চারুলতা

চারুলতা

চারুর যেদিন জন্ম হল সেদিন তার মা মারা গেল। জন্মে বোধ করি কারো পাপ নেই। একেকটি জন্ম, পৃথিবীতে একেকটি শিশুর আগমণ, নতুন প্রাণের সৃষ্টির মাঝে নেই কোন কালিমা। নেই কোন কলুষতা। তবুও চারুর জন্মের পর খুশি হল না কেউ। মৃত্যুর আগে চারুর মা চারুর নাম রাখলেন “চারুলতা।” সদ্য ভূমিষ্ট কন্যার মুখখানি দেখে চারুর মা স্মিত হাসলেন। চারুর গায়ের রং হয়েছে ধবধবে ফর্সা। চারুকে নিয়ে তার একটা দুশ্চিন্তা ছিল। সে দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। এখন তিনি নিশ্চিন্তে মরতে পারবেন। চারুর মা চোক বুজে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন, হে ঠাকুর, তুমি আমার মেয়েটাকে চরম দুঃখী করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছ। তোমার কাছেই মেয়েটাকে রেখে যাচ্ছি। তুমি তাকে দেখে রেখো। চারুর মায়ের এ প্রার্থনা ঈশ্বর শুনতে পেয়েছিল কিনা জানিনা, তবে তাতে চারুর কপালের লেখনীর হেরফের বোধহয় হয়নি। চারু জনমদুঃখী ছিল, জনমদুঃখীই রয়ে গেল।

চারুর জন্মের পর চারুকে নিয়ে তার বারার কোন মাথাব্যথা ছিল না। এখনো খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তবে চারুর প্রতি তিনি যে নিষ্টুর আচরণ করেছেন তাও নয়। তিনি চাইলেই স্ত্রী বিয়োগের পর আবার বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ নিয়ে চারুর বাবা হরিদাশ নিজেও সন্দিহান। কেন তিনি বিয়ে করেননি তা নিয়ে তিনিও রহস্যের মধ্যে আছেন। এটা কি চিরদুঃখী মেয়ের প্রতি দায়িত্ব নাকি মৃত স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা তা হরিদাশ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি যে মৃত স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন তা নয়। আবার মা মরা চারু সৎ মায়ের রোষানলে পড়বে বলে তিনি আর বিয়ে করেননি ব্যাপারটা তাও নয়। পোড়ামুখী চারুর খবর তিনি কখনোই রাখেন না। হরিদাশ বাড়ি এলে কদাচিৎ বাপ মেয়ের দেখা হয়। কাজ না থাকলে কোন কথাও হয় না। বাপ মেয়ের মধ্যকার যে টান তাও চারু আর হরিদাশের মধ্যে নেই। তার আর চারুর এই দূরত্ব হাজার কোটি মাইল নয়, হাজার কোটি আলোকবর্ষের সমান। এ যেন এক বাড়িতে থাকা দুই জগতের দু’টি মানুষের এক অভিমানের গল্পগাঁথা। মানবজীবন কতইনা বিচিত্র, কতইনা অদ্ভুত!

চারু বড় হচ্ছে। বড় হচ্ছে জগতের সমস্ত দুঃখকে ভর করে। চারুর ঠাকুরমা তার নাম রেখেছে মুখপুড়ি। জেঠীমা নাম দিয়েছে পোড়ামুখী। ছোটকা ডাকে অভাগী বলে। যার নামের মাঝে এত দুঃখ, সেই মেয়েটা বাস্তব জগতে কতটা দুঃখী তা নিয়ে সংশয় আছে সবার। জগতের সব দুঃখ, বেদনা আর যাতনার মাঝে বেড়ে উঠলেও চারু তার নিজের জগতে সীমাহীন সুখী। তাই চারুর বেড়ে ওঠা নিয়ে কাওকে তেমন চিন্তিত হতে দেখা যায়নি। সে বেড়ে উঠেছে নিজের মত করে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই সাদাকালোর মিশ্রণ।

সাদা যদি হয় সুখ, দুঃখ সেখানে কালো। পার্থিব এই জগতে মানুষ যখন সাদা কিংবা কালোর মাঝে কিসের পাল্লা ভারী তার হিসাব করতে ব্যস্ত সেখানে চারুর জগত রঙিন। তাই সে জগতে সাদা কালোর মত সুখ-দুঃখের হিসাব-নিকাশের যন্ত্রণা নেই। চারু কখনো ভেবে দেখেনি সে সুখী কিংবা কিনা। চারুর জগত এক অপার্থিব জগত। সে জগতে পিছুটান নেই। নেই সুখ আর দুঃখের জটিলতা। চারুর জগত রহস্যময়। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার যেমন পুরো পৃথিবী জয় করেও শূন্য হাতে পৃথিবী ছাড়ার জন্য মৃত্যুর আগে আক্ষেপ করেছেন তেমন আক্ষেপ চারুর নেই। চারু সুখী। চরম সুখী। দুঃখের মাঝে চারু সুখী। দুঃখকে সাথী করে সুখী হওয়া আদতে সহজ কিছু নয়। জগতের অন্যতম কঠিন একটি কাজ।

দেখতে দেখেতে চারু কবে যে বড় হয়ে উঠল তা কেউ টেরই পেল না। এইতো সেদিন জন্ম নেওয়া মা মরা মেয়েটা আজ পনেরো বছরের কিশোরী। মানুষের সময় খুব দ্রুত কাটে। মানুষের আয়ু মনে হয় প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। একটা মানুষ ক’বছরই বা বাঁচে? ষাট, সত্তর, আশি। খুব বেশি হলে একশ। হাতেগোনা কিছু মানুষই কেবল শ’র কোটা পেরোয়। তবু সকলের বেঁচে থাকার কত আকুতি। খুব কম মানুষই নিজের জীবদ্দশায় তৃপ্ত হয়। তারা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। তাদের চাহিদার তালিকা ফুরিয়ে যায়। জগতের কাছে তাদের আর কিছু চাওয়ার থাকে না। এমন মানুষের অনেক প্রয়োজন। কিন্ত্য এই শ্রেণির মানুষের অভাব জগতে সবচেয়ে বেশি। চারুর এখন দিন কাটে টো টো করে ঘুরে বেরিয়ে। এথায় হেথায় না ঘুরলে কি তার চলে! এ যেন সাক্ষাত এক মুক্ত বিহঙ্গ। উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। ভোর হলে বেরিয়ে পড়ছে নীড় ছেড়ে। আবার সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরবে। সত্যিই চারু যেন এক ডানাছাড়া পাখি। ডানা মেলে ছুটছে দিগ্বিদিক।

সকালে খেয়েদেয়ে ঘর ছাড়ে চারু। সারাদিন মাঠ বন দাঁপিয়ে বেড়ায়। কোন গাছে ক’টা ফুল ফুটেছে, কোন গাছের জাম খেতে মিষ্টি, কোন বাড়ির গাছের আম কাঁচামিঠে তা মুখস্ত চারুর। গাছেরাও যে চেনে তাকে। চারু হয়ত গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছে, তখন টুক করে একটা আম পড়বে তার সামনে। চারু তা কুড়িয়ে নেবে। তারপর গাছের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলবে, “ঝড় নেই, বাতাস নেই, তবু আম পড়ল? আমার জন্য ফেললি বুঝি?” মৃদু বাতাসে গাছের পাতা নড়ে। যেন গাছেরাও সায় দেয় চারুর কথায়। চারু ভাবে, বাহ! বেশ মজা তো! গাছও আমার কথা বোঝে।

আবার কখনো চারু মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, তখন সাদা গাঁইটা চারুকে দেখে হাম্বা বলে ডাকে। চারু গাঁইটার নাম রেখেছে ‘ধবলী’ চারু ধবলীর কাছে যায়। গলায় হাত বুলিয়ে আদর করে। ধবলী আদর পেয়ে চোখ বুজে থাকে। এই অবলা নিষ্পাপ জীবও চারুর ভাষা বুঝতে পারে। ধবলী বোঝে এই মেয়েটার কাছে তার কোন ক্ষতির আশংকা নেই। কারণ এই মেয়েটির জন্ম হয়েছে জমগতের সমস্ত মমতা নিয়ে। চারুর জগত নিঃস্বার্থ মায়া মমতায় পরিপূর্ণ।

প্রতিদিন বাড়ি ফিরে ঠাকুরামার কাছে বকা খায় চারু। চারুকে দেখেই তিনি চেঁচিয়ে বলেন, “হ্যাঁ রে মুখপুড়ি! তোর কি আক্কেল বলতে কিছু নেই? অমন সোনা বরণ অঙ্গ তুই রোদ লাগিয়ে লাগিয়ে নষ্ট কচ্ছিস! আর সারাদিন পাড়া ঘুরে টো টো করে নেচেকুঁদে এলি। এমনধারা মেয়েমানুষ দেখিনি বাপু! অমন করলে তোকে কে বে করবে শুনি”? “আমি তো বে করবোনি।” চারু ঈষৎ হেসে জবাব দেয়। তা শুনে ঠাকুরমা বলেন, দাঁড়া দেখাচ্ছি, তোর বাপকে বলে আজই তোর বে’র ব্যবস্থা করছি। মাকে তো খেয়েছিস। এবার আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দে”! এমন কথা শুনতে শুনতে চারুর গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই আজকাল চারু এসব নিয়ে চিন্তিত হয় না।

চারুর বাবা হরিদাশ আছেন নিজের মত। ব্যাবসার দিকে লক্ষ্য রাখতে গিয়ে মেয়ের দিকে লক্ষ্য করার সময় কখনো হয়ে ওঠেনি তার। চারু বড় হয়েছে পিতৃস্নেহ ছাড়াই। মাতৃস্নেহ কাকে বলে, চারু তা জানেই না। তার উপর তার প্রতি পিতার অবহেলা মাঝে মাঝেই চারুকে অভিমানী করে তোলে। কিন্তু পর মুহূর্তে যখন চারু আকাশের মানে চায় তখন তার দুঃখ আকাশে ছড়িয়ে যায়! আকাশ বলে, আমি তোর দুঃখ নিলাম। তুই তোর দুঃখকে আমার বুকে ছড়িয়ে দে। দেখবি তোর কোন দুঃখ নেই। কোন যন্ত্রণা নেই। তখন চারুর মন এক মুহূর্তে ভাল হয়ে যায়। চারু মুচকি হাসে। সে হাসিতে মুক্তো ঝরে। সে মুক্তোর দাম খাঁটি হিরার চেয়েও দামী।

চারুর প্রতদিনকার কাজ হল খেয়েদেয়ে পাড়া ঘুরতে বেরোনো। কিন্তু একদিন চারুর ঠাকুরমা চারুকে বাইরে যেতে নিষেধ করলেন। চারু প্রতিবাদ করতে গিয়েও করল না। চলে গেল ঘরের ভেতর। খানিক পর চারুর ঠাকুরমা চারুকে নিজ হাতে স্নান করিয়ে দিলেন। তারপর নতুন শাড়ি পরিয়ে দিলেন। চারুর কাকের বাসা হয়ে থাকা চুলগুলোতে সময় নিয়ে তেল দিলেন। তারপর সুন্দর করে বিনুনি দিলেন। তারপর চারুর চোখে কাজল দিলেন। তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চারু নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করল। এত রূপ নিয়ে জন্মেছে চারু! ঈশ্বর যেন তাকে দু’হাত ভরে রূপ দিয়েছেন। নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছে না চারু। এত মায়া, এত স্নিগ্ধতা, এত ঐশ্বর্য লুকিয়ে ছিল তার মুখবয়বে! তার চোখ দু’টো যেন ম্যারিয়ানা ট্রাঞ্চের চেয়েও গভীর। তাতে যেন জল টলটল করছে। আহা! সে চোখ কতইনা সুন্দর! কতইনা গভীর। বিকালবেলা চারুদের বাড়িতে অনেক অতিথি এল। তারা সবাই বৈঠকখানায় বসলেন। জেঠা জেঠিমা তাদের আপ্যায়ন করলেন। এককসময় চারুকে নিয়ে যাওয়া হল তাদের সামনে। চারু আধহাত ঘোমটা দিয়ে আলুথালু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর শুরু হল প্রশ্নবাণ।

“হ্যাঁ গো মেয়ে, তুমি আচার করতে পারো”?
“রান্না করতে পারো”?
“সুক্তোতে কাঁচালঙ্কা দেয় নাকি শুকনো লঙ্কা”?
“ঘুঁটে দিতে পারো তো”?
“পাঁচালী পড়তে পারো তো? পুজো আচ্চা কিছু শিখেছো”?

এমন আরোও কতশত প্রশ্ন। চারু ভয় পেয়ে যায়। তার মনে পড়ে, পাশের বাড়ির নির্মলাদিকেও এমন প্রশ্ন করেছিল সবাই। এর ক’দিন পর তার বে হয়ে যায়। তারও কি বে হবে? নির্মলাদি’র মত তাকেও পরতে হবে শাঁখা-সিঁদুর? হাতে থাকবে নোয়া! স্বামীর মঙ্গলের জন্য তাকেও রাখতে হবে নির্জলা উপোস! এইটুকুন শরীর নিয়ে সে কি করে এতসব করবে? চারুর যে কেবল দিগ্বিদিক ছুটতে ইচ্ছা করে। তার বে হয়ে গেলে সে পাড়া গাঁয়ে ছুটবে কেমন করে? চারু ভেবে পায় না। তার বুক ফেঁটে কান্না আসে। সবার উপর তার অভিমাণ হয়। ধরার মাঝে নিয়মগুলো এত নিষ্টুর কেন?

শ্রাবণ মাসে চারুর বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আগেরদিন সবাই মিলে চারুর গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিল। চারুর সোনাবরণ অঙ্গ আরো সোনালী হয়ে উঠল। পরদিন একেবারে সাতপাক ঘুরে বিয়ে! কখন যে চারুর সিঁথিতে সিঁদুর উঠল তা চারু টেরই পেল না। তার পাশেই বসে আছে স্বামীদেবতা! একজন অজানা, অচেনা মানুষ। চারুর বয়েসের প্রায় দ্বিগুণ বয়স লোকটার। এই লোকটাকে নিয়েই তাহলে চারুকে সারাজীবন কাটাতে হবে! কেন? যে লোকটাকে সে আজকের আগে দেখেনি, সে লোকটা না খেলে তাকেও না খেয়ে বসে থাকতে হবে। আগে স্বামীদেবতা খাবেন তারপর তাকে খেতে হবে। এ কি আচার? নাকি অনাচার! চারু ভাবে, শুধু ভাবে। কিন্তু কোন উত্তর পায় না।

বিয়ের পর চারু চলল শ্বশুরবাড়িতে। নিজের গাঁ ছেড়ে নতুন এক গাঁয়ে। এক অপরিচিত জগতে। শ্বশুরবাড়ি পৌঁছার পর চারুর শ্বাশুড়ি বরন করে ঘরে তুললেন নতুন বৌমাকে। পড়শিরা এসে ভীড় করল নতুন বৌ দেখতে। বধূবেশি চারুর রূপ দেখে সকলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই বলছে, চারুর মা লক্ষ্ণীর মত রূপ। এবার দেবী স্বরসতীর মত গূণবতী হলে হয়। চিরচঞ্চলা চারু বিয়ের পর লজ্জাবতী লতিকা হয়ে চুপটি করে বসে রইল। ননদরা চারুকে ঘিরে ধরল। কেউ তার গয়না দেখছে, কেউ বা তার চুল কত লম্বা তা দেখতে ব্যস্ত। এমন সুন্দর বৌদি পেয়ে তারাও সুখী। চারুর শ্বশুরবাড়িতে আজ খুশির বন্যা। একমাত্র ছেলে এমন রূপসী বৌ এনে ঘরে তুলেছে। বাড়িতে পুরো উৎসব বেঁধে গেল।

রাত গভীর হলে চারুকে দিয়ে আসা হল ফুলশয্যার ঘরে। চারু ভীত সন্ত্রস্ত হরিণীর মত বসে রইল খাটের মাঝখানে। পুরো ঘরটা ফুল দিয়ে সাজানো। খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু চারুর মনে তখন ভয়। অজানা আশংকায় তার বুক দুরুদুরু করছে। ঠাকুরমা অনেক কিছুই চারুকে শিখিয়ে দিয়েছেন। নির্মলাদিও অনেক কিছু শিখিয়েছে। সেসব শুনে চারু কত যে লজ্জা পেয়েছিল! নারী পুরুষের সম্পর্ক তবে এমন হয়? এ কেমন সম্পর্ক? চারুর কিশোরী মন ভেবে কূল পায় না। এক অজানা শিহরণে চারু বারবার কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। চারু অপেক্ষা করে। কিসের অপেক্ষা সে তা জানে না। এ অপেক্ষা কি স্বামীদেবতার কাছে নিজেকে সপে দেওয়ার জন্য? নাকি নিজের নিয়তিকে গ্রহণ করার অপেক্ষা? চারুর পৃথিবীতে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।

অনেক চিন্তা চারুর মনে। সেসব নিয়েই ভাবছিল চারু। হঠাৎ দরজায় শব্দ পেয়ে চারু বাস্তবে ফিরল। চারুর স্বামীদেবতার আগমণ হয়েছে। চারুকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ফুলশয্যার ঘরে তার স্বামীদেবতা ঢুকতেই যেন সে তাকে প্রণাম করে। এটা নাকি স্ত্রীর কর্তব্য। কিন্তু চারু সে কর্তব্য ভুলে যায়। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চারু এর আগে কখনো নিজ বাড়ি ছেড়ে থাকেনি। এই প্রথম তাকে থাকতে হচ্ছে। তাও আবার অজানা অচেনা এক পুরুষের সাথে। যদিও তাদের শাস্ত্রমতে বিয়ে হয়েছে। এ বন্ধন নাকি সাত জনমের বন্ধন! কিন্তু চারুর মনে হয় এ বন্ধন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। তাকে পরাধীন করে দিয়েছে। তার কাঁধে এনে ফেলেছে একটা সংসারের বোঝা। সে বোঝা অনেক ভারী। অনেক!

ঘরে ঢুকেই চারুর স্বামীদেবতা চারুর কাছে গেল। চারুর ঘোমটা তুলল। চারু খানিক সরে বসল। তার মনে হলে সে যেন লজ্জায় ভয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে। তখন স্বামীদেবতা বলে উঠল, “আমি না তোমার স্বামী! আমার কাছে আবার কিসের লজ্জা”? তারপর স্বামীত্বের দাবী নিয়ে চারুকে চেপে ধরল। এরপর যা করল তাকে বলৎকার বললে ভুল হবে। এ হল বৈধ বলৎকার! নিষিদ্ধ তবে উপভোগ্য। সমাজের নিয়ম দেখে বড়ই আশ্চর্য হতে হয়।  দশ মাস পর। আজ থেকে ষোল বছর আগে এমনই এক দিনে চারুর জন্ম হয়েছিল। চারুর মা কাতরাচ্ছিল যন্ত্রণায়। আজ চারু কাতরাচ্ছে। কাতরাচ্ছে অসহ্য এক যন্ত্রণায়। প্রত্যেক মাকে সহ্য করতে হয় এ যন্ত্রণা। ষোল বছরের চারু ছটফট করছে। চারুর পানি ভেঙেছে। একটু পরেই জন্ম হবে এক মানব শিশুর। তার আগ পর্যন্ত চারুকে সইতে হবে এমন এক নরক যন্ত্রণা যা পৃথিবীতেই ভোগ করা যায়!

সদ্যজাত শিশুর চিৎকারে ভরে গেছে ঘরটা। শিশুটি চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিচ্ছে তোমরা সবাই দেখ। আমি এসেছি। চারু তখন এক ঘোর লাগা অবস্থায় আছে। তার মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসছে এক শিশুর চিৎকার। তাহলে তার সন্তান পৃথিবীতে এসেছে! চারুর তার মায়ের কথা মনে পড়ল। চারু অস্ফুষ্ট স্বরে বলল, “মা, মাগো! আমি আসছি। আসছি তোমার কাছে”।

তখন চারুদের গাঁয়ের সেই গাঁই ধবলীকে দেখলে বোঝা যেত ধবলী কাঁদছে। কার জন্য কাঁদছে এই অবলা জীবটা? কিংবা সেই আমগাছটা, আজ যেন চুপ মেরে গেছে। হয়ত ফিসফিসিয়ে বলছে, “কে খাবে আমার কাঁচামিঠে আমগুলো? কে কুড়িয়ে নেবে আমার তলা থেকে। দিব্যচক্ষু থাকলে হয়ত দেখা যেত সেই গাঁইটা আর সেই আমগাছটা কাউকে খুঁজছে। সত্যিই কি খুঁজছে? হয়তবা! এ জগত সত্যিই রহস্যময়।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত