: ডিভোর্সী মেয়ে!
: ছি! ছি!
আমি পিছনে ফিরে তাকালাম না। যাক, বলে যাক। আমার কি! আমার আসবেও না যাবেও না। ওরা কি জানে আমার বুকের ভিতরের সুর! দিগন্ত ছাড়িযে যে ব্যথা আমি লুকিয়ে রাখি সংগোপনে। সেখানে আমি কাউকে জায়গা দেই না। ভুলতো আমারও ছিল। কেন আমি এক দেখাতেই বলেছিলাম ছেলে পছন্দ। আসলে আমার বুঝা উচিৎ ছিল। আরও কতদিন সময় নেয়া উচিৎ ছিল। আমি হাতের টিস্যু দিয়ে মুখের ওপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামটুকু মুছে নিলাম। একবার সামনে তাকালাম। সামাদ এখনও আসেনি।
ওকে বারবার বলেছি, তুই তাড়াতাড়ি চলে আসবি। আমি কোর্ট থেকে বেড়িয়ে যেন তোকে পাই। ছেলেটা যে কি! এখনও এল না। অনেকেই তির্যক দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখছে। সবাই জানে আমার বিয়ের কথাটা। আর কেনই বা জানবে না! আমি বেশ ফলাও করে বলেছিলাম আমার বিয়ের সংবাদটা। দাওয়াত দিয়েছিলাম ক্লাসমেটদের, তারা এখন অনেকেই আমার কলিগ। তাকালাম সামনে পথের দিকে। সামাইদ্দার বাচ্চা। গাল দিতে ইচ্ছে করছে ড্রাইভারকে। দুবছর আগে আকিবের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল। একদিনের দেখা। এক সন্ধ্যেবেলা মা হঠাৎ আমার রুমে এল।
: নিঝুম, খানিকপর বাসায় মেহমান আসবে। তোকে থাকতে হবে। তুই আবার খালামনির বাসায় চলে যাসনি যেন। আমি একবার ভ্রু কুঁচকালাম।
: কেন মা, আমাকেই কেন থাকতে হবে? সবাই বাসায় আছে।
: সবার জন্য নয়। তারা তোকেই দেখতে আসছে।
: আমাকে! আমি একবার রাগত চোখে মার দিকে তাকালাম।
: মা, আমি তোমাদের বলেছি সামনে পরীক্ষা।
: তাই বলে কি বে করবিনে! সারাজীবন পড়াশুনাই করবি!
আমি আর কিছু বলার আগেই মা বেরিয়ে গেছেন। আমি ল্যাপটপে মন দিলাম। বাইরে থেকে রান্নার খশবু ভেসে আসছে। মনে হয় কাবাব ভাজা হচ্ছে। আর আমি ভাবছি এত আয়োজনের কি দরকার! আমি সেদিন কমলা রঙের এক সুতি সেলোয়ার কামিজ পড়নে ছিলাম সেদিন। হুম ঠিক মনে আছে। একটা প্রেজেন্টেমন রেডী করছিলাম। মা হঠাৎ আবার রুমে এলন হন্তদন্ত হয়ে।
: নিঝুম, ছেলেরা এসে গেছে।
আমি হা করে একবার তাকালাম মায়ের দিকে! এমন উৎকন্ঠিত হবার কি প্রয়োজন! ছেলে পক্ষই এসেছে। বাঘতো নয়! আমি চশমাটা খুলে রাখলাম সামনে। ল্যাপটপটা সরিয়ে দেখলাম মা বেড়িয়ে গেলেন। আমি খাটে শুয়ে হাতে ভর দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। এবার বা হাত হতে ডান হাতে ভরটুকু ট্রান্সফার করলাম মাত্রই। রুমে ঢুকলেন সবুজ শাড়ী পড়া এক ভদ্রমহিলা। পঞ্চাশোর্ধ্ব। হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে।
: তা মেয়ে কি নাম তোমার? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম।
: জ্বি, আসসালামু আলাইকুম।
: ওয়ালাইকুমুস সালাম। এত ফরমালিটির কিছু নেই। খাট থেকে উঠতে হবে না। কি নাম তোমার?
: জ্বি, নিঝুম…
: বাহ, বেশতো। তা কবে এস এস সি?
: জ্বি, ২০০২ এ…
: এমা, এ যে একেবারেই বাচ্চা মেয়েরে!
আমি খানিক মাথা নিচু করে রইলাম। আমার থুতনি ধরে উঁচু করে ধরলেন উনি। আমার চোখের নিচের ডার্কসার্কেলটা চোখে পড়ল ওনার। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
: খুব রাত জাগ বোধহয়!
আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হলাম। পরে শুনেছিলাম ইনি হচ্ছেন আকিবের শ্রদ্ধেয় খালা। শ্রদ্ধেয় বলার কারণ আছে। শুনেছি আকিবের জীবনের সব ডিসিশন তার হস্তক্ষেপ ছাড়া হয় না। আকিব নাকি আমাকে দেখতে আসতে চায়নি। তার খালার হস্তক্ষেপেই এসেছে। মহিলা অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেন। বাংলাদেশে এসেছেন দুই মাসের জন্য। সে থাকতে থাকতেই আকিবের বিয়েটা হতে হবে। আমার যে কি হয়েছিল জানিনা! প্রথম দেখা! আগে কখনও দেখিনি। শ্যামলা, জোড়া ভ্রুর গোমড়ামুখো আকিবকে কি দেখে বললাম, হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে। দুদিনে আকদ। বেশ ধুমধাম করে পনের দিনে বিয়েটাও হয়েছে। আমি অবাক হয়েছিলাম যখন আকিব ধুমধামটা পছন্দ করছিলনা। সে গোপন করে যাচ্ছিল সবকিছু। এমনকি ছবি তুলতেও তার আপত্তি করছিল। আমার ফেসবুকে প্রথম বধুর পোস্টটি আমার জন্য সুখকর ছিল না। সে প্রচন্ড রাগে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। আমি আজও জানি না, কেন? আমি আজ আর তার উত্তর খুঁজে ফিরি না। কারণ আমি অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছি।
হঠাৎ ফোনে রিং বেজে উঠল। আকিব! আমি ইগনোর করতে শিখেছি। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি। মাটির পুতুলের মতন আমাদের সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। লোকে কি বলবে! সমাজ কি বলবে! খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতন করে শেষ সম্ভ্রমটুকুও বিলিয়ে দিতে চেয়েছি। পাষন্ড তখন বোঝেনি। আজ আমার ভিতরে পাথর জন্ম নিয়েছে। এ পাথর মোমের মতন গলে না। বরফ আর উষ্ণতা সব তার কাছে সমান। চোখের কোণে জলের ঝিলিক দেখা যায়।
: আকিব, আমার ’ল এর রেজিস্ট্রেশন কার্ড পাচ্ছিনা!
: আমি কেমনে জানব?
: না তোমার সামনেইতো রেখেছি!
: আমি কি চুরি করেছি নাকি!
আমি চুপ করে গেলাম। কাল রাতেই আকিব বেশ প্রেম নিয়ে এসিেছল আমার কাছে। চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে প্রতিরাত ধর্ষণ ব্যতীত রাতের বিছানায় ভিন্ন কোন গল্প হয়না আমাদের। এত মিস্টি প্রেম নিয়ে আকিব কেন এসছে! একবার সন্দেহ হয় আমার।
: নিঝুম…
: জ্বি।
: এত দূরে কেন? কাছে আস…
আমি অবাক হই। স্মৃতি ঘেটে বাসর রাতটুকু ব্যতীত কোন স্বপ্নময় রাত নেই আমার। শরীরের গল্পের শেষে কোন মনের গল্প আছে কিনা জানিনা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমি কোনদিন তা খুঁজতেও যাইনি। হয়ত কেউ প্রশ্ন তুলে আনতে পারে, ছয় মাসেই এতটা ক্লান্তি! আমার জায়গায় বসে দেখ ভাই!
: নিঝুম..
: জ্বি।
: ’ল পড়াটা ছেড়ে দাও।
: মানে?
: কি দরকার মেয়েদের ’ল পড়ে?
আমি শক্ত করে আমার ওপর হতে ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম। আকিব চরম ঘৃণা নিয়ে উঠে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরল।
: মাগী, আমি দেখে নেব তুই কেমনে পরীক্ষা দিস। আমি দাঁতে দাঁত চেপে রইলাম। পাঁচ আঙুলের এক থাপ্পড়ের দাগ ততক্ষণে বসে গেছে আমার গালে। ক’ফোটা চোখের জল নিরবে বালিশে পড়েছে হয়ত। শেফালী কখন যেন আমার পিছনে এস দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। শেফালী আমার হাতে পোড়া এক কাগজের টুকরো দিল।
: ভাবী, এইডা খুঁজতাছেন? আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। রেজিস্ট্রেশন কার্ডের একটা অংশ।
: কই পেলি! শেফালী মুখে আঙুল রেখে ইশারা করে চুপ করতে। ফিসফিস করে যা বলল, তাতে আমি আরও হতবাক হলাম।
: ভাবী, কাগজখান খালু পোড়াইছে।
: বাবা!
: হ। আমার বিশ্বাস চূরে আজ খানখান হয়ে গেল। একটু আগেই বাবা, মানে আমার শ^শুরমশাই আকিবকে ধমকালেন।
: বৌমা ’ল পরীক্ষা দিবে তোর অসুবিধা কোথায়? আমি খানিকক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম। শেফালী আমার হাতটা ধরল। আমি কাঁদছি। শেফালী পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলাল।
: কাঁইন্দেননা ভাবী। শেফালী হাতের ঝাড়– রেখে আমার পাশে বসল।
: ভাবী জানেন…আপনের বিয়াডা একটা যাদুর কাম। আমি অবিশ্বাসের দৃস্টি নিয়ে তাকালাম।
: হ, ভাবী। আপনেরে দেখতে যাইবার আগেই আপনের ছবি লইয়া খালাম্মায় কবিরাজের বাড়িত গেছিল। হেষে কবিরাজে হেই ছবি দাগাইয়া তাবিজ বানায় দিছিল। তাবিজ আম গাছের গুড়িত পুইত্যা রাখছিল।
: তারপর?
: তারপর যেদিন বিয়া হইল, হেদিন রাইতে আমারে লইয়া উডাইছে।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমি শিক্ষিতমেয়ে। আমার বিশ্বাস করা উচিৎ না। আমার বিশ্বাসে কি আসে যায়! আমি নিস্প্রাণ হয়ে যুদ্ধ করলাম আমার মনের সাথে। সব ত্যাগ করেও চাইলাম এতসব অভিনেতা অভিনেত্রিদের সংসারে নিজেকে টিকিয়ে একটা আশ্রয় তৈরী করতে। বাড়িতে বেড়াতে আসার পাঁচদিনের মাথায় নোটিশ এল তালাকের। প্রথমে আমি বি্শ্বাস করতে না পারলেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। নিথর হয়ে শুয়ে থাকতাম। মা এসে পাশে বসতেন।
: আমি কষ্ট পাচ্ছি। তুই আমার মেয়ে। নাড়ি ছিড়ে তোকে আমি জন্ম দিয়েছি। তুই কষ্ট পাবি সেটা দেখতে নয়।
বাবা এসে পাশে বসতেন।
: তুমি আমার অনেক ভালবাসার বস্তু। তুমি পাহাড়ের চূড়োতে থাকবে সেই স্বপ্নই আমি দেখেছি। তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙে দিও না। আমি কাঁদতাম ভয়ে, লজ্জায়, ঘৃনায়, অপমানে। একদিন, হুম একদিন মা এসে আমার পাশে বসলেন। হাতে ’ল পরীক্ষার রুটিন।
: তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে।
মা, হ্যাঁ আমার মা, আমাকে শিখালেন সমাজকে উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়াতে। শিখিয়েছেন নতুন এক জীবনের গল্প। আমি পিছনে ফিরে তাকাতে চাইনা। পাগলের মতন আকিব আমার পিছনে ঘুরলেও আমি এখন জানি আমার জায়গাটা। আমি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেই। চোখের সামনে ভেসে ওঠ মায়ের মুখখানা।
: মা, তুই সমাজের জন্য নয়, আমার জন্য বাঁচবি। তোর বাবার জন্য বাঁচবি। কে বলল, তুই ডিভোর্সী, তাতে আমাদের কিছু আসে যায়না। অনেক ভালবাসায় তোকে আমরা বড় করেছি। হয়ত আমরা সমাজের অংশ, কিন্তু তুই আমাদের অংশ। সমাজ আঙুল যতই তুলুক, সমাজ তোর পাশে না থাকুক। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য, সমাজকে বদলাবার জন্য, তুই থাকবি। বল, থকবিনা?
আমি তাকালাম, কেউ আমার পাশে এস দাঁড়াল। আজকে যার জন্য কোর্টে দাঁড়িয়েছি। যৌতুকের মামলা। মেয়েটা বড় অসহায়। আমি হাসলাম। মেয়েটিও হাসল। বিড়বিড় করে বললাম, মাটির এ সংসারে সমাজকে ঠিক পাল্টাতে তোমার পাশে থাকব মা, আমার সাহসী মা।