বোকাসোকা বেলু দাদা

বোকাসোকা বেলু দাদা

মেয়েটা আচমকা পেছন ফিরে ডান হাত উড়িয়ে বেলু দাদার বাম গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললো, “লুইচ্চা, বদমাশ- ভিড়ের মধ্যে সু্যোগ পেয়ে মেয়েদের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিতে একবারো বিবেকে আটকায় না তোদের?”

বেলু দাদা তব্দাবস্থায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখছে। গায়ের রঙ কালো। ভরাট শরীর। প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে সামনের দিকে ভিড় ঠেলে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। সন্ধেবেলায় ফুটপাতে হুট করেই মানুষের ভিড় জমে ওঠে। আর সেই ভিড়েই হয়তো কেউ একজন মেয়েটার গায়ে হাত দিয়েছে, এবং তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি চড় হজম করতে হলো বেচারা বোকাসোকা বেলু দাদাকে।

আশেপাশের পাবলিকও ততোক্ষণে বেলু দাদার উপর কিছুটা চড়াও হয়ে উঠলো, দু চারটে কিল ঘুষিও মারলো। কোনো রকম সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসলো সে। বেলু দাদা এখন হাটুতে হাত দিয়ে শতো মাইল দৌড়ে আসা কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছে আর ভাবছে, “আমি ইচ্ছে করলেই মেয়েটার সাথে তর্কে যেতে পারতাম, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েরা এখন প্রতিবাদ করতে শিখছে, সাহসী হয়ে উঠছে- এটাও মন্দ কিসে? হয়তো আমি অপরাধ করি নি, কিন্তু স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছি আমার একটা বোন আর নীরবে চুপচাপ জঘন্যতম একটা অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়ে যায় নি, প্রতিবাদ করেছে। পুরো ব্যাপারটাই ইতিবাচক। আমার বরং আনন্দ করাই উচিৎ, হয়তো এভাবে প্রত্যেকটা বোন-ই একদিন প্রতিবাদ করা শিখে যাবে। আর ইজ্জতভ্রষ্টের ভয়ে হলেও আমাদের চারপাশের মানুষ গুলো কিছুটা সভ্য হবে।” বেলু দাদা সত্যিই বোকাসোকা সুচিন্তাশীল একজন মানুষ। সেদিন বেলু দাদা বাজার করে মেসে ফিরছিলো, ডানহাতে আলু আর পটলের ব্যাগ, বাম হাতে জীবন্ত তরতাজা কই মাছ আর অন্যান্য তরকারি। তখনই রাইসা ফোন করে বললো, “কোথায় তুমি এখন? তোমার সাথে একটা জরুরী দরকার আছে। এখনি দেখা করা প্রয়োজন।”

“আমি তো মেসের বাজার করে ফিরছি।”

“বাজার নিয়েই পাশে কোথাও দাঁড়াও। আমি আসছি ১০ মিনিটের মধ্যে।”

“আচ্ছা।”

এই বলে দুপুরবেলায় বেলু দাদা রাস্তার পাশে একটা ছাউনির নিচে দাঁড়ালো। প্রচণ্ড রোদ। বেলু দাদার নাকের ভেতর কিছু একটা সুড়সুড় করছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। হাঁচি আসবে আসবে করেও আসছে না। খুব অস্বস্তিকর জিনিস এটা। সকল অস্বস্তি কাটিয়ে চোখ বন্ধ করে যখন উচ্চস্বরে হাঁচিটা দিলো, তার নাকের একদলা ঘন সর্দি সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক পথচারীর গায়ে গিয়ে পড়লো। পথচারী রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বেলু দাদাকে একখান চড় ই মেরে বসলো। তার উপর বেলু দাদার হাতে থাকা আলু-পটলের ব্যাগটা টেনে নিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

বেলু দাদা তখন বসে বসে রাস্তা থেকে একটা একটা করে আলু-পটল তুলছে আর ভাবছে, “লোকটা চড় মেরে ভালোই করলো, আমার সচেতনতার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে ইদানীং। আর আলু-পটল গুলো ছুঁড়ে ফেলার জন্য ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে উনাকে একবার ধন্যবাদ দিয়ে আসি। না হয় শুধু শুধু দাঁড়িয়ে রাইসার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। অপেক্ষা এক মহা বিরক্তিকর জিনিস, তবে কোনো কাজ করতে করতে অপেক্ষা করলে সেই বিরক্তির তীব্রতাটা বেশ কমে যায়। দৌড়ে যাবো নাকি ধন্যবাদ দিতে? নাহ, যাওয়া ঠিক হবে না। লোকটা এমনিতেই খুব রেগে আছে।”

ততোক্ষণে রাইসা এসে হাজির। সাথে তার খালাতো বোন মণিকা। মণিকা গতকালই যশোর থেকে এসেছিলো একটা জরুরী কাজে। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি, যশোরে ফিরে যাবে। তার আগে সে রাইসার সেই ভালোবাসার সহজসরল মানুষটাকে একবার দেখতে চাইলো যার কথা রাইসা ফোনে সবসময়ই বলে। বেলু দাদা তখন মাথা তুলে বললো, “বাহ, তোমরা দুজন এসেছো দেখি। ভালোই হলো, তিনজনে মিলে এগুলো টুকানো সহজ হবে। সময়ও বাঁচবে।” এসব দেখে মণিকা হাসতে থাকলেও, রাইসা তীব্র দৃষ্টিতে বেলু দাদার দিকে তাকিয়েছিলো।

মণিকা মেয়েটা আধুনিকতায় নিজেকে ঢেলে দিয়েছে। একটা পাতলা টি-শার্টের সাথে টাইট জিন্স পরে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ আলাদাভাবে চোখে পড়ছে। সে জন্যই হয়তো বখাটে ছেলে গুলো বাজে কিছু মন্তব্য করার উৎসাহ পেলো, “আহ, কি খাসা মাল রে ভাই। দেখলেই মাথা নষ্ট হয়ে যায়। দেখ দেখ, একদম ফেটে যাচ্ছে। উফফফ!”

বিদায় নেয়ার আগে বোকাসোকা বেলু দাদা মণিকাকে বললো, “একটা ছোট্ট গল্প বলি শুনেন। কয়েকবছর আগে আমার এক বন্ধু বিদেশ থেকে খুব দামি একটা মোবাইল কিনে আনলো। মোবাইলটা দেখতেও বেশ আকর্ষণীয় ছিলো। সবসময় সে তার মোবাইলটা খোলাখুলি প্রদর্শন করতে চাইতো। পকেটে রাখলেও অর্ধেক বের করে রাখতো। তো একদিন নামাজ আদায় করতে দুজন মসজিদে ঢুকলাম। সেখানে ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা, এক নামাজী পকেটমারের আবির্ভাব হলো।

অবশ্য পকেটমারকে আমি ব্যক্তিগত ভাবেই চিনতাম। তার স্বভাব চরিত্র এমন ছিলো না। জানেন কেনো সে মোবাইলটা নিতে চেয়েছিলো? কারণ তার লোভ জেগে উঠেছিলো। এবার বলুন তো তার ভেতরে হুট করে লোভ কেনো জাগ্রত হয়েছিলো? কারণ তার চোখের সামনে এতো দামি, আকর্ষণীয় একটা মোবাইল ঝকমক করছিলো। আমার বন্ধু যদি তার মোবাইলকে লোকদেখানো ভঙ্গিতে না রেখে খানিক লুকিয়ে রাখতো, তাহলে হয়তো লোকটার মনে এমন লোভ জাগতো না। এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতো না।”

অর্থহীন সেই গল্পটা বলেই বোকাসোকা বেলু দাদা হো হা হা করে হাসতে শুরু করলো। আর মণিকা কেনো জানি লজ্জিত কন্ঠে বললো, “ধন্যবাদ বেলু দাদা। আপনাকে আমার বোন এখনো পুরোপুরি চিনতে পারে নি। সবসময় বকবক করে, বোকাসোকা বেলু দাদা, বোকাসোকা বেলু দাদা।”

বেলু দাদা সত্যিই একজন অসাধারণ মানুষ। তার ভেতরটা ভীষণ পরিষ্কার। তার সাথে যতো খারাপ কিছুই ঘটুক, তার কখনো কোনো অভিযোগ থাকে না। সে এমন যেনো, তার দুঃখবোধ নেই একবিন্দুও। একদিন মেসের সবাই মিলে তাকে তিন হাজার টাকা চুরির দায়ে বেদম পিটিয়েছিলো। অথচ ঘন্টা খানেক পরেই টাকার সন্ধান মিলে অন্য জায়গায়। তখনো বেলু দাদার কোনো রাগ, অভিমান বা অভিযোগ ছিলো না। কেবল ইশ ইশ করতে করতে ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলেছিলো, “যখন তোরা আমাকে মারছিলি তখন তো আমি চিৎকার করে বলছিলামই, আমি টাকা নিই নি, নিই নি। তোদের সবার কানে মনে হয় তখন তুলা দেয়া ছিলো।” আমাদের চারপাশে এমন সুচিন্তাশীল আরো অনেক বেলু দাদা আছে। যাদের কারণেই পৃথিবীর সভ্যতা এখনো কিছুটা টিকে আছে। অথচ আমরা তাদেরকে কারণে অকারণে ঠকাই, কষ্ট দিই।

বেলু দাদা তিন বছর ধরে প্রেম করে রাইসার সাথে। অথচ আজ পর্যন্ত রাইসাকে নিয়ে কোনোদিন নিরালা কোনো পার্কে যায় নি। কিন্তু আজ তার বন্ধু মুকিম তাকে বাধ্য করলো। মুকিম তার প্রেমিকার সাথে প্রেমালাপ করার জন্যই পার্কে যাচ্ছে। আর আমাদের বেলু দাদা যাচ্ছে পাহারাদার হিসেবে। বেলু দাদা মনে মনে ভাবছে রাইসাকে না বলে পার্কে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না একদম। বেচারি শুনলে পরে কি না কি ভাবে। কষ্টও পাবে।

পার্কের খানিক ভেতরে ঢুকেই বেলু দাদার চোখ কপালে উঠে গেলো। বেলু দাদা সাধারণত গম্ভীর হয় না, কিন্তু এখন তার পুরো চেহারাতেই গম্ভীরতার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ পাশে একটা ঝোপের ধারের বেঞ্চে রাইসা কারোর সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। রাইসার চুলগুলো ছেলেটা একহাতে মুষ্টিবদ্ধ করে, অন্য হাতটা রাইসার কোমরে গুঁজে দিয়ে তার মুখটা ধীরেধীরে কাছে টেনে নিচ্ছে।

বেলু দাদা এখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছে। তাকে এখন আরো বেশি বোকাসোকা লাগছে। অকারণেই বারবার হাসছে। তিন মাস পর রাইসা তার সতীত্ব এবং রোমান্টিক প্রেমিককে হারিয়ে বোকাসোকা বেলু দাদার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাতজোর করে অনবরত কান্না করছে। এখন কি করবে আমাদের বোকাসোকা বেলু দাদা? গ্রহণ? না বর্জন? দোষ কার? ছেলের? না রাইসার? নাকি বোকাসোকা বেলু দাদার? এই সমস্ত সস্তা নোংরা প্রেমের ফলাফল রাইসার মতো বুঝতে পারবে তো সবাই? হয়তো বুঝবে, সময়ে অথবা অসময়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত