ক্যাপ

ক্যাপ

রোজ শাড়ি পড়া মেয়েটা যখন মাথায় হিপহপ ক্যাপ পড়ে! আমি তখন অবাক না হয়ে কী পারি? বললাম, “ অনিমা, মাথায় হিপহপ ক্যাপ লাগিয়েছো কেনো? শাড়ির সাথে কেউ হিপহপ ক্যাপ পড়ে? কেমন দেখা যাচ্ছে? ” সে মাথা নাড়ালো, “ কেনো? শাড়ি পড়ে হিপহপ ক্যাপ লাগালে কী আমি ছেলে হয়ে যাব? ” সরল সোজা দেখা গেলেও, মেয়েটা কথার বাঁক ভালোই জানে।

“ না, তাহলে শাড়িকে অবজ্ঞা করা হয় আরকি! ”

“ ধুর, তুমি কিচ্ছু বুঝো না। চলো তো। ” আমিও আর কিছু বললাম না।

“ হাত ধরো ”

“ কেনো? আমি কোনো ছেলের হাত ধরে হাঁটি না। ”

সে চোখ বড় বড় করে বললো, “ আজব! আমি জানি তুমি এটাই বলবে! এখানে ছেলে হওয়ার কী আছে শুনি? আজকাল ছেলেদের কাপড় আর মেয়েদের কাপড়ের মধ্যে কোনো ফাঁড়াক আছে নাকি? আর এটা তো সাধারণ একটা ক্যাপ! ”

“ চলো, সময় বেশি নেই! ”

ট্রেনে করে সিলেট যাচ্ছি। ওখানে একটা মেলা আছে। তারচেয়ে বড় কথা। সেখানে অনিমার বাড়ি। কদিন বেড়াবো। মোটামুটি ভীড়ের মাঝেই উঠতে হলো। জানালার পাশের সিটটায় ওকে বললাম বসতে। “ অনেক দিন পর বাড়িতে যাচ্ছি, আমার কেমন যে লাগছে। তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না ”

“ বাড়িতে গেলে সবার ভালোই লাগে। ”

“ এভাবে কথা বলছো কেনো? কথায় কোনো রসকষ নেই! ”

“ কীভাবে বললাম? আচ্ছা আমি দুঃখিত। ” লোকজন ওর দিকে তাকাচ্ছে না। তাকাচ্ছে ওর ক্যাপের দিকে! অস্বস্তি লাগছে আমার!

“ তোমার কী আমার ক্যাপ নিয়ে সমস্যা? ” আমি আমার রাগ আবেগ ভালোবাসা, কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারি না।

“ হ্যাঁ, তোমার ক্যাপ নিয়েই সমস্যা। খুলবে কী না বলো? ” অনিমা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, “ যতো যাই বলো, আমি ক্যাপ খুলবো না। ”

“ মানুষ তোমাকে পাগলার পাগলী ভাবছে। ”

“ ভাবুক। ” উঠে দাঁড়ালাম। পিছনের সিটে বসে যাবো। লোকজন না বুঝুক, ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে।

“ কী ব্যাপার? পিছনে গেলে কেনো? ”

“ আমি পিছনে গেলে কী ট্রেনও পিছন দিকে যাবে? যাবে না তো? সিলেটই যাবে। ”

আঁচল টেনে অনিমা বললো, “ আরেহ আমি মাথা রাখবো কোথায় তাহলে? ট্রেনের ঝাঁকুনিতে আমি ঘুমাতে পারি না জানো না? ”

“ ঘুমাতে পারবে দেখো। ”

রাগ দেখালো কিনা বুঝলাম না। দাঁত কামড়ে বসে পড়লো। আমি পিছনের সিটে বসলাম। ভেবেছিলাম দূরে বসলে বুঝি আমার কথা শুনবে। কিন্তু না, সে ক্যাপ খুলবেই না বুঝা যাচ্ছে! শাড়ির মাথায় ক্যাপ যেই কথা। পেট্রোল দিয়ে সোপ বানানো সেই কথা! কিছুক্ষণ পর ও ঘুমিয়ে গেলো নাকি বুঝলাম না। কোনো শব্দ করছে না! আমার কাঁধে মাথা না রেখেই ঘুমিয়ে গেলো? কিছুক্ষণ ওর সাথে কথা না বললে যে আমার অশান্তি লাগে। ডাক দিলাম, অনিমা।

অনিমা কিছু বলছে না। আবারো বললাম, ঘুমিয়ে গেলে নাকি? ” তবুও কিছু বলছে না! কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে বললাম, তোমার পাশে আসি? ঘুমিয়েই গেছে মনে হয়। পাশে গেলাম। সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে। দেখতে অপরূপ লাগছে। খারাপও লাগছে! সে ঘুমিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু হাত দুটো মাথার ক্যাপে! মাথায় ক্যাপ পরিহিত অনিমাকে আমার লাগছে না! আমার অনিমা অন্যরকম! আস্তে করে ক্যাপটা মাথা থেকে সরাতে চাইলাম আর সে ফট করে জেগে গেলো! চিৎকার দিয়ে উঠলো, চোর চোর চোর। আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম, “ চোর না, চোর না। আমি আমি আমি। ”

“ ওহ তুমি? এখানে আসলে কখন? চোরের মতো আমার ক্যাপ টানছো কেনো? ”

“ ক্যাপে তোমাকে ছেলে ছেলে লাগছে! ”

“ এক দিনের জন্য লাগুক ছেলে ছেলে! ”

রাগ হচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছি না। অনিমা আবার বললো, “ ক্ষুধা লেগেছে খুব। ” আমি বললাম, “ ব্যাগে রুটি আছে, কলা আছে। খেয়ে নাও। ”

“ তো খাইয়ে দাও? ”

“ কীহ? ”

“ এরকমভাবে কীহ করে উঠলে কেনো? আমাকে খাইয়ে দিলে তোমার অপরাধ হবে না পাপ? ”

“ এই ট্রেনে? মানুষজন কী বলবে? আমরা আহ্লাদী! ”

“ আরে ভাই, তোর বৌকে তুই তুলে খাওয়াবি, এতে কে কী ভাববে? ”

” ভাই! ” যাহোক, রুটি আর কলা বের করে বললাম, “ মাথা থেকে ক্যাপ নামাও! ” অনিমা ওদিকে মুখ করে বললো, “ তোমার খাইয়ে দেয়া লাগবে না! ”

অদ্ভুত! যতো যাই হোক, সে ক্যাপ খুলবে না! কতোদিন পর নিজের বাড়ি যাচ্ছে! আর সেখানে যাচ্ছে শাড়ির উপরে মাথায় হিপহপ ক্যাপ দিয়ে! ভোরে পৌঁছালাম। শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকলে শ্বশুরবাড়িতে যত্নের অভাব হয় না। কিন্তু কচু পাতার শ্বাশুড়ির মেয়েটা মাথা থেকে ক্যাপ নামাচ্ছে না! রাতে ঘুমাচ্ছে না জেগে আছে বুঝতে পারি না। মাথায় হাত সবসময় থাকবেই! পুরো ছয় দিন এভাবে চলেই গেলো! জীবনে অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছি। অনিমার মাথার ক্যাপটাও ছেড়ে দিলাম। ধরে নিলাম হাত পা মুখের মতো ক্যাপও একটা শরীরের অংশ। ফোন নিয়ে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে শুরু করলাম। মহামান্য মহারাণী সোজা হয়ে গেলো। এক কাপ চা আনলো।

“ কি করছো? চা’টা খাও। ”

“ রাখো, একটু পর খাই। খবরেরকাগজ পড়ছি। ”

“ রাখো তো। শুনো, একটা কথা বললে রাগ করবে? ”

“ নাহ করবো না। ”

“ আমি নাহ নিজের মাথার চুল নিজেই ফ্যাশন করে কাটতে গিয়ে কপালের উপর থেকে সব চুল কেটে ফেলেছি! আমার কী দোষ? মেশিন ধরতেই ফঁ ফঁ করে সব কেটে গেছে! ”

এই বলে মাথা নিচু করে ক্যাপটা খুলে ফেললো! ঘটনা তো সত্যি! আমি এখন কী বলবো বুঝতে পারছি না। মনে মনে ভাবছি। ভালোবাসার একটু কমতি পড়লে, ভাত কাপড়ের কমতি পড়লে আর ফ্যাশন করার ইচ্ছে হতো না। এই কথা বললে আবার কথা বন্ধ করে দিতে পারে। আমার রাগটা আমার কাছেই রেখে বললাম, “ সমস্যা নেই। পরেরবার নিজে কাটতে যেয়ো না। অনেক ভালো ভালো পার্লার আছে। পার্লারে যাবে। ” অনিমা খুশি হওয়ার বদলে মন খারাপ করলো!

“ ওহ, তারমানে তোমার কিছুই যায় আসে না আমার চুল নিয়ে? এমনিতে তো খুব বলো, আমার চেয়ে আমার মাথার চুল তোমার বেশি ভালো লাগে! আর এখন পার্লারের যাওয়ার জন্য বলছো? ভালো লাগলো শুনে! ” আমি ভাবলাম এটা বললে ও খুশি হয়ে যাবে! কিন্তু মেয়েটার কণ্ঠ এতো করুণ হয় গেলো! আমার বুকে যেন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো! অনিমা মায়ের কাছে চলে গেলো! সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের ফোন!

“ কীরে, অনিমা কোথায়? ”

“ আছে পাশের ঘরে, ডেকে দেই? ”

“ আচ্ছা থাক, আর শোন, অহেতুক ওকে বকিস না। শুভার ছেলে রাতে নিজের এবং মামানির চুল কেটে ফেলেছে ফাইজলামু করে! তোকে জানতে দেয়নি আতিফকে বকবি বলে! ” আমি, “ নাহ বকবো কেনো? কিন্তু আতিফ দিনদিন বেশি শয়তান হয়ে যাচ্ছে! ”

“ এজন্যই বলেনি। মাথায় ক্যাপ দিয়ে রেখেছে! ”

আমি ফোন রেখে দিলাম। আমি কী বেশিই রাগি? আমাকে বললে কী হতো? আমার ছোট বোনের ছেলে আতিফ। আও আও থেকে কদিন হলো কথা বলা শিখেছে! আর এর মধ্যেই কতো পাজি হয়েছে সে। না দেখলে কেউ বুঝবে না! চা’টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। হাতে নিয়ে পাশের ঘরে গেলাম। অনিমা চুপ করে আছে। আমার উপস্থিতি টের না পাওয়ার ভান করলো। একের ভিতর সব। বাচ্চাদের বই পড়ায় মন দিলো! কাছে গিয়ে বসলাম।

“ অনিমা। ” আমার দিকে না তাকিয়ে বললো, “ হুম, কিছু লাগবে? ”

“ লাগবে তো। ”

“ কী? ”

“ দিতে পারবে? ” অনিমা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “ শুনুন, আমরা গরীব হতে পারি। তবে কোনো কিছু চাইলে অল্প হলেও দেবার অবস্থা আমাদের আছে! ”

“ তাহলে দরজাটা বন্ধ করে দাও। ” অনিমার মুখের ভৌগোলিক অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেলো! লম্বা করে বললো, “ কেনো? ” আমি আরেকটু কাছে গিয়ে বললো, “ দুজনে একসাথে চা খাবো। যদিও ঠান্ডা হয়ে গেছে! আর শুনো। ”

“ কী? ” আমি কিছু না বলে টেবিলে রাখা ক্যাপটা ওর মাথায় দিয়ে দিলাম।

“ বড় বড় কথাই তোমার পুঁজি, দরজাটা এখনো বন্ধ করার শক্তি তোমার নেই! ” অনিমা ভয়ে ভয়ে বললো, “ আম্মা পাশের রান্নাঘরে লেবু কাটছে আল্লাহ্! ”

“ তোহ? ”

“ তোহ কিছু না, আমি চা’টা গরম করে নিয়ে আসি! ”

বলে আমার বাহুডোর থেকে বেরিয়ে ছোট্ট একটা দৌড় দিলো! সঙ্গে মিষ্টি হাসিটা! হাত থেকে চা’টা নিচে পড়ে গেলো! মৃদু হাসলাম! চা আমার কাছেই, আর সে গেছে চা গরম করতে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত