কোনোরকম ট্যুর সেরে এলাম।যথারীতি ট্যুরের সাতদিন তারসাথে কন্ট্রাক্ট ছিল না।ফিরে এসে নক করলাম। দেবীর দেখা নেই। মাঝে মাঝে হু,হ্যা করে অফলাইনে চলে যায়। কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বললে দেখি আগ্রহ পায় না। বাংলাদেশ বনাম ইণ্ডিয়ার ওয়ানডে সিরিজ চলছে। ফোন করলাম,
-কি ব্যাপার? আপনি কই?
-ঘুমাই।
-আজ তো বাংলাদেশের খেলা আছে।
-জানি।
-দেখবেন না?
-ঘুমাব।সারারাত ঘুমাই নি।মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে।
ফোন কেটে দিল। তার ছোট ছোট পরিবর্তন গুলো চোখে পরেছিল অনায়সে। বই পড়ায় আগ্রহ নেই, আগের মত তর্ক করে না। একদিন জিজ্ঞেস করল,
-আমি কি দেখতে খারাপ?
-হঠাৎ এপ্রশ্ন কেন?
-এমনি।
-বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ তো আপনি নন।
-না চাইতেও অনেক কিছু ভাবতে হয়।
-খুলে বলবেন কি? কি হয়েছে?
-না থাক।
এভাবে এড়িয়ে যায়। যখনি জিজ্ঞেস করি উত্তর দেয় মন খারাপ। কথা বলতে ভালো লাগছে না। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম,
-কাউকে ভালো লাগে? কিছু সময় চুপ করে থেকে উত্তর দিল,
-হ্যা। প্রচণ্ড কষ্ট বুকে চেপে ধরে টাইপ করলাম,
-কনগ্রেচুলেশনস।
-খুশি হবার কিছু নেই।সে আমাকে ভালোবাসে না।
-সে কি জানে আপনি ভালোবাসেন?
-জানে। বলে, সাময়িক আবেগ।আমার বয়স কম তাই ভুল করছি।আবার কখনও বলে আমি তার টাইপ নয়।
কি লিখব ভেবে পাচ্ছিলাম না।আমি আমার প্রেমিকার ব্যর্থ প্রেমের গল্প শুনছি। রোজ যে মানুষটার ছবি দেখে ঘুমাতে যাই সে মানুষটার বুকের ভেতর অন্য কারো ছবি আঁকা। দিন গড়ায়। দুজনের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা নয়।সে নক করে,
-জানেন, ও বলেছে আমার বুদ্ধিমত্তা নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের মত।হি… হি…হি…
-হাসির কি হল?
-আরে, আপনি পাঁচ মিনিট ওর সাথে কথা বলে দেখুন স্রেফ প্রেমে পড়ে যাবেন।
-আমি গে নই। আবার হাসি।
-রোজ কথা হয়।
-হুম। পাঁচ-দশ মিনিট। ও বলে আমি ওর খুব ভালো বন্ধু। আপনিই বলুন কাউকে খুব ভালোবেসে কি তার শুধু বন্ধু হয়ে থাকা যায়?
কি উত্তর দিব! গত চার বছর যাবত এপ্রশ্ন মনের ভেতর ঘোরপাক খেয়েছে।তাকে প্রশ্ন করার সাহস হয় নি!
সে নক করে তার প্রেমিকের গল্প বলে। চাশমিশ, চেহারায় ভালোমানুষির ছাপ। পৃথিবীর কোনো আরজে তার মত স্মার্টলি কথা বলতে পারবে না।বলতে বলতে একসময় কেঁদে ফেলে।
-ও আমাকে ভালোবাসে না কেন?
-হয়ত অন্য কাউকে ভালোবাসে।
-বিশ্বাস করি না।ওর চিৎকার দ্বিগুণ হয়।
আমি এক প্রকার ভেঙে পড়লাম।এই মেয়ে পাগল।আমি যে রোজ ওর প্রেমিকের গল্প শুনে কষ্ট পাচ্ছি, ওর প্রতিটা কথা বুকের সেলে গিয়ে আঘাত করে মেয়েটা বুঝে না।নিজের আকুতি প্রকাশ করতে যা নয় তাই বলে।
আমার বন্ধুরা বলে,
-তুই ওর সাথে কন্ট্রাক্ট অফ করে দে। ওকে ভুলে যেতে এর চেয়ে ভালো অপশন নেই।
রোজ ঘুমাতে যাবার সময় প্রতিজ্ঞা করি কাল থেকে আর কথা বলব না।ভোরে উঠে ঘুম ঘুম চোখে মেসেজ করি,সুপ্রভাত। কি করে ওর সঙ্গ ছাড়ব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এর মাঝে এক সন্ধ্যায় টিউশন থেকে ফেরার সময় ফোনটা চুরি হয়ে যায়।সিদ্ধান্ত নেই, আর ফোন কিনব না। ফাইনাল ইয়ার লাস্ট সেমিস্টার চলছে।কোনোভাবেই রেজাল্ট খারাপ করা যাবে না। আমি ওকে ভুলে থাকতে ওর দেখানো পথই বেছে নিলাম।জিআর! দ্বিগুণ পড়াশোনা করি।যে করে হোক আমাকে চান্স পেতেই হবে। নয় বছর পর- রাহুল কাটিং চুল, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখে চশমা অথচ চোখদুটি ভীষণ চেনা। মাথায় আলতো করে হাত ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-নাম কি তোমার?
-চারু।
-চারুলতা?
-না।শুধুই চারু।
উত্তর দিল মাঝারি গড়নের একজন ভদ্রমহিলা। পরনে সাদাকালো ডোরা শাড়ি, সামনে লম্বা বেণী। কয়েকসেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করলাম, অ্যামেতিস! সে যেন আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারল,
-পরিচিত লাগছে আপনাকে।
-পরিচিত ছিলাম কখনও। কাউকে অ্যামেতিস। ভদ্রমহিলা প্রাণখুলে হাসল।কি অদ্ভুত! কল্পনাতে তাকে হাসলে যেমন লাগত হুবুহু ঠিক সেইরকম।
-ভালো আছেন?
-চলছে একরকম।
দুজনে কফিশপে বসলাম। কত শত ঘণ্টা দুজনে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি অথচ আজ কথা জমছিল না।মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিল, পথে কাকতালীয়ভাবে আমার সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম,
-বিয়ে করলেন কত বছর?
-যে বছর প্রেমে পড়ছিলাম।
-মেয়ের বাবা কী করেন?
-মেয়ের বাবাকে চিনেন, যার প্রেমে পড়ছিলাম বহু বছর আগে।
-বাহ! আপনি লাকি পারসন। সে মলিন হাসি হাসল,
-ভদ্রলোক মেয়ের বাবা কিন্তু এখন আর আমরা একসাথে নেই। মেয়ের জন্মের দু’বছর পর ডির্ভোস হয়ে গেছে।
-ওহ। অাই অ্যাম সরি।
-সরি হবার কিছু নেই। আপনার কি খবর?
-নিউইর্য়কে এক ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে আছি। ছুটিতে দেশে এলাম।এই তো।
-ওয়াইফ নিয়ে আসেন নি? হাসলাম।
-বিয়েটা এ ভ্যাকেশনে করব ভাবছি। টুকটাক কথা হল।চারু ভীষণ চঞ্চল।ঠিক যেন মায়ের মত। সে বলল,
-উঠতে হবে এবার, বিকেলে মেয়ের কোচিং আছে?
-ঠিক আছে। সে রিকশায় উঠে বসতে প্রথমবারের মত ডাকলাম,
-দীপা।
-বলুন।
-ফোন নাম্বারটা জানা হল না।
-নাম্বার দিয়ে কি হবে?
-বিয়ের দাওয়াত দিতাম। সে হেসে বলল,
-কোনো দরকার নেই।এমনিতেই শুভকামনা রইল ।
ভাই,রিকশার হুডটা তুলে দিন। সে চলে গেল। কফিশপে আবার ঢুকলাম। যে চেয়ারটায় সে বসেছিল সেখানে গিয়ে বসলাম। চেয়ারে,টেবিলে তার স্পর্শ মেখে আছে। প্রতি ভ্যাকেশনে বাড়ি ফিরলে আত্মীয়স্বজন,পরিচিত মহলে আমার পাত্রী খোঁজা একটা হইচই পড়ে যায়।মা আজকাল সবার মত ব্যস্ত হন না। কাছে বসিয়ে প্রশ্ন করেন,
-কেমন মেয়ে চাস বলো তো?
প্রশ্নটা শুনতে পাই নি এমন ভাব করে বুকের পাশে হাত রাখি। এইখানে কারো ছবি আঁকা আছে। ইচ্ছা আছে ছবির মালিকিন নিয়ে একখানা উপন্যাস লিখব।সেই সময় আর সুযোগ আর হয়ে উঠছে না।