স্টেশনের বেঞ্চে বসে ঘড়ি দেখলো অর্পিতা , পুরো পাঁচ টা বেজে ছত্রিশ মিনিট । সায়ম বলেছিল সাড়ে পাঁচ টায় পৌঁছে যাবে । নির্ঘাত ট্রাফিকে আটকে গেছে । নাহ , আজই একটা ফায়সালা হওয়া দরকার । এভাবে টানাপোড়েন নিয়ে বাঁচা যায়না । গত পনেরদিন ধরেই ভেবেছে সম্পর্কটা শেষ করার কিন্তু পরক্ষনেই নিজের কাছে হেরে গেছে । কিন্তু গত দুদিনের অভিজ্ঞতা অর্পিতার মানসিক অবস্থান কে আড়াআড়ি ভাবে বদলে দিতে বাধ্য করেছে । পরশু দুপুর থেকেই হঠাৎ মাথা টা ঝিমঝিম করছিল , সে জানে প্রায়ই জ্বর হয় , বিশেষ করে পিরিয়ডের দিন গুলোতে প্রায় গায়ে গায়ে জ্বর আসে । কিন্তু সন্ধ্যা থেকে জ্বর এতটা জাঁকিয়ে বসবে মোটেও ভাবতে পারেনি । অরিন্দমের সেদিন অফিস শেষে এক কলিগের বাড়িতে ম্যারেজ অ্যানিভারসারির পার্টি ছিল , অর্পিতা জানতো দেরি হবে অরিন্দমের বাড়ি ফিরতে । রান্না বান্না শেষ করে কাজের মেয়ে চলেগেলে , অর্পিতা তাড়াতাড়ি শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে রাতের খাবার দিয়ে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়েছিল ।
বাড়িতে প্যারাসিটামল রেখেছে , একটা খেয়ে শুয়ে পড়েছিল । মাথাটা বেশ ভারী ভারী লাগছিল ,সোফায় বসে টিভির রিমোটটা হাতে নিয়ে কখন যেন ঘুম এসে গেছিল । তারপর অনেক রাতে অরিন্দম বাড়ি ফিরে সোফার উপর অর্পিতা কে শুয়ে থাকতে দেখে গায়ে হাত দিতেই বুঝতে পারে সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । এত রাতে বাড়ির হাউস ফিজিসিয়ান কে কল করে ডেকে আনা অসম্ভব ব্যাপার , আর এদিকে অর্পিতার তীব্র মাথা যন্ত্রনায় চোখ খুলে তাকানোর মতো ও শক্তি ছিলনা সারা শরীরে ।কিন্তু তক্ষুনি অর্পিতাকে কোলে তুলে নিয়ে নিচে এসে নিজেই ড্রাইভ করে আরোগ্যনিকেতন নার্সিংহোমে চলে গেছিল ।
তারপর ডাক্তার দেখিয়ে অনেক রাতে প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরে অর্পিতা কে খাটে শুইয়ে দিয়েছিল । ভোর বেলা ঘুম ভাঙার পর অর্পিতা দেখে পায়ের কাছে একটা চেয়ারে বসে অরিন্দম ঘুমিয়ে পড়েছে সেই অফিস যাওয়া ড্রেস পরেই। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর মানুষ টা বিশ্রাম পায়নি ।নিজের উপর বিতৃষ্ণা হলো । এই মানুষ টা অদ্ভুত এক মানুষ । কোন অভিযোগ নেই কোন চাওয়া পাওয়া নেই । প্রথম দিনই ফুলশয্যার রাতে সরাসরি অরিন্দম কে বলে দিয়েছিল সে অন্য কাউকে ভালোবাসে তাই অন্যঘরে যেন ঘুমায় । কিন্তু ফুলশয্যার রাতে বৌ কে ছেড়ে অন্যঘরে ঘুমালে তার যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা ভেবেই অরিন্দম কয়েক মিনিট নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সে কোন ভাবেই এমন একটা সিচুয়েশনের জন্য তৈরি ছিল না । তবে সেদিন রাতে কোন কথা না বলে সেই রুমের এককোনে ঘুমিয়ে পড়ে । উত্তর টা পেয়েছিল একদিন পরে ।
পরপর দুদিনের মতো সেদিন রাতেও খাওয়া দাওয়া করে অর্পিতা ঘরে ঢুকে দেখে অরিন্দম ঘরের এক কোনে শুয়ে পড়েছে একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে । অর্পিতা বিছানায় এসে শুয়ে সায়মের মেসেজ গুলোর রিপ্লাই করছিল হঠাৎ পাশ ফিরে অরিন্দম বলেছিল , “বিয়ে করার ইচ্ছে না থাকলে বা সরাসরি প্রেমিকের কথা বাড়িতে বলতে না পারলে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে পারতে । তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস তুলে বলেছিল , “তোমার কোন অধিকার নেই অপরের জীবন-সংসার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার। অর্পিতা কোন জবাব দিতে পারেনি । আসলে এই কদিনে এমনি তে অরিন্দমের চোখের দিকে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেনা । অদ্ভুত শান্ত নির্লিপ্ত কিন্তু গভীর দুটি চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন অবশ হয়ে যায় সারা শরীর । কোনরকমে বলেছিল , “প্লিজ কয়েকমাস সময় দাও আমি ডিভোর্স করে নেব । ”
পাঁচটা পঞ্চান্ন এর ব্যারাকপুর লোকাল টা চলে গেল । অর্পিতা ভিড় ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দেখছিল । অধিকাংশই অফিস ফেরত দৈনন্দিন যাত্রী । অর্পিতা দের পাড়ায় সায়মের মামার বাড়ি । অর্পিতা প্রায় দেখতো একটা রোগাটে টাইপের ছেলে রোজ সাইকেলে করে যাওয়ার সময় ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকতো । পরে অর্পিতা জেনেছিল পাশের বাড়ি তে মামা ঘর । তারপর একদিন সরস্বতী পূজার ফাংশনে অর্পিতা গান গেয়ে স্টেজের নিচে নামতে ছেলেটা এসে নিজে থেকে আলাপ করলো । প্রথম দিকে পাত্তা না দিলেও কিছুদিন পর অর্পিতা ভেসে গেল সায়মের প্রেমে । দারুন গিটার বাজাতো সায়ম । আর সায়মের মামাতো বোন কুহুর দৌলতে অজস্রদিন কূহূদের ছাদে সায়মের গিটার বাজানোর সাথে অর্পিতার গলার আওয়াজ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল । প্রজাপতির ইচ্ছে না থাকলেও কামদেবের হয়তো ইচ্ছে ছিল তাই দুটো মনের সাথে শরীরের মিলন হতে বেশি সময় লাগেনি ।
পূজার ছুটিতে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে কতবার দীঘা পুরী তে চলে গেছে । সমুদ্রের নীল জল রাশির মেদুর গর্জন আর পাথরের ওপর বসে গিটারের সুর একাত্ম হয়ে যেত দুটো মন দুটো শরীর । গল্প কিন্তু অনেক বাকি । অর্পিতার বাবা দেবশংকর চ্যাটার্জি প্রচন্ড রক্ষনশীল মানুষ । রাশভারী বাবার সামনে সায়মের কথা বলা একদম অসম্ভব ব্যাপার ছিল অর্পিতার । তবুও মা কে একবার বলেছিল , বাবার মর্জির বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা মায়ের ও ছিলনা । কলেজ জীবনের বন্ধুর ছেলে -বড় চাকুরে -সৎ পাত্র -অবশ্যই পালটি ঘর অরিন্দম ব্যানার্জির সাথে দেখাশোনা করে বিয়ে হয়ে গেল । এদিকে সায়ম সদ্য একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে জব পেয়ে ব্যাঙ্গালুরু তে । তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা সদ্য চাকরি পেয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতা আসার । তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে তার মা বাবা কে পাঠালো দেবশংকর বাবুর কাছে অর্পিতার সম্বন্ধ নিয়ে ।
ঘোষ পদবী শুনেই দেবশংকর বাবু পত্রপাঠ বিদায় করলেন । অর্পিতা একবার ভেবেছিল বাড়ি থেকে পালিয়ে বেঙ্গালুরু চলে যাবে , কিন্তু ততদিনে বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে বিলি হয়েগেছে , মায়ের চাপে এবং কিছুটা একমাত্র সন্তান হিসেবে বাবার সামাজিক সম্মান টুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে পারলো না । এদিকে সায়মের বাবা মা ও কম যাননা । পুত্রের মুখে হাসি ফোটাতে জোর কদমে সম্বন্ধ দেখতে শুরু করলেন ।এবং পাত্রী দেখে পুত্রকে বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌমা আনার চেষ্টা করতে শুরু করলেন । বাড়ির চাপে অসহায় যুগল সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে করবে কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস পরেই দুজনে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করে আবার নতুন করে শুরু করবে । এবং যথারীতি বিয়ের মাস দুয়েক পরেই সায়ম বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতায় ট্রান্সফার করিয়ে আনলো নিজেকে ।
হঠাৎ দূরে দেখতে পেল সায়ম হনহনিয়ে এগিয়ে আসছে । আরো স্মার্ট লাগছে , চুলগুলো সোনালী কালার করা । প্রায় তিন মাস পর দেখা । যদিও রোজ নিয়মিত ফোনে কথা হয় । বিয়ের পর বাপের বাড়ি গিয়ে শেষবার ঘন্টাখানেক পাশাপাশি কাটিয়েছিল । ধ্বস্ত -বিধ্বস্ত সায়মকে বুকে আঁকড়ে নিয়েছিল অর্পিতা । অর্পিতা তাকে সেদিন বলেছিল কিছুদিন অপেক্ষা করতে তারমধ্যে অর্পিতা গুছিয়ে নেবে । কিন্তু সে কি জানতো তার ভাগ্য অন্যদিকে বইতে শুরু করবে । যতবার নিজেকে শক্ত করেছে অরিন্দমকে বলবে ডিভোর্সের ব্যাপারটা ততবারই সামনে গিয়ে বলে উঠতে পারেনি । চোখের সামনে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর মুখ টা ভেসে ওঠে ।
তাঁরা জানেন না অরিন্দম আর অর্পিতার মাঝের অলিখিত দেওয়াল টা । অভিজিত বাবু মানে অর্পিতার শ্বশুর মা বলতে অজ্ঞান । মাস দুই আগে রান্নাঘরে বঁটি দিয়ে সবজি কাটতে গিয়ে অর্পিতা পুরো বুড়ো আঙ্গুল টা কেটে ফেলেছিল , তারপরের অবস্থা তথৈবচ । বাড়িতে অরিন্দম ছিলনা । অর্পিতা অবাক হয়ে দেখেছিল ডাক্তার -ডেটল -নার্সিংহোম করে কিভাবে দুই বুড়োবুড়ি অস্থির হয়েছিলেন । সারা রাত ঘুমোতে পারেনি সেদিন অর্পিতা । হাজার প্রশ্নের ভিড়ে হারিয়ে গেছিল নিজে । বারবার ভাবছিল কিকরে উনারা সহ্য করবেন যখন অর্পিতা ডিভোর্স চাইবে । ওদের তো কোন দোষ নেই । দোষ যদি হয় সেটা অর্পিতার নিজের , অর্পিতার একগুঁয়ে বাবার । আর অন্যদিকে অরিন্দম এক অন্য পৃথিবীর মানুষ । কোন অভিযোগ নেই অর্পিতার উপর । নিয়ম করে চকোলেট -আইস ক্রিম নিয়ে আসতো অর্পিতার জন্য । শ্বশুর বাড়িতে কে যেন অরিন্দমকে বলেছিল চকোলেট অর্পিতা অসম্ভব ভালোবাসে ।
কোন এক অদৃশ্য শক্তির টানে অর্পিতা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল । দুপুর বেলা অরিন্দম যখন অফিসে , শ্বশুর দুপুরের খাওয়া সেরে দিবা নিদ্রায় আর শ্বাশুড়ী বসে বসে টিভি দেখতে ব্যস্ত , প্রতিদিনের মতো সায়ম ফোন করে তার পাঁচালী শোনাতে থাকে -কি করে বৌকে সে মানসিক আঘাত দিয়ে বাধ্য করাচ্ছে ডিভোর্স দিতে , অর্পিতা হুম হাঁ করতো , তারপর এক সময় ফোন রেখে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচের নিস্তরঙ্গ শহর টা কে দেখতো কখনো বা হ্যাঙ্গারে ঝোলানো অরিন্দমের কেচে শুকোতে দেওয়া জামা প্যান্টের ঘ্রান নিতো , মনে মনে ভাবতো তৃষার তো কোন দোষ নেই । তাকে ও তার বাবা বিয়ে দিয়েছে -তার ও চোখে মুখে অগাধ স্বপ্ন ভবিষ্যতের -তার ও মনে একটা পরিপূর্ন স্বামী পুত্র নিয়ে আলাদা জগৎ তৈরি করার কামনা । অথচ সায়ম তাকে ঠকাচ্ছে শুধু অর্পিতার জন্য । হঠাৎ চিন্তার সূত্রটা ছিঁড়ে গেল সায়মের আওয়াজে ,
“-কি ম্যাডাম ! হারিয়ে গেছো নাকি ?” সম্বিত ফিরলো সায়মের ডাকে । কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সায়ম বললো , “পুরো তিন মাস আট দিন পর দেখা হলো । ” অর্পিতা প্রসংগ পাল্টে বললো , ”এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে ? না কোথাও গিয়ে বসবে ? “সায়ম হেসে বললো , “জো হুকুম মহারানী। ” স্টেশন থেকে বাইরে বেরোতেই সামনে একটা কফিশপ । অর্পিতা কফিশপে ঢুকলো , পেছনে সায়ম । দুজনে একটা টেবিলে বসতে ওয়েটার এগিয়ে আসলো , সায়ম জিজ্ঞাসা করলো , “শুধু কফি ! সাথে কিছু নেবে ?”
-“নাঃ ।”অর্পিতা অন্যমনস্ক ভাবে বললো । তারপর একটু থেমে ধীরে ধীরে বললো , “এভাবে চলতে পারেনা সায়ম ।আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে । ” একটু অবাক হয়ে সায়ম জিজ্ঞাস করলো , “কি চলতে পারেনা ?কি ভাবা উচিৎ?”
-“আমাদের এই মেলামেশা – যোগাযোগ রাখা । ”
-“কি সব আবোল তাবোল বলছো !আমি তখন থেকেই দেখছি কেমন যেন আনমনা তুমি । কি বলতে চাও খুলে বল ? অর্পিতা ওয়েটারের কাছ থেকে কফির কাপ টা নিয়ে চুমুক দিয়ে বললো , “আমি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে এসেছি। তোমাকে ভালোবাসি -আজীবন ভালোবাসবো । কিন্তু আজকের পর থেকে যোগাযোগ রাখবো না আর । ”
চমকে উঠলো সায়ম , কফির কাপ টা তুলতে গিয়ে হাতে পড়েগেল একটু কিন্তু সায়মের ভ্রুক্ষেপ নেই ।চিৎকার করে বলে উঠলো , “কেন ?এ তুমি করতে পারো না। ”
-আশপাশের টেবিলে বসা কয়েকজন সবিস্ময়ে তাকালো এদের দুজনের দিকে , সায়ম ব্যাপার টা আঁচ করে
কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বললো , “তুমি অরিন্দম কে ডিভোর্স দেবে না ?”
-“নাঃ ” শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে অর্পিতা বললো। তারপর আস্তে আস্তে বললো, “ভেবে দেখো , আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ী উনাদের কি দোষ ?অন্ধের মতো আমাকে ভালোবাসেন । কোন মুখে বলবো উনাদের যে আমি ডিভোর্স চাই ? অরিন্দম ! কত টা অবিচার করেছি তার উপর আমি । কিন্তু মুখ ফুটে কোন অভিযোগ জানায়নি । দোষ তো আমারই । আমার কি অধিকার আছে ওর ভালোবাসা
-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ! ”
মনে পড়লো পরশু রাতের কথা । অরিন্দমের সারারাত দৌড়াদৌড়ির কথা । বাড়ি ফিরে অরিন্দম যখন দেখে অর্পিতার গায়ে অসম্ভব জ্বর মাথা যন্ত্রনা। সেই রাতে বাড়ির হাউস ফিজিসিয়ান কে কল করেও পাওয়া যায়নি । সেই গভীর রাতে অর্পিতা কে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে নিচে নেমে এসে , গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করে সোজা আরোগ্যনিকেতন নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিল । তারপর ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে সারারাত মাথার কাছে বসেছিল। সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে ও থেমে থাকেনি । ভোরবেলা অর্পিতার ঘুম ভাঙতে চেয়ে তার পায়ের কাছে একটা চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছে -অফিসের পোশাক টাও পাল্টায়নি । তৎক্ষনাৎ নিজের কাছে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে গেছিল , কি ভুল টাই না করেছে এমন একটা মানুষকে দিনের পর দিন দূরে সরিয়ে রেখে । অরিন্দম অফিস যাওয়ার পর সারাটা দুপুর বিকেল এক সমুদ্র ভাবনার নিরবচ্ছিন্ন জালে ডুবে গেছিল । যে হালকা ভালোলাগা অরিন্দমের প্রতি জমে উঠেছিল সারাদিন সেটাই দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল মনের মধ্যে ।সেইদিন সিদ্ধান্ত নিয়েই মনে মনে রাতে সায়মকে ফোন করে বলেছিল আজকে দেখা করার জন্য । সায়ম আর্তনাদের মতো বলে উঠলো , “তোমাকে ভালোবাসি অর্পিতা । নিজের চেয়েও বেশি । ”
-“জানি । আমিও তোমায় ততটাই ভালোবাসি যতটা তুমি আমাকে ভালোবাসো । কিন্তু তৃষার কি দোষ বলতে পারো ?সেও তোমাকে স্ত্রী হিসেবে ভালোবাসে । কিন্তু তুমি তোমার কর্তব্য কতটুকু করেছ ?দুজনের জন্য দুটো পরিবার নষ্ট হবে এতগুলো জীবন নষ্ট হবে । আমাদের কোন অধিকার নেই অপরের জীবন নিয়ে খেলা করার, ” তারপর একটু থেমে বললো , “তুমি আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছ । আর অরিন্দম আমাকে শিখিয়েছে কি করে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা টিকিয়ে রাখা যায় । ”
-“কিন্তু আমরা ডিশিসন নিয়েছিলাম দুজনে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে শুরু করবো ।”
-হ্যাঁ বলেছিলাম ।
মানুষ অনেক সিদ্ধান্তই আবেগের বশে নেয় । সময়ের সাথে সাথে মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসা চিনতে পারে -সত্যিকারের মানুষ কে চিনতে পারে ।” কফির কাপ টা ঠান্ডা হয়ে গেছিল , সায়ম মুখে লাগায়নি । একরাশ যন্ত্রনা দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসছিল ভিতর থেকে। চোখ ফেটে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে আসলো -রুমাল বার করে চোখ মুখ মুছে নিল । তারপর বললো , “কি করে ভুলবো তোমাকে ?” অর্পিতা বললো , “ভুলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই । মনের এক কোনে রেখে দিও । কিন্তু যোগাযোগ রাখবো না ।নতুন করে আজ থেকে শুরু করো সায়ম । বুকে এত যন্ত্রনা -উৎকন্ঠা নিয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান । তারচেয়ে আমরা কি জীবন কে জয় করতে পারিনা ?”
সায়ম চুপচাপ বসে থাকলো মিনিট খানেক । কারোর মুখে কোন কথা নেই , সায়ম হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো , তারপর অন্যদিকে চেয়ে বললো , “ঠিক আছে আসি । ভালো থেকো । ” অর্পিতা বুঝতে পারলো সায়মের ভাঙ্গা গলা , বুঝতে পারছে সায়ম কান্না লুকোতে আগে ভাগে বেরিয়ে যাচ্ছে । বাধা দিলনা , চুপচাপ বসে দেখলো সায়মের চলে যাওয়া । চোখের সামনে ভেসে উঠছিল প্রথম পরিচয় -দীঘার বিচে বসে বসে পাথরের উপর গিটার বাজানো -কুহুদের বাড়ির কার্নিশে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে চুমু খাওয়া -অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলতে বলতে ফোন হাতে ঘুমিয়ে পড়া , সব যেন ধূসর অতীত -চাওয়া পাওয়ার সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূরে হারিয়ে যাওয়া ।
এক ফোঁটা জল চোখ থেকে গাল গড়িয়ে নিচে টেবিলের উপর পড়লো । সম্বিত ফিরলো অর্পিতার । উঠে কাউন্টারে বিল দিয়ে বেরিয়ে গেল । রাতের খাওয়ার পর অর্পিতা ঘরে ঢুকে দেখলো অরিন্দম ল্যাপটপে কাজ সেরে যেখানে ঘুমায় ঘরের কোনে বিছানা পাতানোর তোড়জোড় করছে । অর্পিতা কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দেখলো বিছানা করা তারপর বললো , “তুমি পালঙ্কে শোবে । এখানে বিছানা কোরোনা । ” অরিন্দম অবাক হয়ে বললো , “তাহলে তুমি কোথায় ঘুমাবে ?” অর্পিতা রেগেমেগে বলে উঠলো , “এত প্রশ্ন করো কেন ?আমার ব্যাপার আমি বুঝবো । তোমাকে যা বললাম তাই করো।”
অরিন্দম আরো অবাক হয়েগেল । চিরদিনই কম কথা বলে । অর্পিতার সাথে ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথা বলেনা । সেখানে প্রশ্ন করার প্রশ্নই ওঠেনা। আর অর্পিতাকেও কেমন যেন অচেনা লাগছে । এত জোরে সে কখনও কথা বলে না । অর্পিতা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে সারাদিনের ক্লান্তিতে শুয়ে পড়লো খাটে উঠে । সবেমাত্র তন্দ্রা টা এসেছে । অরিন্দম অনুভব করলো কেউ পালঙ্কে উঠে ঘরের লাইটটা অফ করে মৃদু নাইট বাল্বটা জ্বেলে পাশে শুয়ে পড়লো । সে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো , “কি ব্যাপার ! তুমি এখানে ?সূর্য কোনদিকে উঠেছে আজ ! ”
হালকা আলো আঁধারিতে কেউ বলে উঠলো , “আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ । আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি । ”
ঘুম ছেড়ে গেল অরিন্দমের । বলে উঠলো , “তাহলে ডিভোর্স নেবে না ?” দুটো নরম হাত দৃঢ় ভাবে অরিন্দমের গলা জড়িয়ে ফিসফিস করে বললো , “খুব প্রশ্ন কর তুমি ।আজ আমি আমার অতীত জীবনকে বিসর্জন দিয়ে এসেছি । নতুন ভাবে বাঁচতে চাই তোমার সাথে । ” অরিন্দম কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগে দুটো অপূর্ন ঠোঁট এসে মিশে গেল অরিন্দমের ঠোঁটে । দুহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল নরম শরীরটা কে ।