ও সকিনা গেছস কি না ভুইল্লা আমারে, আমি এহন আমি এহন রিসকা চালাই ডাহা শহরে সেই বিখ্যাত গানটি গাইতে গাইতে মজনু তার রিকসাটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ব্যস্ত শহরের নিরিবিলি এক রাস্তা দিয়ে।সন্ধ্যা পার হয়েছে কিছুক্ষন হলো,সন্ধ্যার পরেই সে রিক্সা বের করে।রাতের ক্ষ্যাপে ভাড়া বেশী পাওয়া যায়,উপরন্তু বকশিশও দেয়।
-ওই মামা দাড়াও?
-কই যাইবেন?
-রিকসায় পুরা শহর চক্কর দিবা,ঘন্টা হিসাবে ভাড়া,যয় ঘন্টা লাগবে ওই হিসাবে টাকা দিমু যাইবা?চার্জ আছে?
-হ, যামু।
-কও কত টাকা ঘন্টা?
-১২০ কইড়া ঘন্টা দিয়েন?
-মাথা ঠিকাছে?১০০টাকা ঘন্টা পোষায় নি দেহ?
-আর ১০ টাকা কইরা বাড়ায় দিয়েন।
-না মামা যেইটা কইছি ওইটাই।রাস্তায় চা বিড়ি যা খাবা সব আমাগো।
-আইচ্ছা উঠেন।
তিনজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে তার রিক্সা চালু করল মজনু,রাস্তায় নেমেই মেজাজ ফুরফুররা হয়ে গেল তার।মনে হঠাত করে ভাবের কথা এলো,কী আজব তামাম দুনিয়া মিল্লা একটা সেকেন্ড সময় বানাইতে পারেনা আর তিনটা মানুষ একশ টাকা ঘন্টা হিসেবে তার সময় কিন্না নিতাসে,কি আজব দুনিয়া! ভাবের কথা মনে পড়লেই মনটা উদাস হয়ে যায় মজনুর।একটু অন্যমনস্ক হয়ে রিকসা চালাতে লাগল মজনু। হঠাত পেছন থেকে প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে একজন ডাক দিল,
-মামা বিড়ি চলে?
-হ মামা খাই।
-ডার্বি চলে?
-মামা গরিব মানুষ,সবই চলে কোন কিছুতে না নাই।
মজনুর দিকে এক শলা সিগারেট বাড়িয়ে দিল যাত্রীটা। মজনু মনে মনে খুব খুশী,প্যাসেঞ্জার মনের মত হয়েছে,সবসময় ঘটনা সমান হয় না,কিছু কিছু খাটাশ এর বাচ্চা আছে বড়লোকি দেহায়, গালি ছাড়া কথা বাইর হয় না আজকের প্যাসেঞ্জারগুলো এমন না এরা কমবয়সী হাসিখুশি দেখলেই বোঝা যায় কলেজ ভার্সিটিতে পড়ে পোশাক-আশাক দেখলে বোঝা যায় ভালো পরিবারের পোলা।যাক ঠিকমত যদি ঘুরাইতে পারে আইজ রাতের খোড়াক নিয়া জলদি বাড়ি ফিরতে পারব।
মাইয়াটা অসুস্থ বউডারও যে কী এক স্বভাব সে যতক্ষন বাসায় না যায় না খায়া বইসা থাকে।মজনুর এটা দ্বিতীয় বিয়ে, প্রথম বিয়ে টিকেনাই।বছর দুইয়েক আগে সে ঢাকার নারায়নগঞ্জে রিকসা চালাতো তার আগের বউকে নিয়ে খুব সুখেই সংসার চলছিল তার কিন্তু বাধ সাধল স্থানীয় এক ড্রাগ ব্যাবসায়ী,সে ভয় এবং টাকার লোভ দেখিয়ে তার রিকসা ব্যাবহার করে অবৈধ মাল লেনদেন করত, তবে সেই সময়টাতে তাদের সংসারে আনন্দ নেমে এলো।কদিন পরেই তাদের কোন জুরে এলো ফুটফুটে মেয়ে,সে আদর করে নাম রাখল কলি।মেয়ের ঠিক দু মাস বয়সে তার জীবনে নেমে এল ভয়ঙ্কর বিপদ পুলিশ তাকে ইয়াবা সহ গ্রেফতার করল।তার স্ত্রী জানত না সে ইয়াবা ব্যাবসায়ীদের সহযোগী, জানার পর তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেল।
তার বাবা মা গ্রামের অল্পবিস্তর যা জমি জমা ছিল বিক্রি করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল।কিন্তু এদিকে আরেক বিপত্তি স্ত্রী তার মেয়েকে তার কাছে দেবে না। সে তার স্ত্রীর বাপের বাড়ি গিয়ে বসে রইল সে তার মেয়েকে ছাড়া নরবে না বলে ঘোষনা দিল।তার স্ত্রীর পরিবারের লোকজন তাকে না না ভয়ভীতি দেখালো এমনকি মাইর দিল যার কারোনে সে এখনো খুড়িয়ে হাটে,কিন্তু অবশেষে বাবার ভালোবাসার কাছে তারা পরাজিত হলো কিন্তু তাদের তালাক হয়ে গেল। সে তার মেয়ে কে নিয়ে চলে এল রংপুর,তার গ্রামের এক মেয়েকে মিয়ে করে রংপুরের এক বস্তিতে ঘর ভাড়া করে থাকতে লাগল,তার নতুন বউও তার মেয়েকে খুব আদর করে।আবার নতুন করে সংসার শুরু করল মজনু, গ্যারেজ থেকে দিন হিসেবে রিক্সা ভাড়া নিয়ে চালানো শুরু করল, যার বদৌলতে আজ ঘন্টা হিসেবে প্যাসেঞ্জার নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে শহরের অলিগলি আর রাজপথ।
-মামা থামাও মজনু ঘাড় ফিরে তাকালো,
-থামাবো?
-হ্যা মামা চা বিস্কুটের দোকানে থামাও সবাই মিলে নাস্তা করি।
-রিকসা সাইড করে হাইওয়ের পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে রিকসা থামালো মজনু,
নেমেই সবাই কেক বিস্কুট বোয়াম থেকে বের করে খাওয়া শুরু করল,তাকে অনুরোধ করা সে হাতমুখ ধুতে গেল রিকসা চালাতে চালাতে পুরনো কথা মনে করে চোখের কোনে পানি চলে এসেছিল তার হাতমুখ না ধুয়ে খাওয়া ঠিক হবেনা। হাতমুখ ধুয়ে একটা কেক বের করে নিল মজনু। সবাই অতিদ্রুত খাওয়া শেষ করে একটা করে জর্দা পান মুখে ঢুকালো আর সবার হাতে একটা করে গোল্ডলিফ,সফর সঙ্গী হিসেবে মজনুও পান আর সিগারেটের অংশীদার হলো। রাত অনেক হয়েছে তখন।চলন্ত রিকসায় সবার মুখ নড়ছে সবার মুখে সিগারেট রাস্তার লোকজন কেমন যেন চোখে তাকাতে লাগল।মজনুর মজাই লাগল।
যাত্রীদের মেসের সামনে নামিয়ে দিল মজনু মেস মেইন রোড থেকে দূরে গলিতে।দুইঘন্টার ভাড়া ২০০টাকা ছাড়াও ২০ টাকা এক্সট্রা আর দুটা সিগারেট বকসিস হিসেবে পেল সে, ক্রমাগত সিগারেট খাওয়া ছেলেটাকে ইয়ার্কি করে বলল সে আপনি আমার ডার্বি মামা, চারজনই একই সাথে হেসে উঠল তারা, মজনুর ফোন নম্বরটাও তারা সংগ্রহ করে রাখল তারা বলল আবার যেদিন ঘুরতে ইচ্ছে করবে ফোন দেবে তারা।মজনু হাসিমুখে বলল যখন ইচ্ছে ফোন দেবেন,এই বলে রিকসা ঘুরে চলে যেতে লাগল আর ছেলেগুলোও মেসে ঢুকে গেল।পাচ মিনিট রিকসা চালানোর পর মেইন রোডের কাছে এসে মোড় ঘুরাতেই আচমকা একটি ট্রাক এসে তার রিকসায় ধ্বাক্কা মারল, জ্ঞান হারানোর আগমুহূরর্তে সে দেখল এক পাশে রিকসাটা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে আর ট্রাকের এক পাশের দুটো চাকা তার পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।মজনু জানত না হাইওয়ে রাস্তার কাজ চলছে তাই সাময়িক ভাবে মালবাহী ট্রাক শহরের ভেতর দিয়ে চলাচল করছে।
(এক সপ্তাহ পরে) আমি রংপুর মেডিকেলে এসেছি রক্ত দিতে এক বন্ধুর খালার রক্ত লাগবে,এ+ আমার সাথে ম্যাচ করেছে,আর আমার মেসেরও খুব কাছে তাই চলে এলাম,রক্ত দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করে যখন রোগীর ওয়ার্ডের আশে পাশে ইতস্ততভাবে ঘোড়া ফেরা করছি তখন হঠাত আমার কানে শব্দ এলো কে যেন মৃদু স্বরে চিল্লাচ্ছে ডার্বি মামা ডার্বি মামা বলে আমি ভাবলাম আমার মত আর কে ডার্বি প্রেমিক আছে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি অনেকগুলো বেডের একটাতে মজনু নামক এক রিকশাওয়ালা শুয়ে আছে, সপ্তাহখানেক আগেই এর রিকসায় করেই ঘুরতে গেছিলাম তিন বন্ধু মিলে।আমাদের ভাষায় মাইন্ড রিফ্রেশমেন্ট।কিন্তু এর এই অবস্থা কেন?
কাছে গিয়ে বসলাম।
ঘটনা শুনে আমি পুরো থ হয়ে গেলাম।মন খারাপ হয়ে গেল কথায় কথায় তার মুখে তার জীবনে দুই বছর আগের ঘটে যাওয়া ট্রাজেডির কথাও শুনলাম,তার পরের স্ত্রী আর মেয়েও সাথেই ছিল।কি ফুটফুটে দুটি মুখ।আর কোনদিন কি এই মুখদুটি হাসতে পারবে? রাজপথের রাজা রিকসা আর সেই রাজ বাহনের চালক আমারদের মজনু কি নির্মম ভাবে ময়লা মেডে শুয়ে আছে।অথচ সেই রাতে সে কি জীবন নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিল।