মৃত মানুষ

মৃত মানুষ

এই দিনটাই বুঝি দেখার বাকি ছিল আমার জীবনে।আমার জীবনটা যে এমন হয়ে যাবে তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।কত ভালই না ছিলাম এক বছর আগেও।মাত্র এক বছরেই সব হারিয়েছি আমি। এক বছর আগের কথা বাবা,মা,আমি আর ছোট ভাই অপু।এই নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার। আমাদের বাবা একটি সরকারি অফিসের কেরানী ছিলেন আর মা ছিলেন একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা।ছোট ভাই সবে মাত্র ক্লাস ফোরে আর আমি ক্লাস টেনে।আমরা দু’জনেই লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিলাম।বাবা-মা’র সামান্য বেতনেও ভালভাবেই চলে যেত আমাদের দিনগুলি।

আমরা সবাই সকালে একসাথেই নাস্তা করে যার যার কাজে বের হয়ে যেতাম।আমি আর অপু একসাথে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যেতাম। যাবার সময় বাবা প্রতিদিন দু’জনের হাতে বিশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলতো কিছু খেয়ে নিস।মা আর অপু দুপুর ২টায় বাড়ি ফিরতো।আমার স্কুল,কোচিং শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকাল ৫টা বেজে যেত।আর বাবা আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যেত।বাবাকে কোনোদিনও ১০টার আগে বাড়ি ফিরতে দেখিনি।শত ক্লান্তি নিয়েও বাবা হাসি মুখে আমাদের সাথে কথা বলতেন।বাবার হাসি মুখখানা কোনোদিনও মলিন হতে দেখিনি।বাবা বাড়ি ফেরার পর সকলে মিলে একসাথে রাতের খাবার খেতাম।

মেলা হলে বাবা-মায়ের সাথে একসাথে মেলায় যেতাম।সেদিন মা খুব সুন্দর করে সাজতো আর আমাকেও সাজিয়ে দিত।মেলায় গিয়ে পুতুল নাচ,সাপ খেলা, বানর নাচ দেখতাম।সবাই মিলে একসাথে নাগর দোলায় চড়তাম।মা ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতো।মেলায় ঘুরে ঘুরে আমার পছন্দের চুড়ি,অপুর জন্য লাটিম, বাবা মা তাদের পছন্দের বই কিনতো।বাড়ি ফেরার সময় গরম গরম গুড়ের জিলাপি, পাপড় ভাজা, আর বাদাম কিনে বাদাম খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন মা নিজ হাতে আমাকে সাজিয়ে দিত।বাবা-মা দু’জনেই সেদিন তাদের নিজ নিজ কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আমাদের স্কুলে আসতেন। অনেক মজা করতাম সকলে মিলে।আমরা চারজন এভাবেই আমাদের ছোট্ট সংসারে অনেক সুখি ছিলাম।পৃথিবীর সকল সুখ যেন আমাদের ঘরে এসে জড়ো হতো।

কিন্তু কথায় বলে না বেশি সুখ মানুষের কপালে সহ্য হয়না।আমাদেরও হয়নি।রোজ সকালের মত সেদিন সকালেও সবাই নাস্তা খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম।বাবাও সকলের সাথে নাস্তা খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন।সেদিন ও বাসের ভিড়ের মাঝে ঝুলে ঝুলে অফিস যাচ্ছিলেন।কিন্তু অফিস যাওয়া আর হয়ে উঠলোনা।ভিড়াভিড়িতে বাবা হাত ফসকে বাস থেকে পরে গিয়েছিলেন।মাথায় আর বুকে প্রচন্ড ব্যথাও পেয়েছিলেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল মাথা থেকে।বাবাকে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।এরপর অনেক চিকিৎসা করানোর পরেও বাবাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।এক সপ্তাহের মধ্যেই বাবা তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।বাবাকে হারানোর শোকে মা-ও ক্রমেক্রমে অসুস্থ হয়ে পরে।এতটাই অসুস্থ হয়ে পরে যে মা’কে বিছানা ধরতে হয়।দীর্ঘদিন যাবৎ মা স্কুলে যেতে পারেননি তাই মায়ের চাকরিটাও হারাতে হলো।

ধীরে ধীরে সংসারে অভাব দেখা দিতে লাগলো।বাবার পেনশনের ২ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম।তা দিয়েই সংসার চলতো।এদিকে সামনেই আমার এস.এস.সি পরীক্ষা। আমি পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক ছিলাম না। আত্মীয় -স্বজন আর প্রতিবেশীদের কথামতো পরীক্ষায় অংশ নিলাম।অসুস্থ মায়ের দেখাশুনা, সংসার সামলানো, ভাইয়ের লেখাপড়ার দিকটা খেয়াল রাখা সব মিলিয়ে ভাল রেজাল্ট করতে পারিনি।দীর্ঘদিন যাবৎ মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন।এক সময় মাও আমাদের দুই ভাই-বোনকে একা করে দিয়ে চলে গেলেন।যাবার আগে শুধু এটুকুই বলে গেলেন__

–মিশু,মা’রে। তোর ছোট ভাইটিকে দেখে রাখিস।ওকে ভাল করে লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মত মানুষ করিস।
–মা,আমি অপুর কোনো অযত্ন করবোনা।অপুকে আমি লেখাপড়া করিয়ে তোমাদের কথা মত ইঞ্জিনিয়ার বানাবো।

এটুকুই ছিল আমার আর মায়ের শেষ কথা। এরপর মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।খুব কেঁদেছিলাম সেদিন।
মা চলে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই অনেক অভাবে পড়তে হলো আমাদেরকে।সম্পত্তি যা ছিল তা নিয়েও মামা-চাচাদের কাড়াকাড়ির কারণে সব হারালাম।আমি অভাবের তাড়নায় চাকরীর খোঁজে বের হলাম।কত মানুষের হাতে পায়ে ধরলাম একটা চাকরির জন্য।কিন্তু একটা এস.এস.সি পাশ মেয়েকে কে দিবে চাকরি? অবশেষে পাশের বাড়ির সেলিম ভাই একটা চাকরির সন্ধান দিল।গার্মেন্টসের চাকরি।এস.এস.সি পাশ করে এর চেয়ে ভাল কিছু আশাও করা যায়না। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা পাই।এতে করে অপুর লেখাপড়ার খরচ,বাড়ি ভাড়া আর দুই ভাই বোনের পেট কোনো রকমে চলে যায়।একদিন অপু এসে আবদার করে বসলো_

—আপু,একটা কথা রাখবি?
—হুম ভাই,বল কি কথা?
—আপু অনেকদিন ধরে পুরান জামা কাপড় পরে স্কুলে যাচ্ছি।স্কুল ব্যাগের সবগুলো চেইন নষ্ট হয়ে গেছে,জুতাটাও পরতে গেলে পায়ের আঙুল বের হয়ে যায় সামনের ফুটা দিয়ে।আমি যদি ভাল রেজাল্ট করি তাহলে কিনে দিবি?
—আচ্ছা, সামনের জানুয়ারি মাসের ১তারিখ তুই যখন সিক্সে উঠবি তখন সব নতুন কিনে দিব।
—আমার লক্ষ্মী আপু।(জড়িয়ে ধরে)
—অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমা গিয়ে।
—আপু….
—হুম?
—বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পরছে রে।মায়ের মত করে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবি?

—আচ্ছা, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তুই ঘুমা।

বরাবরের মতো এই বার ও অপু পি.এস.সি তে খুব ভাল রেজাল্ট করলো।আমিও আমার কথা মতো নতুন বই,খাতা,জামা,ব্যাগ সবই কিনলাম।শুধু কিনতে পারিনি জুতা জোড়া।সবকিছু নিয়ে অপুকে দিলাম।অপু খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।একটু পরেই বললো…..

—আপু,জুতা?
—ভাই, এসব কিনতে গিয়ে সব টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল।আর দুটো মাস একটু কষ্ট করে চালিয়ে নে।আমি টাকা জমিয়ে ঠিক কিনে দিব। বিকাল বেলা অপু একটা ব্যাগ হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এলো আমাকে দেখানোর জন্য।কিছুক্ষণপর ব্যাগ থেকে জুতা বের করে বললো….

—-দেখ আপু,মুচির দোকান থেকে জুতাটা সেলাই করে নিয়ে এসেছি।এবার অনেক দিন পরা যাবে। তাই না রে?

জুতার দিকে তাকিয়ে আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না।অনেক জায়গায় ছোট ছোট ফুটা হয়ে আছে আর বেশ কয়েক জায়গায় সেলাই করা।কী ছিলাম আর কী অবস্থা হলো আমাদের।কান্না কান্না কণ্ঠে বলে উঠলাম…..

—হুম,ভাই, অনেক দিন পরা যাবে। মার্চ মাস কেটে গেল তবুও অপুকে জুতা কিনে দিতে পারলাম না।এপ্রিলের মাঝামাঝি একদিন অপু এসে জিজ্ঞাস করলো….

—আপু, জুতা কবে কিনে দিবা?
—এইতো,এটা তো এপ্রিল মাস।

এই মাস তো প্রায় শেষ।সামনের মাসের ৫তারিখ বেতনটা পেয়েই কিনে দিব। কথাটা শুনে অনেক খুশি হয়েছিল অপু।এরপর কয়েকদিন পরপরই জিজ্ঞেস করে আপু ৫ তারিখ কবে?বুঝতে পারছিলাম অপুর আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না।

আজ সেই পাঁচ তারিখ।আজ হাফ টাইম কাজ করেই ছুটি নিয়েছি।বেতন পেয়েই জুতার দোকানে গিয়ে অপুর জন্য একজোড়া স্কুল জুতা কিনলাম।কিনে অপুকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য অপুর স্কুলে চলে গেলাম।অপুর স্কুলের পাশেই লাল ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছি।যার ভেতরে রয়েছে অপুর জন্য কেনা জুতা।একটু পরেই অপুর স্কুল ছুটি হলো।স্কুল ছুটি হতেই অপুকে গেটের সামনে দেখতে পেলাম।দেখা মাত্রই অপুকে ডাক দিলাম।আমার ডাক শুনে আর হাতে ব্যাগ দেখে খুশিতে দৌড়ে রাস্তার ওপাড় থেকে এপাড়ে আসতে লাগলো।ঠিক এমন সময় একটা ট্রাক এসে পিষে দিয়ে গেল আমার ভাইটাকে……

—অপুউউউউউউউউউউউউউউউউউউউ…….

থমকে গেলাম আমি।থমকে গেল আমার চারপাশ।কোনো কথা বলতে পারছিনা।অন্ধকার দেখছি চারদিকে।মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না।কথায় বলে অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়।হ্যাঁ, আজ আমি পাথর হয়ে গেছি।পারলাম না অপুর জন্য চিৎকার করে কাঁদতে। হাত থেকে পরে গেল ব্যাগটা। আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম রাস্তার মাঝেই।রাস্তাটা লাল হয়ে গেছে আমার ভাইয়ের রক্তে।আমার জীবনের সবচেয়ে আপন দুজনকে অনেক আগেই হারিয়েছি।আর আজ আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটাও হারালাম।আর এভাবেই আজ জীবিত থেকেও আমি মৃত মানুষ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত