখতেন নিশ্চিত অন্তত একটা পার্সেল তার জন্যে ফিরতি পাঠাতেন। এইটা সম্পূর্ণই আমার ধারণা। আমি ভুল ও হতে পারি। আর প্রশ্নটাও আমার প্রফেশনাল ইথিকসের বাইরে গিয়ে করে ফেলা জাস্ট বিকজ অব বিং কিউরিয়াস। ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ।

মেয়েটার এই কথাগুলোর পিঠে আমি আর কোন জবাব না দিয়ে পার্সেলটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম কুরিয়ার সার্ভিস থেকে। হাটছি। আর ভাবছি আমার নামে পঁচিশটা পার্সেল চলে এসছে ইতিমধ্যেই। আমি একটা পার্সেল ও আজ পর্যন্ত খুলে দেখিনি, এমনকি একবারের জন্যেও আমার ভেতর জানার আগ্রহ পর্যন্ত জমেনি। এর কি কারণ? একটা নির্দিষ্ট কারণ চট করে মনে মনে স্থির করার চেষ্টা করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম একদম প্রথম ভাবনায় যে কারণটা মাথায় আসবে তা গ্রহণ করব। অন্তরাত্মাকে প্রশ্ন করলাম ” আচ্ছা, আমি এই পঁচিশটা পার্সেলের একটাও কেন খুলে দেখছিনা?”।

মানুষের অন্তরাত্মা খুব চালু একটি যন্ত্র। চটপট প্রশ্ন, ঝটপট উত্তর। পৃথিবীতে আমৃত্যু অন্তরাত্মা নামের এই অমাংসল যন্ত্রটা সবসময় সাথে থাকে। কথা বলে, যন্ত্রণা দেয়, সুখ দেয়, হাসায়, কাঁদায়। তবু অন্তত স্বার্থপর প্রিয় মানুষগুলোর মতন ভুল সময়ে ছেড়ে যায়না। এই পার্সেলগুলো খুলে ফেললে পার্সেল পাঠানো মানুষটাকে আমি আবিষ্কার করে ফেলতাম। আর আবিষ্কার করে ফেললে তাকে জানার আর নতুন করে কিছু থাকেনা। তাই আমি পার্সেলগুলো খুলছি না। জবাবটা দিল অন্তরাত্মা।

জবাবটা কি কুরিয়ার সার্ভিসের মেয়েটাকে গিয়ে বলে আসব? না থাক। প্রশ্নের জবাব টা তোলা থাক। প্রশ্নের জবাবটা পেয়ে গেলে সে এই সুন্দর অনাবিষ্কৃত বিষয়টার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় আর কোনদিন এই বিষয়টা নিয়ে ভাববেনা। তা কোনভাবেই হতে দেয়া ঠিক না।

সিগারেট ধরাতে হবে। পেছন থেকে মোলায়েম গলায় ডাক দিল কেউ- এই যে ওমেদ হাসান শুনুন একবার। ঘাড় ঘুরানোর আগেই যে ডেকেছিল সে সামনে এসে দাঁড়ালো। কুরিয়ার সার্ভিসের সে মেয়েটা। আবার কি চায়? প্রশ্নটার উত্তর? কিন্তু আমিতো স্থির করেছি প্রশ্নটার উত্তর দেব না। ইটস ফিক্সড এন্ড ফাইনাল।

– পেছন থেকে ডাকার জন্যে খুব স্যরি।
– দেখুন মিস কুরিয়ার সার্ভিস, আপনার প্রশ্নটার উত্তর আমার কাছে আছে। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছি উত্তরটা আমি দেব না। তাই প্লিজ…
– আমি প্রশ্নটার ফার্দার উত্তর চাওয়ার জন্যে আপনাকে ডাকিনি।
– তাহলে?
– আসলে আমি অনেক বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি।
– অপরাধ তো মানুষের সহজাত। করবেন, শোধরাবেন এইটাই তো স্বাভাবিক। আমাকে বলার কি আছে বুঝতে পারছিনা।
– অপরাধটা আপনার সাথেই।
– মানে?

মেয়েটার চোখে মুখে লজ্জা আর অপরাধবোধের ছাপ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সেসব অবজ্ঞা করে গলা খানিকটা নামিয়ে উত্তর দিল- প্রচন্ড কৌতূহল থেকে আপনার বিশ নম্বর পার্সেলটা আমি খুলে ফেলেছিলাম। এজন্যে আমি ভীষণরকম লজ্জিত এবং অনুতপ্ত।

– ইটস ওকে। কৌতূহল কখনো কখনো পানির তৃষ্ণার চাইতে প্রখর। খুব বড় কোন অপরাধ হয়ে যায়নি। আমাকে এক প্যাকেট বেনসন কিনে দিন। অপরাধ মাফ। এমন উত্তর বোধয় আশা করেনি। আমার দিকে তাকালো একবার। মুহূর্তেই চেহারা থেকে লজ্জাবোধ সরে গিয়ে এক চিলতে হাসির আভাস দেখা গেল। প্রায় মুচকি হেসে বলল-

– মানে কি এত বড় অপরাধ এক প্যাকেট বেনসনের বিনিময়ে মাফ করে দিলেন?
– হ্যা দিলাম।
– কেন?
– আপনি কি বলতে চাইছেন আপনার আরো বড় শাস্তি হবার দরকার ছিল? ওকে ফাইন! তাহলে একটা স্কচ জিন কিনে দিন। আরাম করে খাই।
– স্যরি, স্কচ জিন কি?
– মদ।

মেয়েটা শব্দ করে খরগোসের মতন হেসে উঠল। সে হাসির শব্দে আমার শরীরের কোথাও একটা ব্যাথা হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ পর তড়িঘড়ি পানি খেলে যেমন ব্যাথা হয় ঠিক তেমন একটা ব্যাথা হচ্ছে। কিন্তু কেন? একপাশে কেউ হাসলে, অপরপাশে কেউ ব্যাথা কেন পায়?

একসময় হাসি থামাল। নিজেকে সামলালো। এক লাফে কুরিয়ার সার্ভিসের দিকে দৌড় দিল। বোধয় পার্স আনতে গিয়েছে। মেয়েদের পার্স ভ্যানিটিব্যাগ অধ্যায়গুলো আমার কাছে দারুণ বিষয়। কি সুন্দর! একটা বড় ব্যাগ, তার ভেতর আবার আরো একটা ব্যাগ। বড় ব্যাগের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো থাকে রাজ্যের সব জিনিসপত্র। আইলাইনার, মাশকারা, লিপ্সটিক, চিরুনি, টিপ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, টিস্যু পেপার, চাবি, আরো কত কি হয়ত মেয়েরা নিজেরাও জানেনা।

সেসব জিনিসের মাঝখানে থাকে আরেকটা ছোট্ট ব্যাগ। সেই ছোট্ট ব্যাগটায় থাকে টাকা অথবা ক্রেডিট কার্ড এবং হয়ত দু একটা সিমকার্ড। ছেলেদের থাকে স্রেফ একটা মানিব্যাগ। এক স্লটে কিছু টাকা। কোণায় প্রিয় মানুষগুলোর দু একটা ছবি। আইডিকার্ড, ক্রেডিট কার্ড আর রাজ্যের যত হাবিজাবি অমুক তমুক এজেন্সীর ভিজিটিং কার্ড। ব্যস। ধারণা সত্যি। মেরুণ কালারের একটা পার্স নিয়ে আমার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। অনবরত ঘামছে। ঘাম কপাল বেয়ে নাক অবধি গড়িয়ে পড়ছে। আমি মেয়েটার খুব কাছের কেউ হলে এই ঘামটুকুন মুছে দিলে সে হত এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ । কিন্তু আমি তো তার কেউ না। তাই ঘাম ঝরুক যেভাবে ঝরছে। আমার কি!

পার্স থেকে টাকার পরিবর্তে ছোট্ট একটা চিরকুট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল- নিন ধরুন এইটা। আমার চোখ চিরকুটে না পড়ে পড়ল মেয়েটার বাড়িয়ে দেয়া হাতের আলোয়। ডান হাতটা ধবধবে ফর্সা। ফর্সা হাতের শেষ মাথায় ব্ল্যাক লেদারের একটা ঘড়ি৷ ঘড়ির পাশে আর্টসেলের একটা রিজব্যান্ড। তার মানে মেয়েটা আর্টসেল ভালবাসে! অনিকেত প্রান্তর, পথচলা, দুক্ষ বিলাস, এই বৃষ্টি ভেজা রাতে শোনে। আমার বিশ্বাস যে মেয়ে একবার গান ভালোবেসে ফেলে তার ভেতর পাপ থাকেনা। ফর্সা হাত পা ওয়ালী মেয়েদের প্রতি পুরুষ চোখের একটা আলাদা টান আছে। ওরা বিষ অফার করলেও সেটা হাতে নিয়ে পুরুষ বলে ফেলে ” আই লাভ বিষ সো মাচ, সায়ানাইড ইজ মাই ফেভারিট বিষ”৷ কিন্তু এই মেয়েটার হাতে কোন বিষ নেই। আছে একটা চিরকুট। চিরকুটটা নিতে অস্বীকার করার ভংগি করে আমি জবাব দিলাম-

– এক প্যাকেট বেনসন কিনতে হলে টাকা লাগে। কাগজ না। তাছাড়া আপনি আমাকে সিগারেট কিনে দিতে হবেনা। আমি ঠাট্টার ছলে বলেছি। আমি চাইনা আমার মৃত্যুর দায়ে অন্য কেউ দায়ী হোক। মেয়েটা হাসল। সে হাসিতে সন্তুষ্টি নেই। আছে চিন্তা। এত কি চিন্তা মেয়েটার?

– আহা, কাগজটা আপনার। নিন ধরুন।
– আমার?
– জ্বি আপনার।
– আমার কেন?
– যে বিশ নাম্বার পার্সেলটা আমি খুলেছিলাম তার মধ্যে এই ছোট্ট চিরকুটটা ছিল। আর এটাই আমার সবথেকে বড় অপরাধ যে আমি চিরকুটটা পড়ে ফেলার লোভ সামলাতে পারিনি।

– ওহ তাই নাকি? কি লেখা ছিল ওতে?
– আপনি নিজেই দেখে নেবেন প্লিজ৷
– আপনার কি ধারণা আমি চিরকুটটা খুলব?
– আমি জানিনা।

খুলতেও পারেন। আবার নাও খুলতে পারেন। ইটস আপ টু ইউ টোটালি। বাই দ্যা ওয়ে, একটা ব্যান্সন এর প্যাকেট আমার তরফ থেকে আপনাকে নিতেই হবে। নিয়ে পরে ফেলে দিলেও চলবে। অন্তত আমি অপরাধ মুক্ত হতে পারব।

বিড়বিড় করে বললাম ” এই পৃথিবীর তাবত মানুষ কেবল দায়মুক্ত হতে চায়”। মেয়েটা বলল- আমাকে কিছু বললেন? আমি আর জবাব না দিয়ে চিরকুটটা হাতে নিলাম। গোলাপি রঙের দেয়ালিকার কাগজ। ভাঁজ করা। ভাঁজের এক কর্ণারে কাগজ দিয়ে বানানো নীল রঙের একটা ছোট্ট ফুল গাম দিয়ে লাগানো। আচ্ছা কোন কোন ফুলের রঙ নীল? কচুরিপানা? নাকি জবা? উহু জবার রঙ তো লাল। টকটকে লাল। চিরকুট টা কি খুলব? মন সায় দিলো না। মন বলল চিরকুটটা খুললেই নিশ্চিত এমন কিছু লেখা থাকবে যা বোঝার জন্যে অবশ্যই বাকী পার্সেলগুলো খুলে দেখতে হবে। কিন্তু তা আমি করব না। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, পার্সেলগুলো আমি কখনোই খুলব না৷

সেদিনের ই রাতের কথা। ঘুম ভেঙে গেছে আচমকা একটা সুস্বপ্ন দেখে। সুস্বপ্নটা কি ছিল মনে নেই। তবে এটা মনে আছে স্পষ্ট, স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি হাসছিলাম ক্রমাগত। হাসতে হাসতে আর কোন ই কাজ ছিল না। শেষমেশ উপায় না দেখে আমি হাসি থামানোর জন্যে স্বপ্ন থেকে দৌড় দিলাম। দৌড় দিতে গিয়েই ঘুম ভেঙে গেল। তার মানে কি দাঁড়ালো সুখ ও মানুষকে দৌড় করিয়ে নেয়? বিছানা ছেড়ে উঠেই পানি খেতে খেতে হঠাত ইচ্ছে করল কুরিয়ার সার্ভিসের মেয়েটাকে ফোন দেয়ার। এত রাতে কি একটা মেয়েকে কি ফোন দেয়া যায়? এইটা কি আইনত সহীহ? ফোন দিলেও কি বলব? মনে মনে ভাবতে লাগলাম। কয়েকটি কাল্পনিক কথোপকথন নিজে নিজেই ভেবে নিলাম। কথোপকথন গুলো নিম্মরুপঃ কথোপকথন ০১ঃ

– হ্যালো আপনি কি কুরিয়ার সার্ভিস?
– আমি কুরিয়ার সার্ভিস না। আমি কুরিয়ার সার্ভিসের সেই মেয়েটা।
– আচ্ছা আমি এত রাতে আপনাকে ফোন করেছি কেন তা আমি জানিনা। আপনি কি কিছু জানেন?
– আজব তো! ফোন কেন করেছেন আপনি। কিন্তু কেন তা জানেন না?
– না জানিনা৷
– কেন?
– পুরুষ মানুষ এমন অনেক কিছুই জানেনা।
– তবে?
– নারী সব জানে। নারী হল পুরুষ মানুষের বহিরাগত জগতের এন্সাইক্লোপেডিয়া।
– হ্যালো। টুট…. টুট.. কথোপকথন০২ঃ

– হ্যালো।
– হ্যালো।
– কে আপনি?
– আমি সে আরকি।
– আরেবাবা কোন সে?
– ঐ যে যার চিরকুট চুরি করে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েন!
– ওহ মাই গড! আপনি? এত রাতে কল? আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন? (বেশ খানিকটা বিস্মিত গলা)
– আসলে একটা কথা বলা হয়নি তাই ফোনটা করলাম।
– জ্বি, বলুন।

– আপনার ডান হাতটা অনেক সুন্দর। বাম হাতটা দেখা হয়নি। এখন দেখতে ইচ্ছে করছে।
– এএএএএএ! কি বলছেন?
– ইচ্ছেটা সহীহ না। তবুও করছে। মানুষের ম্যাক্সিমাম ইচ্ছে ই সহীহ হয়না। আচ্ছা, বাম হাতে কি কোন রিজব্যান্ড পরেন? অর্থহীন কিংবা শিরোনামহীন?
– আমার হাতে রিজব্যান্ড পরি সেটাও দেখে নিয়েছেন?
– হ্যা।
– কেন?
– আমি জানিনা।
– কে জানে?
– আমার চোখ। বাম চোখ আর ডান চোখ। রেটিনা, কর্ণিয়া, একুয়াস হিউমার, ভিট্রিয়াস হিউমার, রড, কোণ ওরাও জানতে পারে। টুট….টুট…. ঐপাশ থেকে মেয়েটা হ্যালো হ্যালো করবে। কথোপকথন ০৩ঃ

– হ্যালো।
– হ্যালো কে?
– আপনি কে?
– আমি কে মানে?
– আপনি কুরিয়ার সার্ভিস না?
– না আমি কুরিয়ার সার্ভিসের আব্বা।
– একি ওর ফোন আপনি ধরেছেন কেন? মেয়েদের ফোন ছেলেরা ধরতে নেই এইটা জানেন না?
– গাঁজা কখন খেয়েছিস? রাত বিরেতে বাসিটা খেয়েছিস নাকি?( একটা ভারী কর্কশ পুরুষ গলা)
– আজব আপনার গলা হঠাত করে পুরুষের মত হয়ে গেল কেন?
– দাড়া শালা, এক্ষুণি তোর নাম্বার ট্র‍্যাকিং এ পাঠাচ্ছি। রাত বিড়েতে মেয়েদের নাম্বারে ফোন করে লাফাংগাগিরি করিস?

সাত পাঁচ ভেবে আর কল দিইনি। ভাবছি মেয়েটার কিনে দেয়া সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরাবো। সিগারেট ধরাতে ধরাতে ক্লু মেলাবো৷ পার্সেলের ক্লু৷ এতগুলো পার্সেল কে পাঠায় আমার নামে। আমিতো এদেশের নামকরা সুদর্শন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি না যে, আমার এত বড় ওয়েল উইশার থাকবে। যে কোন আওয়াজ ছাড়া দিনের পর দিন এতগুলো পার্সেল পাঠিয়ে যাবে। কি হচ্ছে এসব? মিসচেরিয়াস কিছু না তো আবার? নিজের সাথে নিজের অমন একরোখা প্রতীজ্ঞা করাটা ঠিক হয়নি, কেন যেন এই মুহূর্তে পার্সেলগুলো খুব খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে।

সাত পাঁচ ভাবছি তক্ষুণি ফোন টা বেজে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত তখন একটা সাতাশ। এত রাতে আননোন নাম্বার থেকে ফোন। ধরব? নাকি না? না৷ ধরি। গভীর রাতে কেউ ফোন দিয়ে খুচরা আলাপ করেনা। গভীর রাতের ফোন কল এ ভেসে আসে খুব জরুরী খবর। কারো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার রুক্ষ আর্তনাদী খবর অথবা এইমাত্র পৃথিবীতে মাত্র ভুমিষ্ঠ হওয়ার সুখবর। রিসিভ করে হ্যালো বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই ওপাশ থেকে একটা অস্থির মেয়েলী গলা কথা বলে যেতে লাগল।

– হ্যালো মিস্টার ওমেদ । আপনি কাজটা একদম ঠিক করেননি। আপনার মত এমন খামখেয়ালী পুরুষ আমার জীবনে দেখিনি, শুনিওনি। ইউ আর এ পিওর কেয়ারলেস। আপনাকে আমি কাছে ফেলে জাস্ট আমার বডি বিল্ডার ফ্রেন্ডদের দিয়ে পিটিয়ে বেহুশ করিয়ে ছাড়তাম। কন্ঠস্বর আর অস্থিরতা শুনে আন্দাজ করতে পারলাম মেয়েটা টিনেজার। হয়ত কোন কারণে আমার উপর দারুণ খেপে আছে। চট করে মাথায় এলো, এইটা কি সেই মেয়েটা যে আমাকে মোট পঁচিশটা পার্সেল পাঠিয়েছে। হতেও পারে। আমার কিছু বলা উচিত।

– হ্যালো মিস আননোন টিনেজার গার্ল, উত্তেজিত হবেন না। ধীরে সুস্থ্যে বুঝিয়ে বলুন, আপনি কেন আমাকে আপনার বডি বিল্ডার ফ্রেন্ডদের দিয়ে মারতে চান? আর মারলেও ওরা সংখ্যায় কজন থাকবে? লোকেশন কোথায়? মারামারির এক পর্যায়ে কোন ব্রেক থাকবে কিনা? আমাকে মেরে বেহুঁশ করে ফেলার পর হাসপাতালে ওরা পৌছে দেবে কিনা। নাকি সেল্ফ সার্ভিসে যেতে হবে? একথাগুলো শোনার পর ওপাশ থেকে টিনেজার গলার মেয়েটা সাপের ফনা তোলার আওয়াজের মতন শোঁ শোঁ করছে। শুনতে পাচ্ছি। তার সেকেন্ড কয়েক পর হঠাত খুব কান্নার আওয়াজ। মেয়েটা কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতে কিছু একটা বলে উঠছে। প্রথমে শোনা যাচ্ছিলো না। তারপর নিজেই নিজের কান্না সামলে আবার বলে উঠল

– আপনি আমার আপুকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করবোনা।

– আপনার কোন আপু? মেজো আপু? নাকি সেজো আপু?

– আমার মিম্রতা আপু।

– বাহ খুব সুন্দর নাম তো! কবিতা কবিতা স্মেল আছে।

– কমেডি করবেন না মিস্টার ওমেদ হাসান। আই জাস্ট হেইট ইউ।

– কিভাবে কষ্ট দিয়েছি? আপনার মিম্রতা আপু সে ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে? নাকি জাস্ট কষ্ট দিয়েছি এইটুকুন ই বলেছে? প্রশ্নটা শুনে মেয়েটা চুপ। ভাবলাম ফোন কেটে দিয়েছে। কান থেকে ফোন নামিয়ে হাতে এনে দেখি, না কাটেনি। আছে এখনো লাইনে। বোধয় আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তেমন ই আওয়াজ।

– আপু আজ রাতে এই শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেছে মিস্টার ওমেদ হাসান। আর আসবেনা! জাস্ট বিকয অব ইউ আই হ্যাভ লস্ট মাই সোলমেট৷
– কি হয়েছে বলুন তো। আমি সিরিয়াস এখন। শুনতে চাই।
– একটা মানুষ আপনাকে কতটা ভালোবাসলে আপনাকে দিনের পর দিন পার্সেল পাঠায়? সেই পার্সেলগুলা আপনি খোলেন না জেনেও, বেহায়ার মতন পাঠাতেই থাকে। আপনি এতটাই আনরিয়েল পার্সন যে, একটা মানুষ রোজ আপনার সামনে তার ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অথচ একটাবার না ফিল করেন না বোঝার চেষ্টা করেন। এতটা ইগো আপনার!

– সত্যি করে বলুন তো মিম্রতা টা কে?
– আপনি এখনো চিনতে পারেননি মিম্রতা কে? ঢং করেন?
– আমি জিজ্ঞাসা করেছি মিম্রতা টা কে?
– মিস্টার ওমেদ হাসান!
– প্লিজ টেল মি হু ইজ মিম্রতা।

টিনেজার মেয়েটা ফোনের ওপাড়ে এবার জোরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সেই কান্নায় কেমন বিষাদ! আমি চুপ করে অপেক্ষা করছি, মিম্রতা কে এটা জানার৷ রাত বাড়ছে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত রাতের সংগে সংগে জীবনে এই প্রথম আমার হৃদয়ের হৃদস্পন্দন ও বাড়ছে। একসময় কান্না জড়ানো গলায় মেয়েটা ফুঁপিয়ে বলে চলল-

– মিম্রতা সেই মেয়েটা যার হাত দিয়ে আজ এক প্যাকেট বেন্সন কিনে নিলেন। সেই মেয়েটাই মিম্রতা যে স্রেফ আপনাকে দেখতে পাবে বলে কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ নিয়েছে। দিনের পর দিন আপনাকে রাজ্যের সব পার্সেল পাঠিয়ে গেছে। মিম্রতা সেই মেয়েটা যে দিনের পর দিন আপনার অবহেলা সয়ে সয়েও নীরবে ভালোবেসে গেছে মিস্টার ওমেদ হাসান। কলটা কেটে দিলাম। আমার এক্ষুণি সবকটা পার্সেল খুলে দেখতে হবে। মিম্রতা কে খুজে বের করতে হবে। ওর সাথে আমার অনেক কথা আছে। অনেক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত