নয় নাম্বার বিপদ সংকেত

নয় নাম্বার বিপদ সংকেত

পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না ময়ূরাক্ষী বের হওয়ার পর পরই যুবক শ্রেণীর বিরাট অংশ হলুদ পাঞ্জাবী পরে রাস্তায় নেমে গেল৷ আমিও মনের আনন্দে একের পর এক হিমু বাজারে ছাড়তে লাগলাম৷ পাশ বইয়ের খাতায় টাকা জমা হতে লাগল৷ শুরুতে হিমুকে আমি মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করিনি৷ তখন আমার প্রিয় চরিত্র মিসির আলি৷ আমি লিখছি মিসির আলি৷ এই ভদ্রলোকের লজিকে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ৷ এর মধ্যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে৷

বন্ধু-বান্ধব, ব্যাংক এবং প্রকাশকদের কাছ থেকে ধার করে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছি৷ পনেরশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট ফ্ল্যাট৷ তাতে কী, দুটো বেডরুম আছে৷ একটা বারান্দা আছে৷ বারান্দায় বসলে সুন্দর কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাই না৷ জুতার দোকান দেখতে পাই৷ ছয়তলা থেকে জুতার দোকান দেখা খারাপ কিছু না৷ বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আমি জুতার দোকান দেখি এবং পরের লেখাটা কী হবে ভাবি৷ আমার তিন মেয়ে তখন সামান্য বড় হয়েছে৷ বড় মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে, মেজোটি পড়ে ক্লাস ফোরে৷ ভোরবেলা স্কুলের পোশাক পরে তারা কিছুক্ষণ ধবল রঙের ডিপফ্রিজের সামনে দাঁড়ায়৷

কারণ তাদের বাবা রাতে যা লিখেছে তা ডিপফ্রিজের উপর সাজানো থাকে৷ আমার এই দুই কন্যা বাবার লেখার সর্বশেষ অংশ না পড়ে স্কুলে যাবে না৷ আমার লেখক জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে পড়ে না৷ আমার এই দুই কন্যার কোনো একজন, খুব সম্ভব বড়জন আমাকে একদিন বলল, বাবা ময়ূরাক্ষীর মতো আরেকটা বই লেখ৷ হিমুর বই৷ হিমুকে নিয়ে কন্যার আগ্রহে লিখে শেষ করলাম দরজার ওপাশে৷ বই প্রকাশিত হলো৷ আমি পড়লাম মহাবিপদে৷ হাইকোর্টে বিচারকদের সমিতি আছে৷ সমিতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো, এই বইটি লিখে আমি মহা অন্যায় করেছি৷ মহান বিচারকদের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছি৷ কারণ আমি লিখেছি জজ সাহেবরা ঘুষ খান৷

উপন্যাসে ঘটনাটা এ রকম – হিমুর মাতুল বংশ পিশাচ শ্রেণীর৷ তারা হেন দুষ্কর্ম নাই যা করে না৷ তাদের ধারণা যেকোনো কাজ টাকা দিয়ে করানো সম্ভব৷ তাদেরই একজন জজ সাহেবকে ঘুষ দিয়ে এই কাজটা করাতে চাচ্ছে৷ জজ সাহেবরা ঘুষ খান – এটি হিমুর ধান্ধাবাজ মামার কথা৷ বইতে কিভাবে এসেছে দেখা যাক৷ মামা গোসল করে জায়নামাজে বসে গেলেন৷ দীর্ঘ সময় লাগল নামাজ শেষ করতে৷ তার চেহারা হয়েছে সুফি সাধকের মতো৷ ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি৷ মোনাজাত করার সময় টপটপ করে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল৷ আমি অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখলাম৷ তারপর বল, কী ব্যাপার? একজন লোক জেলখানায় আছে মামা৷ ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার, দেখা করার কায়দা পাচ্ছি না৷ দরখাস্ত করেছি, লাভ হয়নি৷ খুনের আসামি? তিনশ বারো ধারা? কোন ধারা তা জানি না, তবে খুনের আসামি৷ এটা কোনো ব্যাপারই না৷ টাকা খাওয়াতে হবে৷ এই দেশে এমন কোনো জিনিস নেই যা টাকায় হয় না৷ টাকা তো মামা আমার নেই৷

টাকার চিন্তা তোকে করতে বলছি নাকি? আমরা আছি কী জন্য? মরে তো যাই নাই৷ টাকা সঙ্গে নিয়ে আসছি৷ দরকার হলে জমি বেঁচে দেব৷ খুনের মামলাটা কী রকম বল শুনি৷ আসামি ছাড়ায়ে আনতে হবে৷ তুমি পারবে না মামা৷ তোমার ক্ষমতার বাইরে৷ আগে বল, তারপর বুঝব পারব কী পারব না৷ টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না৷ এক লাখ টাকা থাকলে দুটো খুন করা যায়৷ প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার৷ পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে৷ আমি মোবারক হোসেন সাহেবের ব্যাপারটা বললাম৷ মামা গালে হাত দিযে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনলেন৷ সব শুনে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বললেন, পুলিশের সাজানো মামলা, পেছনে আছে বড় খুঁটি৷ কিছু করা যাবে না৷ ট্রাইব্যুনাল করলে কোনো আশা নাই, সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে৷ জজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে৷ আগে জজ সাহেবরা টাকা খেত না৷ এখন খায়৷ অনেক জজ দেখেছি কাতলা মাছের মতো হাঁ করে থাকে৷ কেইস সিভিল কোর্টে উঠলে আমারে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি৷

মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই৷ সব সময় শুনেছি মামলা লোয়ার কোর্ট থেকে হাইকোর্টে যায়, তারপর সুপ্রিম কোর্টে৷ আমার বেলায় সরাসরি হাইকোর্ট থেকে তলব৷ শুধু আমি একা আসামি তা কিন্তু না৷ আমাকে নিয়ে বিচারকরা মামলা করেছেন এই বিষয়টি যেসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তারাও আসামি৷ তাতে আমার সুবিধা হলো, পত্রিকার সম্পাদকরা বড় বড় ব্যারিস্টার দিলেন৷ এই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন এবং ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের নাম মনে পড়ছে৷

পত্রিকার সম্পাদকরা উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইলেন এবং পার পেয়ে গেলেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল তার অফিসে আমাকে ডেকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন৷ তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং বিতর্কিত বইটি বাজার থেকে উঠিয়ে নিলে আমার আর কোনো ঝামেলা হবে না৷ আমি বললাম, ভুল করলেই ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন আসে৷ আমি ভুল করিনি৷ উপন্যাসের একটি দুষ্ট চরিত্র কী বলছে তার দায়ভার লেখকের না৷ তারপরেও যদি দায়ভার আমার থাকে তাহলে আমি জজ সাহেবরা ঘুষ খান এই মন্তব্য থেকে সরে আসব না৷ সব জজ সাহেবের কথা এখানে বলা হয়নি৷ জজ সাহেবরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি৷ মানুষের সাধারণ ত্রুটি তাদের মধ্যেও থাকবে৷ একজন লেখক হিসেবে আমি তা লিখব৷ আমাদের সংবিধান মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে৷

অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন, আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন৷ আমি বললাম, কী আর করা৷ না হয় একটু বিপদে পড়লাম৷ মামলা শুরু হলো৷ আমি হাইকোর্টে যাই৷ সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা৷ তারা ভয়ে অস্থির, এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ মামলার এক পর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন, তিনি বিব্রত৷ মামলায় থাকবেন না৷ কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো৷

সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন তিনি বিব্রত৷ পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল, বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন৷ আমার খুব ইচ্ছা করে মামলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে৷ মামলায় আমি যদি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে জজ সাহেবরা সাধারণ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে না৷ আর যদি হেরে জেলে যাই ততেও ক্ষতি নেই৷ অতীতে এই পৃথিবীতে লেখার মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷ আমি না হয় কিছুদিন জেলে থাকলাম৷ আমাকে জেলখানার মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে না৷ একুশে পদক পাওয়ার কারণে ডিভিশন দেওয়া হবে৷ বিছানায় ঘুমাব৷ ভাগ্য ভালো হলে মাথার উপর ফ্যান ঘুরবে৷ ফ্যান না ঘুরলেও ক্ষতি নেই, চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষী নদীকে জেলের ভেতর নিয়ে আসা কঠিন কোনো কাজ না৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত