কৈতরীর বয়স যখন ৬ বছর,জন্মদিনের দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে জিগ্গেস করেছিলো,,,আম্মু সৎমা কি জিনিস?কৈতরীর এমন প্রশ্নে জামান আর আমি রীতিমত খুব বেশিই অবাক হলাম।৬ বছরের একটা বাচ্চার মুখে এ কেমন ধরনের প্রশ্ন।কোথা থেকে এমন প্রশ্ন পেল সেটা ভেবেই চিন্তিত হলাম।
কৈতরীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তখনকার পরিবেশটা সামাল দিলেও মনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিলো।বার বার সৎমা নামক শব্দটা আমাকে পীড়া দিচ্ছিলো।ভয় হচ্ছিলো,মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো,,,তাহলে কি মেয়েটা সত্যতা জেনে গেলো?এই প্রশ্ন কি আমার আর কৈতরীর মাঝে দুরত্ব সৃষ্টির কারন হবে?নাহ কিছুই ভাবতে পারছিনা।
এদিকে জামানের বিহেভে খুবই বিব্রতকর পরিবেশ সৃষ্টি হলো।কোনো দিক বিবেচনা না করেই জামান আমাকে দোষারোপ করে বলতে লাগলো,,,,কেমন মা তুমি মাফি?তোমার মেয়ে কোথা থেকে শিখে এগুলা?মেয়েটার প্রতি পুরাই একটা কেয়ারলেস তুমি।জামানের এমন কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ হলো।রাগের মাথায় বলেই ফেল্লাম,,,শোনো জামান,কৈতরী শুধু আমার না তোমারও মেয়ে।আমি যদি ওর প্রতি কেয়ারলেস হই তাহলে তুমিও কেয়ারলেস।কারন চাকরিসুত্রে তুমি আমি দুজনই সারাদিন ঘরের বাইরে থাকি,ছোট থেকেই তো মেয়েটা বড় হচ্ছে কাজের মেয়েটার কাছে।ছুটির দিন ছাড়া কখনই বা আমাদের কাছে পায় মেয়েটা।
আমার কথা শুনে জামানও হালকা রেগে গিয়ে কৈতরীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।আমি নিরব হয়ে এক দৃষ্টিতে দেখছি দুটি ঘুমন্ত চাঁদের মুখ।আমার জিবনটাই শুধু যাদের জন্য উৎসর্গ করা। মনে পড়ে কয়েক বছর আগের কথা,যেদিন দুই বছরের কৈতরীর আঙুল আমার আঙুরে তুলে দিয়ে জামান বলেছিলো,,, মাফি তুমি আমার কৈতরীর মা হবে?সেই দিনটা ছিলো আমার জিবনের সব থেকে বড় সুখেরর দিন।মনে হয়েছিলো আমার জিবনেরর সকল সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি কৈতরী আর জামানের মধ্যে।
একটা সময় ছিলো যখন জামানের সাথে আমার ছোটবেলার প্রেম থাকা সত্বেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারনে আমাদের বিয়েটা হলোনা।বাসরে যখন জামানের জায়গায় অন্য কাউকে দেখেছি তখন ইচ্ছে করছিলো মরে যাই।তবুও বেঁচে ছিলাম জামানের কথা ভেবে,আমি যদি মরতে চাই তাহলে জামানের কি করা উচিত সেই সময়টাতে এই ভাবনাটাই ছিলো আমার মস্তিষ্কে।কারন প্রত্যাখান তো আমিই জামানকে করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছর পর যখন কখনো মা হতে পারবোনা জেনে ডিভোর্সী হলাম।তখন দ্বিতীয়বারের মত আমার আবার মরতে ইচ্ছে করছিলো।ঠিক সেই মুহূর্তে নীলা আর জামানের সন্তান কৈতরী বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে আমার জিবনে আসলো।
আমার বিয়ের পর জামান নীলাকে বিয়ে করেছিলো ঠিকই।কিন্তু কৈতরীকে উপহার দিয়ে নীলাও আমার জামানকে রেখে চলে গেল পরপারে।তারপর থেকে আমিই কৈতরীর মা।আমি কৈতরীকে পেটে ধরিনি,কিন্তু তার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক।যেমন দুই দেহে একটাই প্রান।আর আমার থেকে যদি কখনও কেউ কৈতরীকে আলাদা করে দেয় সেদিন আমার মৃত্যু হবে নিশ্চিত।তাই নিজের সমস্ত ভালবাসা উজাড় করার পরেও কৈতরীকে হারানোর ভয় আমার পিছু ছাড়েনা।
আজ যখন কৈতরীর মুখে সৎমা নামক শব্দটা শুনলাম,মনে হলো বুকের ভিতর থেকে হাত দিয়ে কেউ আমার কলিজাটা ছিঁড়ে নিচ্ছে।ঠিক যেমনটা হয়েছিলো একবার গ্রামের বাড়িতে থাকতে। কৈতরী আর জামানের সাথে আমার বসবাসের বয়স যখন এক বছর তখন আমাদের ভালবাসার প্রতি চোখ পড়েছিলো প্রতিবেশী নামক কিছু শকুনের।তাদের মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ছিলো,কি করে আমাকে আর কৈতরীকে আলাদা করা যায়।আমাকে ডেকে তারা পরামর্শ দিতেন,,,যত ভালোবাসো না কেন তোমার ক্ষেত্রে কিন্তু মায়ের আগে সৎ যোগ হবেই।
তাই বলি এত বেশি ভালবাইসা মাথায় উঠাইয়ো না,নিজের পেটে তো আর ধরোনি।এত ভালবাসার কি দরকার।আমি ভেবে অবাক হতাম,একটা বাচ্চার ক্ষেত্রে তাদের এরকম মনোভাব কি করে আসে। তারা শুধু আমাকে নয় জামানকেও আমার বিরুদ্ধে অনেক কু-পরামর্শ দেয়া শুরু করে।তারা জামানকে বলে,,,,তুমি তো থাকো মিয়া শহরে,বাড়ির খবর কি রাখো।তুমি আসার পরই তোমার মেয়ের প্রতি মাফির ভালবাসা বাইড়া যায়।কথায় আছেনা চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।ঠিক সেইরম।থাকিতো আমরা বাড়িতে,,দেখি তোমার মাইয়ারে কত ভালবাসে।সারাদিন শুধু কান্দায়।
জামান সেদিন আমার কথা না শুনেই ক্ষুদ্ধ হয়েছিলো আমার প্রতি।এদিকে কৈতরী খেতে না চাওয়ায় যখন জোর করে খাওয়াচ্ছিলাম, খাবেনা বলে কান্না করে।আর ঠিক তখনই এন্ট্রি হয় জামানের।আগে পিছে কিছু না দেখেই জামান প্রতিবেশিদের কথাই বিশ্বাস করে নেয় আর আমাকে হার্ট করে বলে,,,শোনো মাফি, তুমি যদি আমার মেয়েকে মন থেকে ভালবাসতে নাই পারো তাহলে তাকে কাঁদানোর অধিকার তোমার নাই।সেদিন প্রথমবারের মত আমার কাছ থেকে কৈতরীকে আলাদা করে নিয়ে জামান অন্য রুমে ঘুমায়।সেদিন আমি সারারাত কেঁদেছি।কৈতরীকে হারানোর যন্ত্রনায়।কি করে বুঝাতাম কৈতরী ছাড়া আমি অসহায়।
নেহাত আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বেঁচে ছিলেন।শ্বশুর যখন জামানকে চড় মেরে বলে,,কেন মানুষের কথায় শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস।কৈতরীকে মাফি কাঁদায়নি,ভালবেসেছে।খেতে চায়না বলে জোর করে খাওয়াচ্ছিলো, কৈতরী খাবেনা বলে কেঁদেছিলো।যেটা নীলা হলেও করত।তাহলে মাফির ক্ষেত্রে কেন ব্যাতিক্রম হবে।মাফির নামের আগে সৎ নামক লোগোটা লাগানো আছে তাই?এখন তোর যদি মনে হয় কৈতরীকে জোর করে খাওয়ানোই মাফির দোষ তাহলে আজ থেকে আর মাফি খাওয়াতে যাবেনা তোর কৈতরীকে।তোর মেয়ে তুই একদিন সামলিয়ে দেখা কেমন পারিস।
শ্বশুরের কথায় জামান সেদিন আস্থা খুঁজে পেলো।আমার কাছে ক্ষমাও চাইলো অনেকবার।কিন্তু আমি তো সারাদিন পর কৈতরীকে কোলে পেয়েই খুশি।কাঁদতে কাঁদতে হাজারও চুমু খেয়েছি আমার কৈতরীর কপালে,গালে আর ঠোঁটে।
তারপর প্রতিবেশীদের তাড়নায় আমি আর কৈতরী জামানের সাথে শহরে আসতে বাধ্য হলাম।মূলত কৈতরীকে সৎমা নামক শব্দ থেকে দুরে রাখতে শহরে আসা।যেখানে সবাই জানবে আমি শুধুই কৈতরীর মা। তারপর কৈতরী বড় হতে লাগলো,তিন জনের ছোট্ট সংসার খুবই আনন্দে কাঁটে আমাদের।কিন্তু আজ হঠাৎই কৈতরীর মুখে এই শব্দ শোনার পর আমার বার বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে। সকালবেলা কৈতরীকে ঘুম থেকে তুলে পরম যত্নে জিগ্গেস করলাম,,,আম্মু সত্যি বলো তো,,সৎমা শব্দটা কোথায় পেলে?কে বলছে তোমাকে?
কৈতরী তার বাচ্চামি ভরা কন্ঠে বলল,,,,রিতা আন্টি সিরিয়াল দেখে বলছিলো,, সৎমা গুলা এমনই হয়।এক একটা শয়তান।বাচ্চাদের জীবন হারাম করে ছাড়ে।আচ্ছা আম্মু সৎ মা কি খুব খারাপ মা হয়? এই রিতা হচ্ছে আমাদের কাজের মেয়ে।মনে মনে বল্লাম রিতার গুষ্টি,আর মুখে হেসে কৈতরীকে বল্লাম,,,এমন উদ্ভট প্রশ্ন করেনা মা।মা তো মা-ই হয়।যে তার বাচ্চাকে আগলে রাখে, ভালবাসে।ঠিক যেমন আমি তোমায় ভালবাসি।সৎমা বলতে কিছুই নেই।তোমার রিতা আন্টির তো মাথা খারাপ।তাই উল্টা পাল্টা বকছিলো।এসব কথায় কান দিবা না।
তারপর একদিন,, জামান তৈরি হয়ে অফিসে যাচ্ছে আর আমাকে কৈতরীকে স্কুলের জন্য রেডি করতে দেখে বলল,,,কি ব্যাপার মাফি?আজকে তোমার অফিস নাই।আমি এক দৃষ্টিতে জামানের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।আর হ্যা কাজের মেয়েটাকেও আর আসতে বারন করে দিছি।আজ থেকে আমার মেয়েকে আমিই দেখবো,আগে আমার মেয়ে তারপর সবকিছু। কথাটা শুনে জামান এক তৃপ্তির হাসি দিলো।সেই হাসিতে কৈতরীও খিল খিল করে হাসি দিলো।আর আমি যেন পৃথিবীর সবথেকে শুদ্ধতম হাসিকে অনুভব করলাম।