বাবা কেমন আছো জানতে চাইবো না, কারণ আমি জানি তুমি খুব ভালো আছো, ভালো থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবটুকুই তোমার কাছে আছে, কিন্তু আমার কাছে কোন একটা কারণ ও নেই যেটাতে আমি একটু ভালো থাকতে পারি।
কেন জানি না আজ এত বেশি মনে পরছে তোমায়, কি দোষ ছিলো আমার আর আমার মায়ের, আমি ইভা আন্টির কাছে সব শুনেছিলাম, মা কখনো কিছু বলে নি তোমার ব্যপারে,কিন্তু ইভা আন্টি বলেছিলো তুমি নাকি মা কে ভালবেসে বিয়ে করেছিলে, তাহলে মাঝ পথে কেন ছেড়ে গিয়েছিলে? একটি বারের জন্যও তুমি তোমার অনাগত সন্তানের কথা ভাবো নি, ভেবেছিলে তোমার পরিবারের কথা, তোমার বাবা মায়ের কথা, তাই যদি হয় তবে কি দরকার ছিলো মা কে ওভাবে ঠকানোর?
আমি প্রায় রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠতাম, আমার মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো, কিন্তু কেন বাবা, মা কে এভাবে না কাঁদালেই তো পারতে তাই না! মাঝে মাঝে তোমার উপর খুব ঘৃণা হতো আমার, যখনই তোমার ব্যপারে কিছু বলতাম, মা আমার মুখ চেপে ধরে বলতো, “মামনি নিজের বাবা সম্পর্কে এসব বলতে হয় না”। আমি চুপ হয়ে যেতাম।
সবকিছু ভুলে মা কে নিয়েই ভালো ছিলাম আমি, কিন্তু সেই মা ও চলে গেল আজ থেকে তিন বছর আগে, আর কখনো ফিরে এলো না, তখন অতটা বুঝ হয় নি আমার, ভেবেছিলাম মা ঘুমিয়ে আছে, একটু পরে জেগে উঠবে, কিন্তু মা আর জাগলো না।
সবাই বলেছিলো অনেক গুলো টাকা হলে নাকি মা কে বাঁচানো যেতো, তোমার তো অনেক টাকা ছিলো, মা চাইলে তার অধিকার টুকু ঠিকই আদায় করতে পারতো, কিন্তু মা যে তোমাকে ভালবাসতো তাই তোমায় কোন ব্যপারে জোর করে নি।
জানো বাবা আজ আমি বড্ড একা, মা নেই পাশে, তুমি ও নেই, মা থাকলে হসপিটালের ব্যাডে আমায় একা শুয়ে চোখের জল ফেলতে হতো না, কিন্তু মা তো নেই আজ, তাই আমি একাই এসব ভাবছি। মা কখনো তোমায় ঘৃণা করতে শেখায় নি, ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন, তাই আমি তোমায় ভালবেসেই চিঠি লিখলাম, একটি বার তোমার ঐ মুখটা দেখতে চাই আমি আর কিচ্ছু চাই না তোমার থেকে, আসবে তো তোমার এই মেয়েটাকে এক নজর দেখা দিতে? আমি জানি তুমি আসবে। তোমারই অপেক্ষায় তোমার মেয়ে নিহা। চিঠি টা পড়া শেষ করে ইভার দিকে তাঁকালেন আবির সাহেব, চোখের কোণে দু ফোঁটা জল।
– নীলা আর তোর মেয়ে আবির। (আবিরের দিকে তাঁকিয়ে বললো ইভা)
– চল।
– যাবি তুই?
– হ্যাঁ।
দুজনেই রওয়ানা দিলো হসপিটালের দিকে, দরজা আটকে দাঁড়ালো আবিরের দ্বিতীয় স্ত্রী অহনা।
– কোথায় যাচ্ছো?
– নিহার কাছে।
– নিহা কে?
– নীলার কথা মনে আছে?
– হ্যাঁ।
– নিহা আমার আর নীলার সন্তান।
– তুমি যাবে না সেখানে।
– আমি যাবো আর নিহাকে নিয়ে বাসায় ও ফিরবো।
– ওই মেয়েটা এই বাসায় আসবে না।
– সেটা আমি ডিসাইড করবো তুমি না।
আবির আর কিছু না শুনেই চলে এলো। রাত দুটো বাজে, আবির নিহার মাথার কাছে বসে আছে, নিহা চোখ খুলছে না, ওর চোখের কোণ বেয়ে যে জল পরেছে তার চিহ্ন টা রয়ে গেছে, আবির নিজের হাতে চোখের পানি টা মুছে দিলো। নিহার মাথায় হাত বুলিয়ে মামনি মামনি বলে ডাকছে আবির, কিন্তু নিহা সাড়া দিচ্ছে না, এভাবে কয়েকবার ডাকার পরেও যখন নিহা আর সাড়া দিলো না তখন আবির চিৎকার করে ডাক্তার ডাকলো, ডাক্তার জানালেন নিহা আর বেঁচে নেই। আবির কান্নায় ভেঙ্গে পরলো, জীবনের সমস্ত চাপা কষ্ট গুলো আজ চোখের জলের সাথে বেরিয়ে আসছে। আবির নিহার হাত দুটো ধরে ওর কপাল, গাল, মুখ সবটা ছুঁইয়ে নিলো, নিজের মেয়ের থেকে পাওয়া প্রথম এবং শেষ ভালবাসা ছিলো এটা। নিহার হাতে ছোট একটা কাগজ ছিলো, কাগজটা আবির হাতে নিলো, ওটাতে লিখা ছিলো।
বাবা এখনো তুমি এলে না, এতটা সময় ধরে অপেক্ষা করলাম তোমার জন্য তবুও দেখা হলো না, তোমার একটু আদর পেতে চেয়েছিলাম, আমি জানি তুমি আসবে, আমি চলে যাবার পরে হলেও তুমি আসবে, যদি পারো আমার কপালে একটা চুমো দিও, চলে গেলাম বাবা সেখানে হয়তো আবার মায়ের দেখা পাবো, ভালো থেকো তুমি।। আবির নিহাকে বুকে জড়িয়ে হাজারটা চুমো খেলেন আর বললেন “আমায় তোরা ক্ষমা করিস না মা, কখনো ক্ষমা করিস না, আমি কখনো তোর যোগ্য বাবা ছিলাম না আর তোর মায়ের যোগ্য স্বামীও ছিলাম না।।
সমাপ্ত