তরতাজা যুবক একটা ছেলে খুব সুন্দর একটা মেয়েকে দেখে বলে, “শালীরার লাইগা আমরা পোলাপান পাইনা”! কথাটা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছি! সাথেও মজাও পেয়েছি। জানার আগ্রহ জাগল। “আকাইম্মা” জিনিস জানার ব্যাপারে আমার পিচ্চিকাল থেকেই খুব আগ্রহ। আমার সাথে ছেলেটার প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা একসাথে থাকি। এক সাথে মানে ওকে নিয়ে শুয়ে থাকিনা। কর্মক্ষেত্রে কাজ করি একসাথে। প্রথম দিন দেখেই বোঝে ছিলাম একটু মেয়েলি স্বভাব আছে। হাঁটার ধরন, কথা বলা এইগুলো দেখে যে কেউ বোঝবে।
এমন আগেও দেখেছি। কলেজে আমার সাথে মাইকেল নামের একটা ছেলে পড়ত। তার পকেটে টিসু দিয়ে মোড়ানো লাক্স সাবানের টুকরো, ফেয়ার এন্ড লাভলীর মিনি প্যাকেট, চুরুনী ইত্যাদি থাকত। একটা ক্লাস করেই মুখ ধুয়ে ক্রিম মাখত। হাফ লেডিস যাকে বলে। কিন্তু মাইকেলের মেয়েদের প্রতি বেশ আকর্ষণ ছিল। প্রেম করতে চাইত। সুন্দর মেয়ে দেখলে কামুকে দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকত। আমি যে ছেলেটার কথা বলছি, সে সুন্দর ছেলে দেখে ক্রাশ খায়। ছেলে হয়ে একটা ছেলেকেই খেতে চায়!
দু_একজনের মুখে শোনলাম ও হিজরা! আমার বিশ্বাস হয়না। ও হিজরা কিভাবে হবে? হিজরা দেখলে আমার কলিজা কেঁপে উঠে! আর আমি ওর সাথে সারাদিন কাটাই। আমার তো ভয় লাগেনি। ৪/৫ ক্লাসে পড়ার সময় মেলায় ঘুরতে গিয়েছিলাম কাজিনের সাথে। এক হিজরা আচমকা আমার লজ্জাস্থানে হাত দিয়ে বসে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল কলিজাটা আমার পায়ুপথ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
সেই ভয়টা আমার অনেক দিন ছিল।
এই ভয়টা একদিন ভয়ংকর হল, যেদিন দেখলাম ম্যানজার স্যারকে ১০/১২ জন হিজরা মিলে কাঁধে নিয়ে পুরো ফ্যাক্টরিতে ঘোরাল। ম্যানেজারের পরনে শুধু আন্ডার ওয়ার ছিল। তারপর একটা রুমে আটকে কি কি করল? আমি জানি না। অনুমান করে নিয়েছি। ঈদের আগে হিজরারা দল বেধে ফ্যাক্টরীগুলোতে চাঁদা তুলে। আর ওদের দিতেই হয়। বিশেষ করে ঈদের আগে একটু বেশী বেপরোয়া হয়ে যায়।
ঈদের আগে অবশ্য শুধু হিজরা না আর অনেক জাতের মানুষ পাগলা হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহনের ব্যাবসায়ী এই জাতের মানুষ গুলাও কম বেপরোয়া হয়না। আমি যে ফ্যাক্টরির কথা বলেছি সেখানে আমি চাকরি করতাম। ফ্যাক্টরি ম্যানেজার টাকা দিতে না করেছিল, আর সাথে ছিল খারাপ ব্যাবহার। একটা গ্রামীণ প্রবাদ আছে, “ডাইকা পাঠা লওয়া” পাঠা চিনেন তো? মানে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা। ম্যানেজার গালি দিয়ে “পাঠা নিল”। সেই দিনের পর থেকে হিজরা দেখলেই ১২০ হাত দূর দিয়ে যাই। যদি দেখি বাসে টাকা তুলতেছে, আমি আগেই টাকাটা বের করে রাখি।
আর এই ছেলেটাকে দেখে আমি ভয় পাইনা! এটা কিভাবে সম্ভব? আমার সাথে ওর পরিচয়ের ১০/১২দিন হবে তখন। শোনলাম ও হিজরা। বিশ্বাস হয়না। সবাই বলে, আমার বিশ্বাস হয়না। ওর কাছে জানতে চাইলে ঠোঁট,মুখ ভেটকাইয়া একটা হাসি দেয়। আমার বিশ্বাস হল। ওর আইডি কার্ড আর কিছু ছবি দেখে। হিজরা সম্পর্কে আমার ধারনা পাল্টে গেল।
ও একসময় ” কালেকশন” (চাঁদা তোলা) যেত। পারিবারিক আর্থিক সংকটের কারনে কালেকশনে যেত। ওদের নাকি বেশ বড় সমিতি আছে। সেখান থেকেই এই আইডি কার্ড দিয়েছে। এখন বছর খানেক যাবত যায় না। শরীর খাটিয়ে খায়। ফাও টাকা খেতে তার ইচ্ছা হয়না। তখন খুব বিপদ ছিল। এখন সারাদিন কষ্ট করে যে টাকা পায় কালেকশনে গেলে তার থেকে দশগুন টাকা বেশী পাবে তাও যায়না। ফাও টাকার প্রতি লোভ নাই এমন মানুষ কিন্তু কম আমাদের সমাজে।
এই ছেলেটার সবচেয়ে বড় গুন হল টাকাপয়সার দিক দিয়ে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। গরীব মানুষের প্রতি খুব মায়া। মোট কথা ওর হিজরা গিরি, সুন্দর ছেলে দেখে খেয়ে ফেলার ইচ্ছা, সমকামিতা এই জিনিস গুলো বাদ দিয়ে শুধু মানুষ হিসেবে দেখলে সে ভাল মানুষ। হিজরা সম্পর্কে ধারনা পাল্টে গেছে আমার। কালেকশনে না গিয়ে ওরা কাজ করেনা কেন? কাজটা দিবে কে? করবে কোথায়? আমরা বেশীরভাগ মানুষ ওদের ভয় পাই, ঘৃণা করি।