অনেকক্ষণ ধরে অধরা দাড়িঁয়ে আছে আশিকের অফিসের নিচে। আশিকের অফিস শেষ হবে পাঁচটায়। অধরা চারটা থেকেই দাড়িয়ে আছে। পাঁচটা, ছয়টা, সাড়ে ছয়টার দিকে আশিক অফিস থেকে বের হয়। অধরাকে দেখে খুব বিরক্তিকর একটা লুক নেয়। খুব কষ্ট পায় অধরা, খুব খারাপ লাগা কাজ করে ওর মাঝে। তবুও সেই খারাপ লাগাটা আশিককে বুঝতে না দিয়ে অধরা বলল;
— আশিক কিছু কথা বালার জন্য আমি এখানে আসছি। আশিক খুব তাড়াহুড় করল,
— আশিক বাবা একটা ছেলে পছন্দ করেছে, আর কাল নাকি সেই ছেলেটার পরিবার আমাকে দেখতে আসবে।
আশিক তুমি প্লিজ কিছু একটা করো। আশিক তখন কথাটা শুনে বলল;
— আমি কি করব পাত্র দেখতে আসবে, এতে আমার কি করার আছে, দেখতে আসলে আসবে।
আশিকের কথাটা শুনে অধরা অনেকটা অবাক হয়ে যায়। আশিককে যেন খুব অচেনা মনে হচ্ছিল অধরার। যাকে অধরা পাগলের মতো ভালোবাসে। যেই ছেলেটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তার মুখে এমন কথা শুনবে অধরা তা ভাবতে পারিনি। অধরা তখন কান্না করতে করতে বলে;
— আশিক তুমি কি আমার আশিক, এই আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক। এই কাল যদি পাত্র পক্ষ এসে আমাকে পছন্দ করে নেয়। অথবা যদি আমাকে দেখতে এসেই যদি ওদের পছন্দ হয়। আর যদি এইনগেসমেন্টটাও করে ফেলে তখন কি হবে। আশিক তখন কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল;
— তা আমাকে তুমি কি করতে বলছ। এই পরিস্থিতিতে তোমাকে আমি বিয়ে করে নেই। দেখ এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি ছয় মাস ধরে চাকরিটা পেয়েছি। আমাকে এখন নিজের ক্যারিয়ারটা গোছাতে হবে। যার জন্য আমাকে অনেকটা সময় নিতে হবে। সো এই মূহুর্তে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। আচ্ছা যাই হোক আমি খুব ট্রায়াড বাসায় ফিরতে হবে। আচ্ছা তোমাকে কি গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দিব। অধরা তখন বলল;
— থাক তার আর দরকার নেই, গাড়ি চড়ার অভ্যাসটা তো এখনো হয়নি। আর তাছাড়া আমি একাই চলে যেতে পারব। আমি সিএনজি করে চলে যাচ্ছি।
ছয় মাসের ব্যবধানে অশিক এতোটা পাল্টে যাবে অধরা কখনো ভাবতেও পারিনি। পাঁচটা বছরের ভালোবাসা, অনেক বেশিই ভালোবাসে অধরা আশিককে। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে শুধু সিএনজি ভাড়াটাই পেত অধরা। কিন্তু অধরা সিএনজি করে যেত না। টাকা বাঁচানোর জন্য অধরা বাসে করে ইউনিভার্সিটিতে যেত। বাকি টাকাটা অধরা আশিকের জন্য জমাত। আশিকের বাবা নেই, ইনকাম সোর্স নেই। দুদিন পর পরই আশিকের প্রবলেম হয়। আশিক তা অধরাকে বলতো না। কিন্তু অধরা তা বুঝতে পারত। নিজের জমানো টাকা, নিজের যতটুকু সামর্থ্য দিয়ে অধরা আশিকের সমস্যাগুলো সলভ করত। বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া টিফিনটা অধরা কখনো একা খেত না। আশিককে না খাইয়ে দিতে পারলে অধরার পেট ভরতো না। বাসায় যখন ভালো কিছু রান্না হতো, অধরা লুকিয়ে লুকিয়ে বাটিতে করে আশিকের জন্য নিয়ে যেত। মেসে থাকে আশিক, ভালো কিছু খেতে পারে না। অধরা তা বুঝতো, অধরার কষ্টও হতো, অধরাও শান্তি পেত না। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে অধরা আশিকের জন্য খাবার নিয়ে যেত।
আশিকের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ও যখন ওর প্রথম ইন্টারভিউ ফেস করে। নিজের জমানো টাকা থেকে অধরা আশিকের জন্য শার্ট কেনে। আশিকের ড্রেস গুলো কিনে দেয়। সুন্দর করে সাজিয়ে অধরা আশিককে ইন্টারভিউ দিতে পাঠায়। অফিসের নিচে বসে থাকে অধরা। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে বার বার প্রার্থনা করতে থাকে। যেন আশিকের ইন্টারভিউটা ভালো হয়। ওর যেন চাকরিটা হয় । এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, আড়াই ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পর। আশিক ইন্টারভিউ শেষ করে বের হয়ে আসে। আসিক অফিস থেকে বের হতেই অধরা দৌড়ে আশিকের কাছে গিয়ে খুব অবাক হয়ে জানতে চায়;
— তোমার ইন্টারভিউটা কেমন হয়েছে? আশিক তখন একটু হাসি দিয়ে বলে;
— খুব ভালো হয়েছে।
কথাটা শুনে অধরা তখন অনেকটা শান্তি পায়। অনেক ভালো লাগা কাজ করে ওর মাঝে। অধরা তখন আশিকের হাতটা ধরে বলে;
—যেহেতু একটা ভালো ইন্টারভিউ দিয়েছ,সো একটা ট্রিট তো তুমি পাওই তাই না।
অধরা নিজে গিয়ে ট্রিট দেয়। অধরা পাঁচ বছরের সম্পর্কে নিজেকে যতটা না ভেবেছে। কিন্তু আশিকের জন্য ভেবেছে প্রতিটা মূহুর্ত। আশিকের সাথে জড়িয়েছে নিজের সব স্বপ্ন। অধরা ভুলে গিয়েছিল নিজের ক্যারিয়ার। ভুলে গিয়েছিল নিজেকে। অধরা জীবনের প্রতিটা মূহুর্তে চেয়েছিল আশিক ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। কিন্তু আজ সেই মানুষটাই ওকে ফিরেয়ে দিল। পাঁচ বছরের ভালোবাসা মিথ্যে করে দিল এক নিমেষেই। অধরা বাসায় ফিরে আসে। অধরা বাসায় ফিরতেই ওর বাবা জিজ্ঞেস করে;
— কিরে মা কোথায় গিয়েছিলি, আর তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন।
— বাবা আমি একটু আমার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম।
— ওহ আচ্ছা তা যা ফ্রেস হয়ে নে। অধরা তখন বলল;
— বাবা একটা প্রশ্ন করি?
— হ্যাঁ মা কর,
— আচ্ছা বাবা, তোমার মেয়ে যদি রাজি হয় তুমি খুশি হবে।
— প্রতিটা বাবারই স্বপ্ন থাকে মেয়েটার বিয়ে দিবে, ভালো একটা পরিবারে। আমিও চাই তোর বিয়েটা হোক। কয়দিন পৃথিবীতে থাকি তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই। অধরা তখন চোখে জল নিয়ে বলল;
— ঠিক আছে বাবা তুমি পাত্র পক্ষকে আসতে বল।
অধরা দৌড়ে ওর রুমে চলে যায়, রুমে ঢুকেই অধরা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। বার বার আশিকের কথা মনে হতে থাকে। অধরা কান্না থামিয়ে আশিকের নাম্বারে কল দিতে থাকে। কিন্তু আশিক ফোন ধরে না। টেক্সট দেয় রিপলাই আসে না। তবুও অধরা পাগলের মতো বার বার কল দিতে থাকে। একটা সময় আশিক ফোনটা ধরে। আশিক ফোনটা রিসিভ করতেই অধরা বলতে থাকে;
— আশিক প্লিজ আমার কথা গুলো শোন, আশিক আই নিড ইউ। আশিক আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমার ক্যারিয়ার চাই না। সারাজীবন তোমাকে ভালো রাখার জন্য আমি ভালোবাসতে চাই। সারাজীবনের জন্য আমি তোমাকে চাই।
আশিক তখন আমার দ্বারা সম্ভব না কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দেয়। অধরা সারাটা রাত কান্না করতে থাকে। সকাল হয়ে যায়, ভোরের আলো অধরার কাঁদো মুখটাকে স্পর্শ করে। অধরা সারাটা রাত একটা মূহুর্তের জন্যও চোখটা বোজেনি। শুধু কান্নাই করেছে। অধরার বেস্ট ফ্রেন্ড তুলি আর আঁখি ব্যাপারটা জানতো। ওরা এসে অধরাকে বোঝাতে থাকে;
— দেখ জীবনে এমনটা হয়, সবাই তো ভালোবেসে তার মনের মানুষকে পায় না। ভুলে যা আশিককে। একটু পর তোকে দেখতে আসবে চল তোকে সাজিয়ে দেই। তুলি ও আঁখি দুজনে মিলে অধরাকে সাজিয়ে দেয়।
— বাহ আমাদের অধরাকে তো একদম পরীর মতো লাগছে, পাত্র তো ওর থেকে চোখ ফেরাতেই পারবে না, কি বলিস আঁখি।
— একদম দোলাভাই তো একদম পাগল হয়ে যাবে। কথাটা বলেই আঁখি হেসে দেয়। অধরা কোন কথাই বলছে না। কারণ ওর পক্ষে যে এটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টের।
— আচ্ছা তুলি চল আমরা ওদিকটা সামলাই, এই অধরা আমরা একটু আসছি। আর হ্যাঁ একদম কন্না করবি না। এখন থেকে ভাববি তোর জীবনে আশিক বলে কেউ ছিল না।
তুলি আর আঁখি রুম থেকে বের হয়ে যায়। অধরার চোখটা আবার জলে টলমল করতে থাকে। অধরা তখন ওর চোখের জল মুছে শেষ বারের জন্য আশিকের সাথে কথা বলার জন্য ওর নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু অধরা আশিকের নাম্বার বন্ধ পায়। অধরা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপচাপ রুমের মধ্যে বসে থাকে। একটু পর আঁখি আর তুলি আধরার কাছে এসে বলে;
— এই অধরা পাত্র পক্ষ চলে এসেছে।
কথাটা শুনেই অধরা চমকে উঠল। ওরা অধরাকে নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে গেল। অধরাকে বসিয়ে দিয়ে ওরা এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আর অধরা নিচের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। তখন পাত্রের মা বলে উঠল;
— আমার তো আগে থেকেই মেয়ে পছন্দ, আমি আর নতুন করে দেখতে চাই না। আমার মনে হয় যে আমরা আংটি বদলটা সেরে ফেলি। আংটি খোলা হচ্ছে অধরাকে পড়ানো হবে বলে। অধরা তখন মনে মনে ভাবতে থাকে;
— আরেক জনের মনের সাথে বিয়ে তো আমার অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। নতুন করে অপরিচিত মানুষটা আমাকে আর কি বিয়ে করবে।
একটা সেকেন্ড এর জন্যেও অধরা সেই মানুষটার দিকে তাকাইনি। শুধু ওর বাবার দিকে একটাবার তাকিয়েছিল। দেখল ওর বাবার মুখে হাসি। অধরা হাতটা বাড়িয়ে দিল। আংটি পড়ানো হল। ঠিক তখনই পরিচিত একটা কন্ঠ অধরার কানের পাশে এসে ফিস ফিস করে বলে গেল;
— পছন্দ হয়েছে, আংটিটা কিন্তু প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে কেনা।
অধরা তখন কথাটা শুনে চমকে উঠল, আলতো করে মাথাটা তুলে দেখে আশিক। অধরা তখন অবাক হয়ে ওর বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা হাসছে। আশিক তখন বলল;
— আংকেল কিছু মনে না করলে অধরার সাথে একটু পার্সোনালি কথা বলতে পারি।
অধরার তখন আর বুঝতে বাকি থাকল না যে এগুলো পুরোটাই প্ল্যান ছিল। আশিকের মা ছিল সামনে। অধরা খুব ভদ্র মেয়ের মতো মাথায় কাপর দিয়ে, খুব ভদ্র ভাবে আস্তে আস্তে আশিকের সাথে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। অধরা তখন মাথার কাপরটা ফেলে দিয়েই আশিকের পাঞ্জাবির কলারটা চেপে ধরে বলে;
— হারামজাদা এসবের মানে কি? আশিক তখন হাসি দিয়ে বলে;
— দেখ ভালোবাসি পাঁচ বছর ধরে, বিয়েটা হুট করে করব। এটাতো আর হবে না। একটু সারপ্রাইজ ছাড়া কি বিয়ে হয় বল। তাহলে যখন বাচ্চারা বড় হবে তখন ওদের কি গল্প শোনাবে হুহ। এটা শোনাবা যে তোমার বাপেরে সিএনজিতে না উইঠা আমি শার্ট কিনে দিছি। তাহলে বাচ্চারা তো আমারে সারাজীবন পচাবে তাই না। তাই আর কি একটু মজা করলাম আর কি হি হি হি হি হি হি হি। অধরার চোখে তখন পানি চলে আসে। অধরা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল;
— কুত্তা, হারামি, বান্দর, হনুমান, খাটাস আমাকে কাঁদিয়ে এখন হাসা হচ্ছে। আজ আমি তোকে মেরেই ফেলবো। কথাটা বলেই অধরা আশিকের বুকে ঢিসুম ঢিসুম দিতে থাকে।
— আরে আরে করো কি, এতো জোরে ঘুষি মারলে তো আমি সত্যিই সত্যিই পটল তুলবো। আর তোমাকে বিয়ে না করেই হতে হবে বিধবা। আর তাছাড়া এখন যদি কেউ দেখে ফেলে যে তুমি আমাকে মারতেছ। তাহলে কি ভাববে বলতো। ভাববে কি মেয়েরে বাবা বিয়ের আগেই জমাই পেটাচ্ছে। অধরা তখন আশিককে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কান্না করে দেয়। কান্না করতে করতেই বলতে থাকে;
— আই লাভ ইউ, থ্যাংক ইউ, আই নিড ইউ, আই লাভ ইউ। আশিক তখন অধরার চোখের জল মুছে দিয়ে ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বলে।
— এই পাগলী আই এম সরি, খুব কাঁদিয়েছি তাই না। খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না। বিশ্বাস করো আজকের পর থেকে তোমার চোখে কখনো জল আসতে দিব না। ভালোবাসি, ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। কথাটা বলেই আশিক অধরাকে ওর বুকে জড়িয়ে নেয়। আর এরি সাথে পূর্ণতা পায় অধরার ভালোবাসা।