সন্তান

সন্তান

মরার আগে আল্লাহর কাছে আমি দুটো জিনিস চাই। এক নাম্বার হলো একটা বাচ্চা। আর দুই নাম্বার হলো কোমর ছোঁয়া চুল। সেই বিশ বছর বয়স থেকে চাইতে শুরু করেছি, এখন আমার বয়স পঁয়তাল্লিশ। তবুও আমি আশা ছাড়িনি। আমার কেন জানি মনে হয় আমার ঘ্যানঘ্যান সহ্য করতে না পেরে আল্লাহ এক সময় আমার এই চাওয়া দুটো পুরণ করবেন। এটা আমার বিশ্বাস বুঝছো লিপি বলে আমার কাঁধ ছুঁয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠেন নিনা ভাবি। আমি অবাক হয়ে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার হাসি আসে না। তার কথার মাঝের কষ্টটা আমাকে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু তিনি কী সাবলীল ভাবেই না বলে গেলেন কথাগুলো! তার হাসির রেশ এখনো মুখে লেগে আছে।

এই নিনা ভাবি এবং তার বরকে আমি গত পাঁচ বছর ধরে চিনি। নিঃসন্তান এই দম্পতির বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকি। উনার স্বামী আজিজুর রহমান একটা ব্যাংকের এমডি। আর উনি একটা সরকারী কলেজে রসায়ন বিজ্ঞান পড়ান। খুবই অমায়িক ভদ্র হাসিখুশি দুজন মধ্যবয়সী মানুষ। আমার ছেলে-মেয়ে দুটোকে খুব আদর করেন। নিজেদের বাচ্চা নেই এটা নিয়ে উনাদের কখনো মন খারাপ করে কথা বলতে দেখিনি। আসলে নিজেদের দুর্বলতা অন্যের সামনে বলে তাকে বিব্রত করতেন না। তবে এমন কোনো চেষ্টা নেই যে উনারা বাচ্চার জন্য করেননি। কিন্তু আল্লাহ উনাদের দিকে মুখ তুলে তাকাননি।

আজিজ ভাই আশা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু নিনা ভাবি ছাড়েননি। তার বিশ্বাস তার এ দুটো ইচ্ছা পূরণ না হলে তিনি মরবেন না। ভাই শুনে বলেন,’ আমার বাচ্চা লাগবে না নিনা। তুমি বেঁচে থাকো।’ নিনা ভাবি দুষ্টু হাসি হেসে বলেন,’ আর বউয়ের মাথার চুল?সেটা লাগবে না? বয়কাট চুল যে তোমার পছন্দ না সেটা আমি কিন্তু জানি!’ ‘জানো, খুব ভালো হয়েছে। এই বুড়ো বয়সে আর এসব দিয়ে কী হবে? আল্লাহ তোমাকে সুস্থ সবল রাখুন, তাতেই আমি খুশি হবো।’ নিনা ভাবি হেসে বলেন,’ বুড়ো হয়েছি তাতে কি! আমি আল্লাহর কাছে চাইতেই থাকবো। এলো চুলে তোমার সাথে ছবি তুলে বাঁধিয়ে রাখবো।’ আজিজ ভাই আর কথা বলেন না। চুপচাপ নিনা ভাবির কথা শুনে যান। ভাবি কথা বলতে পছন্দ করেন। উনি শুনতে পছন্দ করেন।

এসব আমি উনার কাছ থেকেই শুনেছি। উনি বলতেন,’ জানো, আমার যে বছর বিয়ে হলো সেবার কঠিন টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। তাতে আমার মাথার চুল প্রায় সব পড়ে গেল। আমার আম্মা টাক করে দিলেন। যাতে চুল ভালো মতো গজিয়ে ওঠে। টাইফয়েড হয়ে চুল পড়ে গেলে নাকি এটাই নিয়ম। আমি তখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে ক্লাসে যেতাম। ভাবতাম কয়েক মাস গেলেই আবার চুল উঠে মাথা ঢেকে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। আমার মাথায় চুল হলো না। যে কয়েকগাছি হলো তাও বড় হয় না। কি আর করা। তবে আমি আশা ছাড়িনি,বুঝলা বলে উনার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হাসতেন। যেন খুব মজার একটা ব্যাপার।

এর কয়েক মাস পর সেই নিনা ভাবি একদিন দুপুর বেলা আমার ফ্লাটের কলিং বেল বাজালেন। আমি দরজা খুলতেই উনি হড়বড় করে বললেন,’ আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন লিপি! আমার মতো অভাজনের ডাক তিনি শুনেছেন….’ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। ভাবিকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। উনার ক্রন্দসী রুপের সাথে আমি পরিচিত না। কেমন বাচ্চাদের মতো ফুলে ফুলে কাঁদছেন। অনেক কষ্টে জানতে পারলাম উনার কান্নার কারণ। উনি যা বললেন তার সারমর্ম হলো,’ উনি মাস খানেক ধরেই নিজের ভিতরে একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছিলেন। উনার মাথা ভর্তি চুল গজিয়েছে। সেগুলো দ্রুত বড় হচ্ছে। আমাকে মাথার কাপড় সরিয়ে দেখালেন। আসলেই উনার প্রায় টেকো মাথা চুলে ভর্তি। কাঁধ ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছে একরাশ চুল। কি যে সুন্দর লাগছে উনাকে দেখতে!

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই তিনি বললেন,’ আসল খবরটা তো তোমাকে এখনো আমি দিইনি। আমি আগেই সন্দেহ করছিলাম। কাউকে বলিনি। যদি না হয়। আজকে ডাক্তারের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়ে আসলাম। আমার সন্তান হবে লিপি, সন্তান! এই এতটুকু একটা বাচ্চা হবে আমার নিজের। বুকের সাথে চেপে ধরে আমি ঘুমাবো। ইশ,এ আনন্দ আমি বুঝাতে পারছি না বলেই আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। আমি কী বলবো বুঝতে পারি না। এই আনন্দ চোখে দেখাও বড় সৌভাগ্যের বিষয়।

উনাকে একটু ধাতস্থ হতে দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি,’ ভাই নিশ্চয় খুব খুশি এবার নিনা ভাবী কেমন যেন লাজুক বউ হয়ে যান। আস্তে করে বলেন,’ ওকে এখনো বলিনি। আমার খুব লজ্জা লাগছে। তুমি একটু জানাবে আমার হয়ে?’ আমি উনার হাত ধরে বলি,’ এতো আমার সৌভাগ্য। এমন খুশির খবর আমি আমার জীবনে কাউকে দিইনি।’ আসলেই এটা আজিজ ভাইয়ের জন্য অনেক অনেক খুশির খবর ছিল। আমার কাছ থেকে শোনার পর উনার কিছুক্ষণ লাগলো ঘটনা বুঝতে। তারপর দৌড়ে ভাবীর কাছে গিয়ে বললেন,’ এ সত্যি নিনা?এই অবেলায় এসে আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে চাইলেন! আমাদের বাচ্চা হবে? আমাদের?’ নিনা ভাবী কিশোরী বউয়ের মতো লাজুক হেসে মাথা উপর নিচ করলেন। আজিজ ভাই আমাকে অগ্রাহ্য করে ভাবীকে সবেগে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন। আমি দ্রুত সরে আসলাম নিজের ঘরে।

এরপরের দিনগুলো ভাবীর জন্য ছিল স্বপ্নের মত। এই খবরে উনার কলেজের সব ছাত্র-ছাত্রী ফুল নিয়ে এসেছিল তাদের প্রিয় ম্যামের সাথে দেখা করতে। উনার সহকর্মীরাও খুব খুশি। কৃত্রিম দেখানো খুশি না, হৃদয় থেকেই এই সুহৃদের জন্য তারা মঙ্গল কামনা করছেন। কলেজ থেকে ছুটি দিলো উনাকে যাতে ভালো মতো বিশ্রাম নিতে পারেন। কিন্তু নিনা ভাবী বিশ্রাম নেন না। প্রায় প্রতিদিন মার্কেট যাচ্ছেন। বাচ্চার জন্য এটা ওটা কিনে আনছেন। ঘর গোছাচ্ছেন। যে আসছে তার সাথেই ছবি তুলছেন। বাঁধিয়ে ঘরে সাজাচ্ছেন।

তবে আজিজ ভাই রাগ করেন। বলেন ‘ নিনা তুমি কিন্তু কথা শুনছো না। ডাক্তার বলেছে তোমার যে বয়স এই বয়সে মা হওয়া অনেক ঝুঁকির ব্যাপার। খুব সাবধানে থাকতে হবে। এতো দৌড়াদৌড়ি তোমার সহ্য হবে না। আমার কথা শোনো নিনা ভাবি শুধু হাসেন। তারপর স্বামীর কাছ ঘেঁষে বসে বলেন,’ দেখেছো পাঁচ মাসেই আমার চুল কেমন কোমর ছুঁয়ে যাচ্ছে। দেখো,দেখো। হাত দিয়ে দেখো।’ মা হতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হয়। এসব নিয়ে তোমার চিন্তা করা লাগবে না।’ আজিজ ভাইয়ের চিন্তা কিন্তু কমে না। আমার সাথে দেখা হলেই বলেন,’ তুমি একটু ওকে বুঝিয়ে বলো তো আপু। তোমার কথা হয়তো শুনবে।’

আমি বলতে গেলে উনি হেসে বলেন,’ সব গোছগাছ করে না রাখলে তোমার ভাই একা একা তখন কিছু করতে পারবে না। বাচ্চার কষ্ট হবে। ‘ আমি অবাক হয়ে বলি,’ ভাই একা করবেন কেন?’ উনি হেসে বলেন,’ বাহ্ যে তখন কি আমি কিছু করতে পারবো? বাসায় তো আর কোনো লোকজনও নেই।তাকেই তো করতে হবে।’ উনার এতো পরিপাটি করে সবকিছু গোছানো কেন যেন আমার ভালো লাগে না। তবে উনি উনার কাজে কোনো রকম ছাড় দেন না। কেন যেন খুব তাড়াহুড়া। শেষের দিকে ভাবি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিছানা থেকে একা একা নামতেও পারেন না। পুরো শরীরে পানি চলে এসেছে। তবে স্বস্তির কথা হলো পেটের বাচ্চাটা ভালো আছে। এই একটা খবরেই উনি নিজেকে চাঙ্গা রাখেন।

নিয়মিত ডাক্তার চেকাপ করেন। বাচ্চা আছে উল্টা পজিশনে। নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না। তাছাড়া এই বয়সে এসে নিনা ভাবী এত বড় ধকল সামলাতেও পারবেন না। সিজারিয়ান অনেক মধ্যে দিয়েই বাচ্চা আসবে এটা অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু আট মাসের মাথায় ডাক্তার চেকাপ করে বললো ‘অপারেশন দ্রুত করে ফেলতে হবে। অবস্থা খুব একটা ভালো লাগছে না আমার।’ তা খুব দ্রুতই ব্যবস্থা করা হলো। আজিজ ভাই চোখমুখ শক্ত করে ডাক্তারকে বললেন,’ আপনারা যেকোনো পরিস্থিতিতে আমার স্ত্রীকে সারভাইভ করার চেষ্টা করবেন। তারপর সন্তান…।’ বলেই দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়ে। পুরো হাসপাতাল দুই পরিবারের নিকট আত্মীয়ে ভরে গেছে। নিনা ভাবির কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা এসে উৎকণ্ঠিত মুখে বসে আছে। সবার দুহাত প্রার্থনা ভঙ্গিতে তোলা।

অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছিল সকাল নয়টায়। নয়টা পঞ্চাশে খবর এলো ফুটফুটে এক ছেলে হয়েছে নিনা ভাবির। তার আধা ঘন্টা পর আজিজ ভাইকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল ডাক্তাররা। তার ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় পুরুষ কন্ঠের গগনবিদারী চিৎকার করে কান্নার শব্দ। আমরা কেউ ভিতরে ঢুকতে পারছি না। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিইবা করতে পারি? ঘড়ির সময় বেশি হয়নি। সর্বোচ্চ বিশ মিনিট। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে আমরা এই মৃত্যুপূরীতে বসে আছি। এ অপেক্ষার কোনো শেষ নেই।

তবে শেষ হলো এক সময় অপেক্ষার। ছোট্ট গোলাপী তোয়ালে জড়ানো বাচ্চাটা বুকে চেপে ধরে বের হয়ে আসলেন আজিজ ভাই। তার মিনিট দশেক পরে সাদা কাপড়ে ঢাকা নিনা ভাবী। যার এক মাথা এলো চুল সাদা কাপড়ের নিচ দিয়ে বেয়ে মাটি ছুঁতে চাচ্ছে। আর তার সন্তান? তাৎস্বরে চিৎকার করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সাদা কাপড়টা সরিয়ে আমি নিনা ভাবির চেহারার দিকে তাকালাম, মনে হলো যেন সেখানে একটুকরো হাসি লেগে আছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত