রাত আটটা বাজে। সোহান সবে অফিস থেকে বাসায় এল। ওর শার্টের পেছনের দিকটা ঘেমে আছে৷ কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে৷ বাসায় এসেই সোজা নিজের রুমে ঢুকল ও। ফ্যানের সুইচ দিল। অফিস ব্যাগটা খাটের উপর রাখল। মিতু এক গ্লাস পানি নিয়ে রুমে এল খানিক পরেই। পরিষ্কার গ্লাস। ঠান্ডা পানি। সোহান অফিস থেকে এলে ঠান্ডা পানি খেতে পছন্দ করে। একদম ঠান্ডা নয়৷ মোটামুটি ঠান্ডা৷ সোহান ঠান্ডা পানি বেশ আগ্রহ নিয়ে খায়৷ মিতু তা আড়চোখে দেখে৷ মানুষটা পানি খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে খায়৷ কী মায়া লাগে তখন! কারো পানি খাওয়াও বুঝি এতো সুন্দর হয়! মিতুর সারাদিনের ক্লান্তি যেন তখনই পালিয়ে যায়৷ এতো ভালো লাগে যা বলার মতো না। এই একটা মূহুর্তের জন্যে মিতু সারাটাদিন অপেক্ষা করে৷
তার অপেক্ষা করতেও আনন্দ লাগে৷ মিতু গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল সোহানের দিকে৷ সোহান পানির গ্লাস নিল। এক ঢোকে সবটা গিলে ফেলল সে। খালি গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল মিতুর দিকে। মিতু গ্লাসটা খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে নিল। সোহান ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। এমনটা প্রায়ই হয়৷ সে মিতুকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না৷ আজকাল মিতুর কোনো কিছুতেই প্রাণ খুঁজে পায় না সে৷ মিতুকে বড় পর মনে হয়৷ যেন মিতু বাধ্য হয়ে থাকছে তার সাথে৷ সোহানের মন খারাপ হলো৷ ছয় মাস হয়েছে বিয়ের। এই ছয় মাসে দুটো দেহ হয়তো খুব কাছাকাছি এসেছে; কিন্তু দুটো মন এখনো কাছাকাছি আসতে পারেনি৷ দু’মনের মাঝে কোথাও যেন প্রচুর দূরত্ব রয়েছে৷ সে দূরত্বটা সম্পূর্ণ মিতুর মনেই৷
তার মনে কোথাও না কোথাও একটা দেয়াল তৈরী হয়েছে৷ সোহান খুব করে চাইছে সে দেয়াল ভাঙ্গতে,ডিঙ্গিয় ে যেতে৷ কিন্তু কোনো ভাবেই সে সফল হয়নি৷ বরং দূরত্বটা যেন বেড়েই যাচ্ছে৷ সোহানের সহ্য করতে কষ্ট হয়৷ কীভাবে এমন আপন-পরের দ্বিধা নিয়ে একটা মেয়ের সাথে যায়৷ কীভাবে? মিতুর তৈরী করা দেয়াল আজ সোহানের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তার দম বন্ধ লাগে৷ অসহ্য লাগে৷ রাতে যখনই মিতুকে জড়িয়ে ধরতে যায় তখনই যেন মন থেকে কিছু একটা বাধা দেয়৷ সায় দেয় না। সোহানের মনে হয় মিতু চাইছে না ওকে। কিংবা ওকে চায়; অথচ বলতে পারে না৷ মনে দ্বিধা থেকে যায়৷ দেয়ালে বাধা খায় তার সকল কথা৷ সকল আকুতি, মিনতি।
সোহান জানে যে দেয়ালটা কেন তৈরী হয়েছে। সে সবটাই জানে৷ তার জন্যে সে নিজেই দায়ী৷ একটু প্রতিবাদ করলে হয়তো আজ এই দিনটা দেখতে হতো না৷ কিন্তু সেও বা কী করবে৷ বাবা মায়ের পরে তার কোনো কথা চলে না৷ আজো যেন তার বাবা মা তাকে সেই ছোট্ট সোহান ভাবে৷ এদিকে সে এই দু’মনের বৃহৎ দেয়ালের মাঝেও আর থাকতে চাইছে না৷ ও চাচ্ছে কোনো রূপ ঝগড়াঝাটি না করে দেয়ালটা ডিঙ্গিয়ে যেতে। কিন্তু সে তা কিছুতেই পারছে না৷ সম্ভবই হচ্ছে না৷ এই সমস্ত ব্যপারটি তার কাছে মস্তবড় বোঝা মনে হচ্ছে। সে আর নিতে পারছে না৷ এই ছয়মাসে ব্যাপারটা তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে৷ ও চাইছে এবার কোনো বিহিত হয়ে যাক৷ এতে যদি ঝগড়াঝাটি হয়, তবে তাই হোক! অন্তত আজ একটা বিহিত হবেই৷ সোহান উঠে দাঁড়ালো। মিতুর একদম কাছে চলে এল সে। মিতু খানিকটা ঘাবড়ে গেল৷ সোহান বলল,
-আমরা দু’জন এখন তো খুব কাছে তাই না? দেখ আমাদের মাঝে দূরত্ব এক আঙ্গুলেরও নয়। তবুও কেন আমার এমন মনে হয় যে তুমি আমার কাছে নও৷ খুব দূরে। আমি তোমার মনকে ছুঁতে পারছি না৷ কেন এমন মনে হয় বলতো মিতু? মিতু খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল৷ সোহানের কপালে নিজের ডান হাতের উল্টো পিঠ রাখল। বলল,
-তোমার কি শরীর খারাপ? কই গায়ে তো জ্বর টর নেই।
-এই যে, দেখোনা! তুমি যে আমার কপালে হাত রাখলে তাও আমার কাছে নিষ্প্রাণ মনে হলো। লোক দেখানো মনে হলো৷ আমার কেন এমন মনে হয় বলতো? কেন?মিতু, আমি না আর নিতে পারছি না। আমার অসহ্য লাগছে। সত্যি করে বলতো মিতু! তুমি আমাকে চাও না? ডিভোর্স চাও?
মিতু চোখ বড় করে তাকালো৷ তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল৷ মনের ভেতর ঝড় বইতে শুরু করল। নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না৷ কী বলছে মানুষটা! মিতু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কেবল। কী বলবে ভেবে পেল না। ঠিক তখনই সোহানের বাবা আরফান সাহবে রুমে ঢুকলেন। মিতু খানিকটা সরে দাঁড়াল। মাথার উপর আচল তুলে দিল। মাথা নিচু করে রাখল। আরফান সাহেবকে আজ বেশ উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তাঁর মন আজ বেশ ভালো। কোনো একটা কারণে তিনি বেশ আনন্দবোধ করছেন৷ তিনি সোহানকে দেখেই উচ্চস্বরে বললেন,
-কিরে সোহান? কখন এলি তুই বাবা? তারপর মিতুর দিকে তাকিয়ে বেশ কোমল স্বরে বললেন,
-মিতু, তোমাকে না বলেছিলাম সোহান এলে বলবে আমি ডেকেছি ওকে। বলনি সেটা? মিতু জবাব দিবে ঠিক তার আগেই সোহান বলে উঠল,
-আমি অল্প আগে অফিস থেকে ফিরলাম বাবা। জামাও চেঞ্জ করিনি৷
-অহ হো! আমি তো খেয়ালই করিনি৷ আশ্চর্য! কী যে হয়ে গেল আমার! আচ্ছা তুই চেঞ্জ করে বসার ঘরে আয়৷ জলদি আসবি। জরুরি কথা আছে তোর সাথে। যা যা! চেঞ্জ করতে যা। আর মিতু? তুমি এক কাজ করো৷ জলদি করে দু কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসো৷ বাপ বেটা চা খেতে খেতে কথা বলব৷ কেমন?
মিতু মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর সোহানের দিকে তাকালো একবার৷ সোহান আগ থেকেই ওর তাকিয়ে ছিল৷ মিতু তাকাতেই একটা গভীর চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের মাঝে। তার দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক সরলতা ছিল। যা সোহানের মনকে বেশ অভিভূত করল। সোহান খানিক অবাকও হলো৷ এই ছয় মাসে মিতু কখনই এভাবে তাকায়নি৷ লাস্ট তাকালো যেদিন সেদিন মিতুকে দেখতে গিয়েছিল ওরা৷ ওর এই তাকানোর প্রেমেই পড়ল সোহান৷ আজ এতদিন পর হঠাৎ মিতুর দৃষ্টিতে এমন সারলতা সত্যিই পুনরায় মোহিত করল তাকে। এছাড়াও আজ তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল৷ সেই কিছু একটা সোহানের মনে অদ্ভুত একটা আনন্দের প্রভাব ফেলল৷ তার মনে হলো সে আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি মানুষ৷ মিতু দ্রুতই রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷ সোহান ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল৷ আরফান সাহেব বললেন,
-কিরে? দাঁড়িয়ে আছিস যে? যা না! জলদি যা৷
সোহান চেঞ্জ করতে গেল৷ আরফান সাহেব বসার ঘরে গিয়ে বসলেন৷ উনি বসতেই উনার স্ত্রী মিসেস উর্মিলা হাসান বসার ঘরে এসে বসলেন৷ বসেই আরফান সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-বলেছো ওকে? আরফান সাহেব দ্রুত জবাব দিলেন,
-হ্যাঁ। বললাম। আসছে৷
উনার দুজন অধীর আগ্রহে সোহানের আসার অপেক্ষা করছেন৷ রান্না ঘরে টুংটাং শব্দ হচ্ছে৷ মিতু চা তৈরী করছে৷ আজ চা তৈরি করতে তার কেন জানি খুব ভালো লাগছে৷ অন্য রকম একটা আনন্দ তার সমস্ত হৃদয় ভাসিয়ে দিচ্ছিল৷ এই প্রথমবারের মতো তার শশুর তার সাথে এত সুন্দর ব্যবহার করলেন৷ কী সুন্দর, কোমল স্বরে চা বানানোর কথা বললেন তিনি৷ ইশ! এমন যদি সব সময় বলতেন কত ভালোই না হতো৷ মিতু চা বানিয়ে কাপে ঢালতে থাকল৷ ঢালতে ঢালতে মৃদ্যু স্বরে গানও গাইলো৷ মিতু তিন কাপ চা নিল৷ তার শাশুড়ীকে চা দিতে হবে এক কাপ। উনি বসার ঘরে আসলে তখন দিবেন। না হয় সে নিজেই গিয়ে দিয়ে আসবে৷ সাথে বিস্কুটও দিয়ে আসবে। সে এক প্লেট বিস্কুট নিল৷ একটা ট্রে তে চায়ের কাপ গুলো এবং বিস্কুট নিয়ে কিচেন রুম থেকে বের হলো সে৷ এই অল্প সময়ে, তার এতো আনন্দ হলো যে সে ভুলেই গেল সোহান তাকে ডিবোর্স এর কথা বলেছে৷ কথাটা মনে পড়লে হয়তো তার মন খারাপ হয়ে যেত৷ হয়তো হতো না৷ আরফান সাহেব বললেন,
-সম্পূর্ণ ব্যাপারটা তোকে খুলে বলা দরকার৷ শুনে তুই যেমন সারপ্রাইজড হবি তেমনি খুশিও হবি। প্রথম প্রথম তোর বিশ্বাস করতে মন চাইবে না৷ আরে, ওরা যখন আমাদের বাসায় এল তখন তো আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ আমি তো পুরোই অবাক। হাহাহা! সোহান তার বাবাকে দেখে খানিক অবাক হলো৷ বলল,
-জলদি করে বল না বাবা! শুনি তোমার মূল্যবান কথাটা।
ঠিক তখনই চা নিয়ে হাজির হলো মিতু। সে চায়ের ট্রে-টা টি-টেবিলের উপর রাখল। তারপর এক এক করে সবার হাতে দিতে থাকল৷ তার শ্বাশুড়ির দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিতেই তিনি মোটা স্বরে বললেন,
-কাপটা রাখো ওখানে৷ আমি নিয়ে নিবো।
মিতু কাপটা রেখে দিল। বিস্কুটের প্লেটটা ওখানে রেখে ট্রে নিয়ে কিচেনে চলে গেল। মায়ের এই একটা ব্যাপার খুব লক্ষ্য করল সোহান। তিনি কখনই মিতুর হাত থেকে কোনো কিছু নিয়ে খান না৷ কেমন যেন একটা দাম্ভিক ভাব নিয়ে থাকেন৷ কিংবা, হয়তো কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি মিতুর হাত থেকে কোনো কিছু নিয়ে খেতে পছন্দ করেন না। আরফান সাহেব চায়ে এক চুমুক দিয়ে সোহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-সেদিন হঠাৎই আমাদের বাসার কলিং বেল বেজে উঠল৷ আমি দরজা খুলেই খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ কেবল বোকার মতো চেয়ে থাকলাম। আরফান সাহেব কৌতুহল তৈরী করে কথা বলতে পছন্দ করেন৷ কথাকে আকর্ষণীয় করার জন্যে নানা রকম বিশেষণ যোগ করেন। যাতে শ্রোতার আগ্রহ জাগে৷ কিন্তু এসবের কিছুতেই আগ্রহ পেল না সোহান। সে নির্লিপ্ত ভাবে বলল,
-কে এসেছিল সেটা বল বাবা। এতো ভনিতার প্রয়োজন নেই৷
-বলছি শোন, সেদিন তিনজন লোক এসেছিল।
তারমধ্যে একজন ছিলেন ‘আর্টেক্স টেক্সটাইল’ কোম্পানির ওনার জনাব আরাফাত রহমান৷ তাঁর কোম্পানিটা বাংলাদেশের টপ কয়েকটা টেক্সটাইল কোম্পানীর মধ্যে একটি৷ তিনি, তাঁর ওয়াইফ এবং তাঁর ছেলে সহ আসলেন আমাদের -বলছি শোন, সেদিন তিনজন লোক এসেছিল। তারমধ্যে একজন ছিলেন ‘আর্টেক্স টেক্সটাইল’ কোম্পানির ওনার জনাব আরাফাত রহমান৷ তাঁর কোম্পানিটা বাংলাদেশের টপ কয়েকটা টেক্সটাইল কোম্পানীর মধ্যে একটি৷ তিনি, তাঁর ওয়াইফ এবং তাঁর ছেলে সহ আসলেন আমাদের বাসায়৷
-আচ্ছা! কেন এসেছিলেন?
মিসেস উর্মিলা হাসান চায়ের কাপটা হাতে নিলেন তখন। এর আগে তিনি বিস্কেট নিয়েছেন একটা৷ মিতু পানির জগ আর গ্লাস দিয়ে গেল এর খানিক আগেই৷ তিনি পানি খেয়েই চায়ের কাপ হাতে নিলেন এবং প্রথম চুমুক দিলেন চায়ে। চুমুক দিতেই উনার মনটা ভালো হয়ে গেল। কারণ আজকের চা টা অসাধারণ হয়েছে৷ এই অসাধারণ চা খাওয়ার পরও তাঁর মুখের উপর দাম্ভিকতার যে ছাপ তা গেল না৷ স্পষ্টই রয়ে গেল। আরফান সাহেব সোহানের প্রশ্নের জবাব দিলে এর মাঝেই,
-আরে বোকা! কেন এসেছিলেন বুঝিস না৷ উনারা তোর ছোট বোন ঈশিতার সাথে উনাদের ছেলে আয়ানের বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এলেন।
-ও আচ্ছা৷
-শুধু ‘ও আচ্ছা?’
তোর তো দেখি কোনো রিয়েকশনই নেই৷ আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে৷ শোন, রহমান সাহেবের ছবি প্রায়ই ম্যাগাজিনে দেখতাম। ম্যাগাজিনে উনার ছবি গুলো দেখে মনে হতো তিনি খুব গম্ভীর রগচটা টাইপের মানুষ। কিন্তু সেদিন কথা বলার পর আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো৷ তিনি এতো অমায়িক বলার মতো না৷ এত সুন্দর করে, ধীরে ধীরে কথা বলেন! সত্যিই মুগ্ধকর৷ ছেলেকেও দারুণ শিক্ষা দিলেন৷ ছেলেটা আমার পাঁ ছুঁয়ে সালাম করল। ভাব একবার! এ যুগে কেউ এসব করে? এতো ভালো লাগল আমার! আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম চরিত্রে দাগ নেই ওর৷ মাশাল্লাহ, যেমন সুদর্শন তেমনই সুশিক্ষিত।
-তুমি খোঁজও নিয়ে নিলে বাবা?
-হ্যাঁ৷ বিয়ের কথাও পাকাপাকি করে ফেললাম৷
-হ্যাঁহ! বল কি? আমাকে একবার জানালেও না?
-তোকে আর কী জানাবো৷ ছেলে ভালো,আর্থিক অবস্থাও দারুন এখানে নিষেধ করার কোনো প্রয়োজন মনে করিনি৷ তারাও আমাদের মেয়ের মতো একটা মেয়ে চাচ্ছিল। তাই আর নিষেধ করিনি৷
-কিন্তু তুমি না এসব কোম্পানিতে চাকরি করা লোকদের পছন্দ করো না৷ তুমি তো বললে ক্যাডার ছাড়া ঈশিতাকে বিয়ে দিবে না৷
-তুই কী করছিস? তুইও তো কোম্পানিতে চাকরি করছিস আমার অমতে। এত করে বললাম বিসিএস দিতে দিয়েছিস? তোকে যেভাবে মেনে নিয়েছি ঠিক সেভাবেই ওকে মেনে নিলাম। বুঝলি?
-বুঝলাম৷ ভালোই৷
-এখন মোস্ট ইম্পর্টেন্ট যে কথাটা সেটা বলি৷ শোন, তারা বিয়েতে উপহার হিসেবে ছেলের জন্যে একটা ব্রেন্ড নিউ কার চেয়েছেন৷
-তুমি কি কোনোভাবে যৌতুকের কথা বলছো বাবা?
-হ্যাঁ৷ ওই রকমই। বড় লোক মানুষ তারা।
আকারে ইঙ্গিতে বুঝালেন আরকি। তোর শশুর তো আমাদের ঠকালেন৷ সস্তা, সেকেন্ড হ্যান্ড একটা গাড়ি গুঁজে দিলেন আমাদের৷ আমরা তো আর তাদের মতো করতে পারি না৷ আমাদের তো একটা ক্লাস আছে না!
সোহানের মুখটা শক্ত হয়ে গেল। ভেতরটা একদম জ্বলে গেল তার৷ আরফান সাহেব যেন কথাটা ভুলছেনই না৷ তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে এই বিষয় গুলো টেনে আনেন। প্রায়ই এমনটা করেন৷ তোর শশুর ওই জিনিস দেয়নি,অমুক জিনিস কম দিয়েছেন, কম দামি জিনিস দিয়েছেন, ওই মানুষটা ঠকবাজ, প্রতারক। তিনি প্রায়ই এসব বলেন৷ সোহানের রাগ হলো খানিক। তবুও সে চুপ করে থাকল৷ শক্ত হয়ে বসে থাকল৷ রান্নাঘরে থাকা মিতু আধোয়া প্লেট গুলো ধুয়ে সবে এক কাপ চা নিয়ে বসল খেতে৷ চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে সবে মুখে দিবে ঠিক তখনই শুনতে পেল, “তোর শশুর তো আমাদের ঠকালেন৷” বিস্কুটের ভেজা অংশটা পড়ে গেল। মুখে দেয়া হয়নি আর৷ চোখে জল জমে গেল দ্রুত। এমনকি এক ফোটা গড়িয়ে পড়ল টাইলস করা মেঝেতে। আর যাই হোক, তার বাবার সম্পর্কে কেউ কিছু বললে তার মন খারাপ হয়৷ কান্না পায়৷ তাকে প্রায়ই কান্না করতে হয় এমন৷ কারণ তার শশুর এবং শ্বাশুড়ি প্রায়ই তাকে এই কথা গুলো বলে খোঁটা দেন৷ মিতু চা টা খেল না আর৷ কিচেনের মেজেতে থাকা চা টা নির্লিপ্তের মতো পড়ে থাকল৷ মিতু চুপচাপ বসে থাকল কেবল। একটু নড়লও না৷ ওর ওখান থেকে নড়তেও ইচ্ছে হলো না৷
-আমি একটা গাড়ি দেখেছিলাম৷ বেশ পছন্দ হয়েছে৷ আমার মনে হয় ওটাই ওদের জন্যে যথার্থ হবে৷ এর কমে গেলে ব্যাপারটা একদম লো হয়ে যাবে৷ আমাদেরও একটা ক্লাস বজায় রাখা উচিৎ তাই না? আরফান সাহেব কথা গুলো বললেন।সোহান কিছু বলল না। কেবল চুপচাপ বসে থাকল৷ কিছু একটা ভাবছিল যেন। আরফান সাহেব আবার বললেন,
-গাড়িটার দাম সর্বশেষ আশি লাখ এর মতো হবে। আমার কাছে ছবি আছে৷ দাঁড়া তোকে দেখাই।
-না না। আমার দেখার প্রয়োজন নেই৷ তুমি দেখেছো তো। এতেই হবে৷ আমি দেখেও বা আর কী লাভ বলো!
-হ্যাঁ। তাও ঠিক। এখন কথা হলো টাকা৷ টাকার প্রয়োজন। তোর সেভিংসে কতো আছে? কত দিতে পারবি তুই?
সোহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-আমি একটু আসছি৷
এই বলে কিচেনের কাছে এসে মিতুর নাম ধরে দুবার ডাক দিল৷ ডাকতেই মিতু দৌড়ে এল। সোহান মিতুর হাত ধরে নিজেদের রুমে নিয়ে গেল। ঠিক তখনই বসার ঘরে প্রবেশ করল ঈশিতা। এসেই সে চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। কোনো এক বিচিত্র কারণে তার মন খারাপ৷ সেই বিচিত্র কারণটা কি তাদের ভার্সিটির নুহান নামের ছেলেটা নাকি এই বিয়ের ব্যাপারটা সেটা ঠিক সে নিজেও বুঝতে পারছে না৷ আবার হয়তো এই দুটো ব্যাপারই কোনো না কোনো ভাবে তার মন খারাপের কারণ। সে মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ঈশিতাকে দেখতেই এক গাল হাসলেন আরফান সাহেব। বললেন,
-আয় মা আয়। আমার পাশে এসে বস। ঈশিতা নাক উঁচিয়ে বলল,
-না বাবা৷ আমি এখানেই ঠিক আছি৷
এ কথা বলার পরই সোহান এল বসার ঘরে। সোফায় বসল। সোফার সাথে গা এলিয়ে দিল একদম। সোহানের আম্মু বলে উঠল,
-কিরে? রুমে গেলি কেন আবার। সোহান দ্রুত জবাব দিল,
-একটা পার্সোনাল কাজ ছিল। সেটাই সেরে আসলাম। তা মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সত্যি সত্যি জবাব দিবে কেমন?
-অবশ্যই৷ বল না কী বলবি।
-তোমার আর বাবার তো প্রেম করে বিয়ে করতে হয়েছে তাই না? উর্মিলা হাসান খানিকটা লজ্জা পেলেন৷ মৃদু হেসে বললেন,
-হ্যাঁ। সোহান হাসল না। মুখ শক্ত করে বলল,
-আচ্ছা মা, বাবাদের পক্ষ থেকে কী তখন যৌতুক চাওয়া হয়েছিল? জবাবটা আরফান সাহেব দিলেন,
-যৌতুক চাওয়ার কোনো পথই ছিল না৷ কারণ আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম৷ হাহাহা৷
-তোমাদের বাবা মা পরে মেনে নেন নি? আরফান সাহেবের হাসিটা থেকে গেল। মুখটা ফ্যাকাসে করে বললেন,
-বাদ দে তো? এসব কেন জানতে চাচ্ছিস এখন?
-আসলে হঠাৎই দাদা দাদুর কথা মনে পড়ে গেল৷ আমরা তো কখনোই তাদের দেখিনি৷ আর নানা নানিকে নিয়ে তো কথাও হয়নি কখনও।
-বাদ দে এই ব্যাপার।
-আহা বলোই না৷
-আসলে বিয়ের পর প্রথমে বাবা মা মেনে নেন নি৷
পরে যখন মেনে নিয়েছেন তখন ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম থাকতে৷ কিন্তু মা বাবা দুজনেই কথায় কথায় খোঁটা দিত। পালিয়ে গিয়ে তাদের মানসম্মান ধূলোয় মিশালাম। এসব বলতেন। তোর মায়ের কষ্ট হচ্ছিল থাকতে৷ তাই আমরা এই বাসায় চলে আসি।
-উনাদের একা ফেলেই?
-কাজের মেয়ে ছিল একটা। ওকে রেখে আসি ওর কাছে৷
-হাহ! আর আমি বিয়ে করার পর তো কাজের মেয়েই কমে গেল।
আগে যেখানে বুয়া আসত তিনজন এখন সেখানে আসে একজন৷ ও হ্যাঁ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি তো টাকা দিয়ে একটা কাজের মেয়েকে কিনে নিয়ে এনেছি৷ যার বাবা আমাদের সেকেন্ড হ্যান্ড কার গিপ্ট করেছিল৷ যৌতুক হিসেবে৷ আরফান সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেলেন ছেলের কথা শুনে। উর্মিলা হাসানের মুখ শক্ত হয়ে এল। ঈশিতা ভ্রু কুচলে তাকালো ভাইয়ের দিকে। ঠিক সেই মূহুর্তে লাগেজ হাতে বেরিয়ে আসল মিতু। তার গাল বেয়ে তখন জল পড়ছিল৷ সোহান আবার বলল,
-বাবা,তুমি যেমন তোমার বাবা মাকে ছেড়ে চলে এসেছিলে তেমন যদি আমিও তোমাদের ছেড়ে চলে যাই তাহলে তোমাদের কেমন লাগবে বলতো?
-মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?
-আমি এটা বলতে চাইছি যে তোমরা কী আসলেই আমার মা বাবা? সত্যিকারের মা বাবা?
-সোহান? তোর মাথা টাতা গেছে নাকি?
কি সব আবোলতাবোল বলছিস? এই মিতু? রুমে নিয়ে গিয়ে ওকে কি শিখেছিস? ও এসব বলছে কোত্থেকে? আরফান সাহেব খানিকটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন৷ উঁচু স্বরে কথা গুলো বললেন৷ মিতু কিছু বলতে যাবে ঠিক তার আগেই সোহান বলল,
-উঁচু আওয়াজে কথা বলবে না৷ শান্ত ভাবে বসো বাবা। শান্ত ভাবে কথা বল৷ আর আমার ওয়াইফকে নিয়ে একটা কথাও বলবে না। ও তোমার কেনা গোলাম নয় যে ওকে যাচ্ছেতাই বলবে। এটা আমার আর তোমার মিটিং। এখানে ওকে না জড়ালেই ভালো হয়৷
-সোহান? তুই আমার মুখের উপর কথা বলছিস? তোর এত স্পর্ধা?
-এই কথা বলেই তো আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিলে বাবা৷ এই স্পর্ধা কোত্থেকে আসছে জানো? আমি সাহস পাচ্ছি কোত্থেকে জানো? তোমার থেকে। তুমি আমাকে বাধ্য করেছো এসব করতে।
-আমি? আমি কীভাবে তোকে বাধ্য করলাম?
-তুমিই করেছো।
তুমি তো মাজিস্ট্রেট ছিলে। দেশের প্রথম সারির শিক্ষিত নাগরিক। সেই উচ্চ শিক্ষায় তুমি কী শিখলে বাবা? কিভাবে যৌতুক দিতে হয়, নিতে হয়, কীভাবে ছেলের বউকে খোঁটা দিতে হয় এসব শিখেছো? এই তোমার শিক্ষা? এটাকে শিক্ষা বলে? যেখানে তুমি লড়বে যৌতুকের বিরুদ্ধে সেখানে তুমি নিজেই যৌতুক নিচ্ছো। এখন দিতেও চাচ্ছো? এটা শিক্ষা না বাবা। এটা শিক্ষা নামে কলঙ্ক।
-সোহান? তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করছিস?
-লিমিট তুমি ক্রস করেছো বাবা৷
আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছো৷ এই ছয়মাসে আমার জীবনের জঘন্যতম দিন পার করেছি আমি৷ যৌতুক দেয়া গাড়িতে করে অফিস যেতে হয়৷ আমি যখন এই গাড়িতে বসি না তখন আমার গা জ্বলে। মনে হয় কারো গলায় পাঁ চেপে বসে আছি আমি। কারো রক্ত চুষে খাচ্ছি। আমার ঘৃণা হয় তোমার উপর। তুমি জানো এই গাড়ি কিনতে কতটা বেগ পেতে হয়েছে মিতুর বাবাকে। জানো? হ্যাঁ এখন জানবে। নিজের মেয়ের বেলায় যখন দেখবে তখন বুঝবে সব৷ আমি তো এক টাকাও দিব না। এক পয়সাও না৷ তোমার তো আরো চারটে বাড়ি আছে এই শহরে৷ একটা বিক্রি করে দিলেই চলে। টাকা উঠে আসবে৷ কিন্তু তার জন্যে যে কতটা দৌড়াতে হবে সেটা তুমি কিছুদিন পরই টের পাবে বাবা৷ বিয়ের খরচ সব তুমিই দিবে। বিয়ের অনুষ্ঠান কিন্তু তাদের মতোই হতে হবে৷ ঝাকঝমক ভাবে৷ কষ্ট কাকে বলে টের পাবে তুমি বাবা৷ অবশ্যই পাবে৷ লজ্জায় মাথা হেট করে তো মেয়ে বিদায় দিবে না৷ কি জানি! হয়তো দিতেও পারো৷ তোমার যে কালো মন! যে নিচু চিন্তাধারা। না জানি আমার বোনটার কী হাল করো। আরফান সাহেব রাগে অনেকটা লাল হয়ে গেলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেকে কষে একটা চড় দিলেন। বললেন,
-দুধ কলা দিয়ে আমি কাল সাপ পুষেছি৷ বেরিয়ে যা এখান থেকে। আর কখনই তোর চেহারা দেখাব না আমাকে। বেয়াদব কোথাকার। তোর জন্মের পর তোকে কেন গলা টিপে মেরে ফেললাম না আমি। সোহান হাসল কেবল। বলল,
– তাই করতে বাবা৷ অন্তত নিজের বাবাত এই কুকান্ড দেখতে হতো না৷ আর চড়টা আরো আগে মারতে। অন্তত ততদিনে আমার আক্কেলটা হয়ে যেত৷ পেছন থেকে মিতু বলে উঠল,
-সোহান? কী করছো তুমি এ সোহান বলল,
-তুমি আর একটা কথাও বলবে না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো ওখানে। তারপর নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভেজা স্বরে বলল,
-মা! এবার তো অন্তত মুখের উপর থেকে এই দাম্ভিকতার মুখোশটা সরাও৷ তোমায় মানায় না এতে৷ কি জানি বলছিল বাবা! তোমাদের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে দাদা দাদি সারাদিন খোঁটা দিত তাই না? কেমন লাগত তখন মা? বুক কি ফেটে যেত না কষ্টে? এবার নিজেকে একবার মিতুর জায়গায় ভাবো? কী দেখো তুমি? আরেকটু ভাবো, কতটা কষ্ট সে পায়! তোমরা দু’জন কতটা কষ্ট দিয়েছো ওকে৷ খোঁটা দিয়ে দিয়ে মেয়েটার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছ তোমরা৷ পাথর করে তুলেছো ওর হৃদয়টাকে। উর্মিলা হাসান কান্না করে দিলেন। বললেন,
-সোহান? বাবা কী হয়েছে তোর? হঠাৎই এমন করছিস কেন? সোহান কান্না করে দিল এবার৷ ভেজা গলায় বলল,
-তোমরা যা করেছো এসব তারই ফল মা৷ আমি সব সময়ই যৌতুকের ব্যাপারটা ঘৃণা করে এসেছি। আর সেখানে তোমরা আমার উপরই এসব চাপিয়ে দিলে? এখন তো নিজের স্ত্রীকেও মনে হয় কেনা গোলাম। আমি কিনে এনেছি ওকে৷ গাধার মতো খাটাবো সারাদিন আর মেয়ের বাপের কাছ থেকে অমুক জিনিস,তমুক জিনিস আবদার করব৷ কোন রীতিতে লেখা আছে মেয়ে পক্ষকে খাট পালং দিতে হয়, আলমারি, সিন্দুক, ঘর সাজানো জিনিসপত্র দিতে হয়? কোথায় লিখা আছে এসব৷ প্রতি ঈদে দামি দামি জামাকাপড় দিতে হয় এসব কই লিখা আছে? এসব আমার মাথাটাকে খেয়ে ফেলেছে একদম। হ্যাং করে দিয়েছে।
আমার মনে হয় প্রতিদিন আমি একটা বোঝা নিয়ে ঘুরি। সেই বোঝাটার ওজন আজকাল আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। এত পাপ আর সইতে পারি না আমি৷ কারো রক্ত চুষে খাওয়া আর যৌতুক নেয়া দুটো ব্যাপারই আমার কাছে এখন এক লাগে। ছি বাবা৷ ছিহ! আমার ঘৃণা হয় তোমাদের উপর৷ তুমি বুঝবে বাবা৷ তুমি খুব দ্রুতই বুঝবে। একটু অপেক্ষা করো। আর শোনো, আমি যাচ্ছি তোমাদের ছেড়ে। আমি থাকতে চাইলেও থাকতে দিবে না জানি৷ আমি থাকবও না৷ এত কাছ থেকে বোনের উপর হওয়া অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারব না৷ আমি জানি তুমি আমার কথা শুনবে না৷ তবুও বলছি, আমার বোনটাকে ছেড়ে দিও৷ ওকে যেন আমার আর মিতুর মতো অবস্থায় পড়তে না হয়৷ ওকে বাঁচতে দিও বাবা। এই বলে সোহান উঠে গিয়ে ঈশিতার সামনে গেল৷ বলল,
-নিজের পথ নিজেকেই দেখতে হবে রে বোন! আমি ভাবতেও পারিনি একদিন এভাবে আমাকে আম্মু আব্বুকে ছেড়ে যেতে হবে৷ উনার এতো নিচু মানসিকতার তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি৷ শোন,কোনো দিন ওই টাকা ওয়ালাকে বিয়ে করিস না৷ কোনো দিনও না। পাগল হয়ে যাবি বলে দিলাম। গোলাম বানিয়ে রাখবে। যেমনটা তোর ভাবির সাথে করেছে৷ টাকার চিন্তা করিস না তুই৷ যত টাকা লাগবে ভাইয়া দিব তোকে। তোর বিয়ের জন্যে আমি আগ থেকেই টাকা জমাচ্ছিলাম। চিন্তা করিস না। এগিয়ে যাস। আর হ্যাঁ যৌতুককে সর্বোচ্চ ঘৃণা করবি। অবশ্যই করবি।
ঈশিতা বলল,
-ভাইয়া, আমাকেও নিয়ে যাও না৷ আমারো এখানে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমাদের ফ্যামিলিটাকে খুব ট্রিপিকাল মনে হয়৷ আগে যেমন বউ শাশুড়ীর লড়াই হতো ঠিক তেমন মনে হয়৷ এখানে আমার একদমই ভালো লাগে না। আমার তো এটা ভেবেই কান্না আসে যে যদি আমার সাথে এমন হয়? ভাবির মতোই কি মাথা হেট করে চলতে হবে?
-তুই থাক বোন৷ এদের দেখাশোনাও তো করতে হবে তাই না৷ তবে যদি তোর সাথেও এমন হয় আমাকে একটু জানাস৷ তোর ভাইয়া তোর পাশে আছে সব সময়৷
এই বলে সোহান মিতুর হাত ধরে লাগেজ টেনে বেরিয়ে গেল সেই বাসা থেকে৷ বলাবাহুল্য, সেই সময় আরফান সাহেব এবং মিস উর্মিলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো, তাদের চোখে হঠাৎই কিছু একটা হারানো বেদনা খেলা করছিল। মিতু কান্না করছে। তার কান্না মূল কারণ হচ্ছে সে ওই বাসাটাকে মিস করছে। মানুষ গুলোকেও। সোহান অনেক ট্রাই করছে ওর কান্না থামাতে। কিন্তু কোনো ভাবেই তা সম্ভব হয়নি। তারা আপাতত রিক্সায় চড়ছে৷ সোহান মিতুর হাত ধরল এবার। খুব শক্ত করে ধরল হাতটা৷ বলল,
-বাবা মায়ের জন্যে আমারও মন খারাপ লাগছে৷ কিন্তু কী করব! তারা তোমার উপর এক প্রকার টার্চার করছিল৷ আমি ভাবতেও পারিনি আমার বাবা মা এমন হবেন৷ মিতু কিছুই বলল না। সে কান্না করতেই থাকল। সোহান আবার বলল,
-চিন্তা করো না। দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আমরা আবার বাবা মায়ের কাছে যাবো৷ কেমন? মিতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেই যাচ্ছিল। থামছিল না৷ সোহান আবার বলল,
-অনার্স মাস্টার্স কম্পলিট করা একটা মেয়ে, তার উপর হওয়া কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করলো না৷ ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। মিতু ভেজা স্বরে বলল,
-সবাইকে প্রতিবাদ করতে হয় না৷ বাবা বলতেন কথাটা৷ জানো, উনার তোমার উপর কেমন জানি একটা বিশ্বাস ছিল৷ আমি যখন ফোন করে কান্না করে ওই কথা গুলো বলতাম, তখন তিনি বলতেন চিন্তা করিস না। সোহান বড় ভালো ছেলে৷ সে একটা না একটা কিছু ব্যবস্থা করেই ফেলবে।
-তুমি আমাকে অন্তত একটা বার বলতে!
-সাহস হয়নি৷ তুমি আবার কীভাবে নাও৷ কিন্তু আজ তুমি যা করলে, আমার এতদিনের সকল কষ্ট, গ্লানি একদম দূর হয়ে গেল। মাথা উঁচু করে বাঁচার একটা অবস্থান করে দিলে আমায়৷ আজ মনে হচ্ছে নিজের একটা অবস্থান আছে। আমার কেউ একজন আছে। আমার ছায়া আছে একজন। যে সব সময় আমার পাশে থাকবে। আমাকে সাপোর্ট করে যাবে৷ আমি সব সময় এমন একজনকেই চেয়েছিলাম। শুধু একটাই ব্যাপার আমায় পীড়া দিচ্ছে। ওই বাড়ি এবং মানুষ গুলোকে খুব মিস করছি আমি। খুব৷
মিতু থামল। তার কান্না থেমে গিয়েছে৷ সে সোহানের কাঁধে মাথা রাখল৷ তার মাঝে অদ্ভুত একটা আনন্দের অনুভূতি হলো৷ মানুষটাকে যেন আপন করে নিতে চাইছে এ মন। আজ,হঠাৎই তার এমন চাওয়া তীব্র হলো, এই চাওয়াতে এতোই বেগ যে সে সোহানে কাঁধে মাথা রেখেও পরম আনন্দবোধ করছিল৷ কোথাও বিন্দুমাত্র বাধা কিংবা দ্বিধ নেই। চাইলেও মানুষটার মনটাকে ছুঁয়ে ফেলা যাচ্ছে৷ তার প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসা বহু গুনে বেড়ে গেল। সোহান বলল,
-মিতু?
-হু?
-আমার মনে হয়না যে আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব আছে। আমার হঠাৎই মনে হচ্ছে তুমি আছো৷ আমার খুব কাছেই আছো৷ আমি তোমাকে ফিল করছি৷ তুমিও কি তাই করছো?
-এপাশ থেকে সিগ্ন্যাল না গেলে নিশ্চয়ই তোমার এমন কিছু মনে হতো না। হিহিহি৷
-মানে?
-শোনো! তোমায় একটা সিক্রেট বলি।
-বলো!
-আমি তোমায় প্রথম থেকেই ভালোবেসেছিলাম৷
তোমার প্রতি আমার একটা কিছু ফিলিং ছিল। কিন্তু ওই যৌতুকের ব্যাপারটা আমার মাঝে এমন ভাবে আঁটকে ছিল যে আমি তোমার কাছেই ঘেঁষতে পারছিলাম না৷ আবার তোমাকে খুব করেও চাইতাম৷ আমি দোটানায় পড়ে যেতাম। কিন্তু আজ তেমন কোনো দোটানা নেই৷ আমি আজ অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করছি সোহান! মিতুর গলাটা খানিকটা ধরে এল। নিয়নের আলোয় তার ছলছল করা চোখ দুটো দেখে আঁৎকে উঠল সোহান৷ মেয়েটার চোখের জল একদমই সহ্য হয় না তার৷ সে মিতু মুখটাকে এগিয়ে আনল। মিতুর কপালে চুমু খেল কেবল৷ বলল,
-আমি তো প্রথম দিনেই ফিদা হয়েছিলাম তোমার এর চাহনি দেখে। হাহাহা! তারা দুজনেই হেসে উঠল৷ এ কথা শুনে হয়তো রিক্সাওয়ালা মামাও মুচকি মুচকি হাসলেন৷ রিক্সাওয়ালা মামাদের প্রায়শই এমন বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়৷ যেমন আজ হলো৷ শহরের নিয়নের আলোয় এগিয়ে চলল তাদের রিক্সা। যাচ্ছে অজানা কোনো গন্তব্যের দিকে৷ যেখানে সুখ আছে৷ শান্তি আছে৷ যেখানে মনের কোনো দেয়াল নেই। কোনো ভেদ নেই। চাইলেই এক হৃদয় অন্য হৃদয়কে ছুঁয়ে দিতে পারে অনায়াসে। একদম কাছ থেকে পারে৷ অনুভব করা যায় তীব্র ভাবে৷