জুলেখার শরীরে অর্ধেক শাড়ি পেঁচিয়ে রয়েছে বাকি অর্ধেক উঠোনের মাঝে কাপড় নাড়া শুকনো বাঁশটার ওপরে।এই বেলায় কেউ এমুখো হবেনা বলেই ভেজা শরীর নিয়ে এমনি করে রোদে শাড়ি শুকাচ্ছে জুলেখা,বাঁশে নাড়া অংশ শুকিয়ে আসলেই সেটুকু গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে পালাক্রমে ভেজা অংশটুকু আবার বাঁশের ওপর নেড়ে দেবে, আর কেউ আসলেই বা কী? লোক লজ্জার ভয় জুলেখা হারিয়েছে অনেক আগেই।
দৈন্যতা, অভাব,দারিদ্রতায় মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটাই যখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন কে পাছে কী বলল কিংবা লোক লজ্জার ভয় বড়ো তুচ্ছে ঠেকে। আধছেঁড়া গামছা দিয়ে চুল বাড়ি দিতে দিতে জুলেখা গলা বাড়িয়ে বলল, ও শিউলি,ভাত বাড়ছোস নি? ছন, পলিথিনে ঘেরা জীর্ণ হেঁশেল ঘর থেকে জবাব আসে,হ মা বাড়ছি।জুলেখা অপরাধীর মতো বলে,আর একটু বয়,এই শুকাইয়া গেছে। শিউলি জানে “আর একটু” কথাটা কেবল অপেক্ষার সঙ্গে সন্ধি করে রোজ,এই আর একটু বসে থাকতে থাকতে জুলেখার ছোটো ছেলে হানিফ হেঁশেলের পুরনো পাটিতে ঘুমিয়ে যায়,শিউলি গোট বিশেক উঁকুন এনে মেরে ফেলে,শিউলির ছোটবোন আসমা সেই উঁকুনের হিসেব কষে খুব সাবধানে।
গফফার বাউলা যখন জুলেখাকে বিয়ে করে আনল তখন তাদের গোয়ালে একটা সাদা গাই ছিল,সেই গাই রোজ আড়াই সের দুধ দিত।বাড়ির সামনের ছোট্ট পুকুরখানায় মাছের ছড়াছড়ি ছিল,গোসল করতে গেলেই মাছে এসে পা ঠোকাত।গফফার এক কার্তিক মাসের মাঝ দুপুরে সেই যে উধাও হলো আর ফিরল না,সময় গড়াতেই গোয়ালের গাই খানা,পুকুরের মাছগুলোও চাহিদা মেটাতে গিয়ে উধাও হলো মনিবের মতোই।প্রথম দিকটায় জুলেখার জীবন যেন থমকে গিয়েছিল,দিন বাড়তেই জুলেখার চোয়াল শক্ত হলো,জেদের ভিতটা মজবুত হলো। এর ওর বাড়ির চালের গুঁড়ো কুটে দিতে শুরু করল,গোট দশেক মুরগীর জন্য ঘরও হলো,ঘরের পেছনটায় সারি ধরে কলাগাছ লাগানো হলো।এমন করেই টেনেটুনে চলে যাচ্ছে জুলেখাদের দিন। বড়ো মেয়ে শিউলির জন্য নানা জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে।জুলেখা বেশ ধীর স্বাভাবের মানুষ,তাড়াহুড়ো তার অপছন্দের।
দেখেশুনে,মেয়েক ভালো ঘর দেখে গুছিয়ে দেবার সঙ্গে আপোষ করতে সে রাজি নয়।দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ের বিয়ের জন্য নানা উৎস থেকে টাকা সঞ্চয় করে চলেছে সে।কখনো কোন কিছুতে দমে যাওয়ার স্বভাব নেই তার।দেখা গেল মাছ কাটতে গিয়ে গলগলিয়ে আঙুল বেয়ে রক্ত পড়লেও সে নির্বিকার ভঙ্গিতে মাছ কেটে যায়,মাছ কাট শেষ হলেই ছেঁড়া কাপড়ের ছোট্ট টুকরোয় আঙুলখানা পেঁচিয়ে নেয়।ভেতরের মানুষটা যখন পাথর হয় তখন চোখের জল কিংবা রক্তবিন্দুকেও বাইরের মানুষটা শিশিরবিন্দু ভেবে পায়ে মাড়ায়।
হায়… ট্ট..ট্ট…হাট গরু…হাট।খবীর গরু নিয়ে বিলে যাবার পথে শিউলিকে দেখে গরুর দড়ি টেনে ধরল।
শিউলি কেমুন আছ? ভালা। কী কর শিউলি? কানা নি? দ্যাহেন না গাছের গুড়িত গোবর দিতাছি। হ তাই তো দ্যাখতাছি।তুমি এমনে রাইগা রাইগা কথা কও ক্যান আমার লগে?
শিউলি এমন ভাব ধরে যেন সে খবীরের কোন কথা শুনতেই পায়নি,এমন নিরব উপেক্ষায় খবীর অভ্যস্ত।খবীর উত্তর না পেয়েও নানা কথা টেনে আনে, মাঝেসাঝে শিউলি উদারতা দেখিয়ে দু চারটের কথার হু হা জবাব যে দেয় না তা কিন্তু নয়। পাশ থেকে আসমা বলে,আপা আপনেরে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না হেইডা বুঝেন না? হ,বুঝি তো। তাইলে আপা আপনের কথার জবাব না দিলেও কেন বেহায়ার মতো খাড়াইয়া থাকেন? খবীর এবার আর কোন কথা ভেবে পায়না।নরম কাদায় নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে গর্ত করে যেন মাটির ভেতরে ঢুকে যেতে চায়।আসমা বোঝে খবীরকে বেশ কড়া ভাবেই বলা হয়ে গেছে কথাগুলো।আসমা ফিক করে হেসে বলে,খবীর ভাই! আপনের গরু কই?
খবীর মাথা উঁচু করে দেখল গরু মেলা দূরে চলে গেছে,কারো ধানে মুখ দিলেই সর্বনাশ।খবীর জিহ্বায় কামড় বসিয়ে বলল,হায় আল্লাহ! ধানে মুখ না দিলেই হয়।পরে আমুনে আবার,যাইগা আসমা।আসমা প্রত্যুত্তরে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।শিউলি,আসমা কখনো খবীরকে আসার কথা বলেনি,প্রতিবারই খবীর যাবার সময় বলে যায়, পরে আমুনে।খবীর পরে আসে ঠিকই তবে যখন সে চিকন অপমান আর উপেক্ষা ভুলে যায় তখনই আবার এমুখো হয় সে। কিরে তুই এমনে কাটাকাটা কথা কইলি ক্যান? মানুষরে এমনে কথা কইতে হয়? আসমা শিউলির এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়না।শিউলির কোথাও যে খবীর নামের এই সহজ সরল মানুষটি খুব গোপনে থাকে সে কথা আসমার অজানা নয়।আসমা ঠোঁটের কোণে হাসি এনে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল,তুইও তো এমনে কথা কস,তহন কিছু হয়না?
শিউলি আর কথা বাড়ায় না,কথা বাড়ালেই আসমার দিক থেকে যখন-তখন বিব্রতকর প্রশ্ন ছুড়ে আসতে পারে এ কথা তার বেশ জানা।বাপ ছাড়া সংসারের মেয়েদের নিয়ে কথা শেষ নেই,তাদের চুল লম্বা হলে দোষ হয়,তাদের গায়ের রঙ ফর্সা হলেও দোষ হয়।শিউলি নিজের গোপন দুর্বলতা বোনকে জানিয়ে তাকে প্রশ্রয় দিতে চায়না,তার সাহস বাড়িয়ে দিতে চায়না;এইটুকু সাবধানী না হলে নিজেদের ছুঁড়ে দেয়া থুতুটা যে নিজেদের মুখে এসেই পড়বে।
ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে,কুপির আলোটা কেঁপে উঠছে দমকা বাতাসে।আসমা কুপি নিয়ে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে,শিউলি হাঁটু সমান পানিতে নেমে কচু কেটে চলেছে।জুলেখা গেছে চাল কুটতে,চাল কুটে বাড়ি ফেরে বেশ রাত করেই।ততক্ষণে বেশিরভাগ ঘরগুলোর কুপি নিভে যায়,জানালা বন্ধ হয়ে আসে,আর ঠিক তখনই রাতের ভাত চুলোয় চড়ায় শিউলি।হানিফ সন্ধ্যে নামতেই ঘুমিয়ে পড়ে,আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।হানিফকে রোজ রাতে ডেকে ঘুমের ঘোরেই ভাত খাইয়ে দেয় শিউলি,হানিফ বরাবরই সকালে উঠে খানিক্ষন কাঁদবে, কান্নার কারণ সে রাতে খিদে পেট নিয়ে ঘুমিয়েছে,কেউ তাকে খেতে ডাকেনি কেন।সংসারের বড়ো বোনটা ঠিক কখন যে হানিফের মায়ের জায়গাটাও দখল করে নিয়েছে সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি হানিফ,তার বোঝার বয়সটাই বা কত?
কচু ঘন্ট দিয়ে খুদের ভাত মাখিয়ে ঘুমে ঢুলতে থাকা হানিফের মুখে তুলে দিচ্ছে শিউলি,আসমার চোখ দুটোতেও রাজ্যের ঘুম,তবে পেটের খিদের কাছে রোজই হার মানে তুচ্ছ নিদ্রা-ঘোর।ঢেঁকি পাড়াতে পাড়াতে হাঁপিয়ে ওঠে জুলেখা,এক গ্লাস পানি ছাড়া কিছু জোটেনা।জুলেখা শিউলি কিংবা আসমার কথা ভুলে গিয়ে গপাগপ করে নুনে কটা কচু ঘন্ট মুখে পুরে নিচ্ছে।জুলেখা কাঙালের মতোই শিউলির দিকে বাসন এগিয়ে দিয়ে বলল,দুইডা ভাত দে।শিউলির নিরবতায় জুলেখা বাসন নিয়ে কলপাড়ে চলে আসে, বার কয়েক পানি ফেলে দিয়ে বাসন ভরতি ঠান্ডা পানি যেন এক নিশ্বাসেই খেয়ে নেয় সে।
মাচার ওপর বাসন রাখতে গিয়ে জুলেখার হুশ ফেরে,জুলেখা সন্দেহর দৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলে,তুই খাইছস? হ,আমি খাইছি তো। দ্যাহো নাই? হানিফরে খাওয়াইতে যাইয়্যা দুইডা মুখে দিছস,ঐডারে খাওয়া কয়? বিশ্বাস না হইলে প্যাডে হাত দিয়া দেখ। জুলেখার বিশ্বাস হয় আবার হয়ও না। কুপি নিভে গেছে,সবাই শুয়ে পড়েছে।শিউলি চৌকির তলায় থাকা আধপাকা কলা আগেই সরিয়ে রেখেছিল।কচকচ করলেও সেই আধপাকা কলা দিয়েই রাতটা কাটিয়ে দেয় শিউলি,কয়েকশো রাত এমন নিভৃত চুরির সাক্ষী হয়ে আসছে সেদিন থেকেই যেদিন শিউলি কৈশোরকে ফাঁকি দিয়ে বুকে ঢিলেঢালা মস্ত ওড়না জড়িয়ে নিয়েছিল।
শিউলি রোজ এভাবেই ফাকি দিয়ে চলেছিল জুলেখাকে,নিজেকে।খবীর নানা ছুতোয় শিউলির কাছ ঘেঁষতে চেয়েও শিউলির নিরব উপেক্ষায় বারবার ফেরত যেতে হয়েছে।শিউলির মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় হাবাগোবা খবীরের সাথে চারটে ভালো কথা বলতে,খবীরের সারল্যতার কপাল জুড়ে তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে শত দিনের নিরব উপেক্ষার হিসেব চুকিয়ে দিতে।শিউলি পা বাড়ানোর সাহসটুকু করেনা,তার পা যে দায়ের শিকড়ে বাঁধা। সাত সকালেই আজগর মিয়া এসে হাজির হয়েছে জুলেখার বাড়িতে।পিঁড়ি পেতে বসেছে সে,জুলেখা তার মুখোমুখি বসে খেজুরের পাতা দিয়ে পাটি বুনে চলেছে । আজগর মিয়া গলা নিচু করে বলল,তোমার মাইয়্যাডার লাইগ্যা একখান ভালা ঘর পাইছি,পোলার বাপের মেলা সম্পদ।পোলাও বেশ ভালা,কোন দুর্নাম নাই।পোলার বাপের তোমার মাইয়্যারে মনে ধরছে।অহন তুমি যদি কও দেওন লাগব কী?
আহ! কিচ্ছু দেওন লাগবো না।হেরা কি ফকির নি? শুধু পঞ্চাশজন মানুষ খাওয়াইবা আর তোমার মাইয়্যারে তুমি যা দেওনের দিবা। এই কইলা কিছু দেওন লাগবো না! আর এইগুলা করতে গেলেও তো মেলা টেকার কাম। আইজকাল ফকির মিসকিনও তো এডি করে।এক্কেরে হুদাহুদা মাইয়্যা পার করোন যাইব? জুলেখার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, হাত চলছে দ্রুত গতিতে।আজগর বুঝতে পারে তার চালে কাজ হয়েছে,আজগর মুহূর্ত গোনে কেবল।জুলেখা আজগরের দিকে চোখ তুলে বলল,তাইলে পোলার বাপরে আইতে কয়।হের লগে সব কথা কাম করি।
নিজের সর্বস্ব, এর ওর কাছে হাত পেতে যা জুটেছে তা দিয়ে বেশ আয়োজন করেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শিউলির।খবীর বিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছে,জানালা দিয়ে শিউলি খবীরকে একমুহূর্ত দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়, শিউলির মনে হচ্ছে কেউ একজন তার সামনেই তার ভেতরের শিউলির গলাতে ছুরি বসাচ্ছে।অত:পর তার গলা বেয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে।আজ রক্তবিন্দুকে শিশিরবিন্দু ভেবে পায়ে ঠেলে তিনবার কবুল পড়ে নেয় শিউলি
শিউলির বিয়ের মাস পুরে গেছে।
আসমা এখন রাত জেগে রাঁধতে বসে,কুপি নিভে গেলে আরও দু গ্লাস পানি খেয়ে নেয় কখনো কচি জামরুল চিবিয়ে খেয়ে নেয়।জুলেখা আবার পুরোদমে উঠে পড়ে লেগেছে নতুন সঞ্চয়ের জন্য,দায় যে আরও একখানা ঘাড়ে চেপে আছে তার।আসমাও শিউলির দেখানো পথে হাঁটছে,নিভৃতে দায়মুক্তির জন্য দূরের বাঁশিওয়ালাকে কত যত্নে উপেক্ষা করে চলেছে সে।যে উপেক্ষা জুলেখা করে আসছে প্রতিদিন নিজের ভেতরের জুলেখাকে।