অফিস থেকে বের হয়ে দেখি ৫টা বেজে গেছে। আশে পাশে তেমন রিকশাও দেখছি না। এখন সময় খেয়াল করলাম একজন বয়স্ক রিকশাওয়ালা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমাকে দেখে হাসি মুখে বললো,
-স্যার, কোথায় যাবেন?
আমি রিকশাওয়ালাকে ভালো করে এক নজর দেখে মনে মনে ভাবলাম, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে আর এই বয়স্ক চাচার রিকশায় যদি উঠি তাহলে তো যেতে আরো দেরি হয়ে যাবে। আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম,
— চাচা,আপনি চলে যান।আমি অন্য রিকশায় যাবো এইবার রিকশাওয়ালা চাচা আমার দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে বললো,
-স্যার, আমি বয়স্ক লোক দেখে এটা ভাবেন না যে আমি আস্তে আস্তে রিকশা চালাবো। আমি সঠিক সময়ে আপনাকে পৌঁছে দিবো। আর আমি আপনার থেকে ৫টাকা বেশি নিবো না বরং যত ভাড়া আমাকে তার থেকে ৫ টাকা কম দিয়েন কথাটা শুনে নিজের চিন্তা ভাবনার জন্য খুব খারাপ লাগছিলো। তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ রিকশায় উঠে বললাম,
— বাইপাস মোড়ের মাছের বাজারে নিয়ে যান রিকশাতে উঠার কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী পুষ্পিতার ফোন। ফোনটা রিসিভ করতেই পুষ্পিতা বলতে লাগলো,
~ তুমি এখনো মাছের বাজারে যাও নি? আমি বললাম,
— এইতো যাচ্ছি। পুষ্পিতা বললো,
~ শুনো, বড় দেখে বোয়াল মাছ কিনবে। একদম কৃপণতা করবে না। আমার মেয়ে খেতে চেয়েছে… আমি মুচকি হেসে বললাম,
— ঠিক আছে বড় দেখেই বোয়াল মাছ কিনে আনবো…
প্রিয়তা আমার একমাত্র মেয়ে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। ক্লাসে ওর টিচার বলেছে বোয়াল মাছ অনেক বড় হয় আর খেতেও নাকি খুব মজা তাই প্রিয়তা পাগল হয়েছে বোয়াল মাছের তরকারী দিয়ে ভাত খাবে…
আমি এইসব কথা ভাবছি হঠাৎ রিকশাওয়ালা চাচা বললো,
– স্যার কি বোয়াল মাছ কিনবেন? আমি মুচকি হেসে বললাম,
–জ্বি চাচা, মেয়ে বায়না করেছে বোয়াল মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খাবে। আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা চাচা বললো,
– স্যার, একটা কথা বললে কিছু মনে করবেন না তো? আমি বললাম,
— মনে করবো না কিছু।আপনি বলেন… রিকশাওয়ালা চাচা বললো,
– স্যার, বোয়াল মাছ রান্না করার নিয়ম আছে।
নিয়ম বাদে বোয়াল মাছ রান্না করলে খেয়ে মজা পাবেন না। বোয়াল মাছ রান্না করতে হয় জাম আলু( লাল লাল ছোট আলু গুলো)আর হালকা পাকা টমেটো দিয়ে। তরকারিতে হালকা একটু ঝোল বেশি দিতে হবে। আর তরকারি হয়ে যাবার ঠিক ৭-৮ মিনিট আগে আগে অল্প কয়েকটা ধনিয়া পাতা দিতে হবে। তারপর গরম গরম এই তরকারী দিয়ে ভাত খেলে তরকারী মজা লাগবে না। তরকারি খেতে হবে একটু ঠান্ডা হলে আমি রিকশাওয়ালা চাচার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম,
–আপনি এত কিছু জানেন কিভাবে? চাচা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন,
– স্যার, আমার ময়মনসিংহ চরপাড়া মোড়ে বড় হোটেল ছিলো। সবাই একনামে চিনতো সোহাগ গাজীর ভাতের হোটেল। আমার হোটেলে ৩ জন বাবুর্চি থাকার পরেও আমি নিজে রান্না করতাম কারণ কাস্টমাররা আমার রান্না করা তরকারি দিয়ে ভাত না খেলে তৃপ্তি পেতো না আমি তখন বললাম,
— চাচা, তাহলে আপনার এখন এই অবস্থা কেন? রিকশাওয়ালা চাচা বললো,
– স্যার, আমার ৩ ছেলে আছে। বড় ছেলে এস আই এর চাকরির জন্য আমার থেকে ১৮ লাখ টাকা নিলো। মেজো ছেলে কৃষি অধিদপ্তরে চাকরির জন্য ১৫ লাখ নিলো। ছোট ছেলে পড়াশোনা তেমন করে নি। সে দাবী করলো দুই ছেলেকে যেহেতু এত টাকা দিয়েছি তাকে যেন হোটেলটা দিয়ে দেই। আমিও খুশি মনে দিয়ে দিলাম। ভাবলাম কাজ থেকে বিশ্রাম নিয়ে ছেলেদের সংসারে সুখেই থাকবো কিন্তু এটা বুঝতে পারি নি সব দ্বায়িত্ব ছেলেদের দেওয়ার পর ওরা আমার আর আমার স্ত্রীর দ্বায়িত্ব নিবে না। বড় ছেলের কাছে গেলে বড় ছেলে বলে মেজো ছেলের কাছে যাও, মেজো ছেলের কাছে গেলে বলে ছোট ছেলের কাছে যাও। প্রতিদিন ছেলেদের কাছে অপমানিত হতে হতে একদিন স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এই শহরে পা দিলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যতদিন শক্তি আছে ততদিন না হয় সম্মানের সহিত বাঁচলাম। আর যেদিন শক্তি থাকবে না সেদিন যেন আল্লাহ তালা আমাকে আর আমার স্ত্রীকে একসাথেই উঠিয়ে নেয় চাচার কথা শুনে কি উত্তর দিবো বুঝতে পারছিলাম না। মাছের বাজারে চাচা যখন রিকশা থামালো তখন চাচাকে বললাম,
— চাচা চলেন, আপনি নিজে আমাকে বোয়াল মাছ পছন্দ করে দিবেন। চাচা আমতা আমতা করে বললো,
– আমি? আমি চাচার হাত ধরে বললাম,
— হে আপনি..
চাচাকে সাথে নিয়ে বোয়াল মাছ, জাম আলু, আধাপাকা টমেটো, ধনিয়া পাতা সব কিনলাম। তারপর চাচার রিকশায় উঠে বললাম। চলেন চাচা আপনার বাসায় যাবো। আপনি নিজের হাতে বোয়াল মাছ রান্না করে আমাকে খাওয়াবেন। চাচা আমার দিকে শুধু হা করে তাকিয়ে রইলো। আমি চাচাকে বললাম,
— চাচা এইবার চলেন তো…
চাচা আর চাচী খুব আয়োজন করে বোয়াল মাছের তরকারি রান্না করলো। আমি খেয়াল করছিলাম উনারা রান্না করছিলো আর উনাদের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছিলাম। রান্নার পর তরকারি ঠান্ডা হলে আমরা ৩ জন একসাথে খেতে বসি। জীবনে অনেকবার বোয়াল মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছি তবে আজকের পর এত স্বাদের তরকারি হয় নি। খাওয়া শেষে চাচা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-স্যার, আপনার মেয়ে তো বোয়াল মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলো। আমি মুচকি হেসে বললো,
— আমার মেয়ে খেতে পারে নি দেখে কি হয়েছে। আমি আমার বাবা মাকে তো খাওয়াতে পেরেছি আমি বাসায় ফিরেছি রাত ১০টার দিকে। পুষ্পিতা আমার খালি হাত দেখে রাগে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
~কেমন বাবা হয়েছো, মেয়েকে সামান্য বোয়াল মাছ খাওয়াতে পারো না পুষ্পিতার কথাগুলো আমার কানে ঢুকছিলো না। আমার চোখের সামনে শুধু রিকশাওয়ালা চাচার কান্নাভেজা চোখগুলো আর তার তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার দৃশ্যটাই ভাসছিলো। পুষ্পিতা যখন আমার হাত ধরে বললো,
~পিয়াস, তুমি আমার কথা শুনতে পাও নি? পাথরের মত দাঁড়িয়ে থেকে কি ভাবছো? আমি মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে বললাম,
— এই নাও বোয়াল মাছের তরকারি…