বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। প্রায় দশ মিনিট ধরে কলিংবেল চাপছি। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না। সচরাচর এমনটা হয় না। আজ কি হয়েছে বুঝতে পারছি না।
সপ্তাহ দুয়েক পর আমার বিয়ে। গত পরশু হতে হঠাৎ জ্বর চেপে বসেছে আমার। গতকাল ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। বিভিন্ন টেস্ট দিয়েছিলেন। আজ সেই সকল এক্সরে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। সবকিছু দেখিয়ে ফিরেছি। ফিরেই দেখি এই অবস্থা।
আরো কয়েকবার কলিংবেল চাপলাম। না কাজ হচ্ছে না। এবার দরজায় ধাক্কা দেওয়া শুরু করলাম। কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পর মা দরজা খুললেন। কিছু না বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন।
ভেতরে ঢুকে দেখি বাবা গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে জি বাংলার সিরিয়ালের প্রতি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি ঠিক দেখছি তো! উনি তো এসব পছন্দই করেন না। তাহলে আজ কি হয়েছে?
অন্যসময় অসুস্থ হলে মা কখনও এভাবে দরজা খুলে চলে যেতেন না। প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে ফেলতেন আমাকে। আজ হঠাৎ কি এমন হলো!
বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। অল্প সময়ে কি এমন হয়ে গেল? পরিবারের বিবাহযোগ্য একটি ছেলে অসুস্থ আর উনাদের কোনো মাথা ব্যাথাই নেই।
বাবার কাছে গিয়ে বললাম, “বাবা এই নাও এক্সরে রিপোর্ট গুলো। ডাক্তার বলেছেন ভাইরাস জ্বর। সুস্থ হতে দিন পাঁচেক সময় লাগবে। আর উনি……”
হাত দেখিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বাবা বললেন, “যাও নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।”
এ কি! ফ্রেশ হয়ে আসতে বলছেন কেন?
ছোটবেলায় কোনো অপরাধ করলে আমি বাইরে খেলতে চলে যেতাম। এরপর যখন বাসায় ফিরতাম তখন ঠিক এইভাবেই গম্ভীর হয়ে বলতেন, “যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।” আমিও বোকার মতো ফ্রেশ হয়ে আসতাম। এরপর সারা বাড়ি দৌড় করিয়ে করিয়ে আমাকে মারতেন উনি।
বিগত দশ-বারো বৎসরে এরকম মারামারির সম্মুখীন হতে হয় নি আমাকে।
আজ কি এমন করেছি আমি।
প্রেম করে দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ে করছি। তাছাড়া আমার প্রেমিকা মানে আমার হবু বৌ নীলা ভীষণ ভালো মেয়ে। রেগুলার পাঁচ-দশ টাকার ঝালমুড়ি আর দুই-এক গ্লাস পানি খাইয়ে এই মেয়েকে দুই-তিন মাস ভাত না খাইয়ে রাখতে পারবেন আপনি।
অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক সকল দিকেই আমার জন্য পারফেক্ট ও। আমার মা বাবাও তাকে বেশ সাদরে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আজকের সমস্যা টা কি তা বুঝে উঠতে পারছি না।
রুমে এসে চেইঞ্জ করে টানা আধা ঘণ্টা স্নান করলাম। এরপর লুঙ্গির দুই প্রান্তে দুই গিঁট দিয়ে পা দুটো উপরে তুলে দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে শুয়ে রইলাম।
এটা আমার টেনশন কমানোর ফর্মুলা। পায়ের রক্ত মাথায় নামাচ্ছি। রক্তের চাপে আমার সমস্ত টেনশন উপর দিকে উঠে পায়ে চলে আসবে। একে আমি বলি “হাফ স্লিপিং এন্টি-টেনশনিং” ফর্মুলা।
প্রায় মিনিট বিশেক এভাবে রইলাম। এরপর হঠাৎ রুমে মা,বাবা এবং ছোট বোন একসাথে প্রবেশ করলো। আমি পা নামিয়ে বসলাম। ছোটবোন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে যেন আমি চিড়িয়াখানার খাঁচায় রয়েছি।
বাবা শুরু করলেন, “তোকে নীলা বিয়ে করবে না বলেছে। বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চাইছে ওরা। ”
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম আমি।
নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করলাম, “মানে? কি সমস্যা ওদের?”
নির্লিপ্ত ভাবে বাবা বললেন, “সেটা তো তুমিই ভালো জানবে।”
এই বলে বাবা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। পিছন থেকে ছোটবোনটা বলে উঠলো, “তাহলে আমি আবার শপিং করতে পারবো বাবা। কি ভালো হয়েছে! দাদার বিয়েটা প্রতিবার ভাঙ্গুক। আমি অনেক অনেক শপিং করতে পারবো।”
শুধু শপিং এর কথা চিন্তা করে এমন অলুক্ষণে চিন্তা একমাত্র আমার বোনই করতে পারে। হয়তো কোনোদিন আমার কিডনিগুলোও বিক্রি করে আসবে আমার অজান্তে।
বাবা চলে যেতে যেতে বলছেন, “ছিঃ! আমার ছেলে হয়ে তুই এই কাজ করবি কখনওই ভাবি নি আমি।”
আমি কোনো কথা না বলে নীলাকে ফোন দিলাম। অনেকবার দিলাম। কিন্তু সে ফোন তুলছে না। নীলার বাবা মানে আমার হবু শ্বশুরকে ফোন দিলাম। দুইবার রিং হতেই উনি ফোন তুললেন।
আমি বললাম, “আংকেল নীলা কই?”
উনি বললেন, “নীলার সাথে তোমার কাজ কি? কখনও ফোন দিবে না ওকে। যদি দাও আমি পুলিশের সাহায্য নিব।”
গতকালও এই মানুষটা আমাকে বাবা বাবা বলে কথা বলতেন। আর আজ পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে।
আমি উনাকে বললাম, “আংকেল কি হয়েছে খুলে বলুন আমাকে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
এবার গর্জে উঠে উনি বললেন, “খুলে বলার কি আছে? তুই নিজেই তো সব খুলে রেখেছিস। ফোন দিবি না আর আমাকে।”
এটা বলেই ফোন কেটে দিলেন। তুই করে বলছেন আমাকে। তার মানে আর ফোন দেওয়া ঠিক হবে না। আমি বাবার কাছে গেলাম। দেখি চুপচাপ বসে আছেন।
আমি আস্তে করে বললাম, “কি হয়েছে বাবা? আমাকে কিছু না বললে আমি কীভাবে বুঝবো?”
কিছু বলছেন না উনি।
আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মা কি হয়েছে বলো আমাকে।” উনিও চুপ করে রইলেন। এরপর রান্নাঘরে চলে গেলেন।
এমন সময় দরজায় কেউ জোরে ধাক্কা দিল। ছোট বোন গিয়ে দরজা খুলে দিল। আমি দৌড়ে এসে দেখি নীলা এসেছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে।
মা রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করল, “কে এসেছে?”
ছোটবোন বলল, “দাদার সাথে যে বৌদি টার বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে ঐ বৌদি টা এসেছে। ”
ইচ্ছে করছে ঘাড় মটকে দিই মেয়েটার। পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় কিছু বলতে পারছি না আজ।
আমার সামনে এসে নীলা বলল, “ছিঃ! অভি ছিঃ! এটা কীভাবে করতে পারলে তুমি? আমার সাথে এইভাবে প্রতারণা করলে তুমি? তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ড আছে সেটা কখনো বললে না কেন আমাকে?”
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে নীলা। তুমি…..”
শেষ করতে পারলাম না।
হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠে নীলা বলে উঠল, “তুই চুপ থাক। আজকের পর থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করবি না তুই। ”
এরপর আমাকে বিভিন্ন অশ্রাব্য শব্দ শুনিয়ে সে চলে গেল।
এতকিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ বুঝতেই পারছি না আমার দোষটা কি। এদিকে কিসব বলে গেল নীলা। আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড মানে! রাগে নিজের মাথার চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে আমার।
বাবাকে গিয়ে রাগ করে বললাম, ” বলবে কি হয়েছে আমাকে? এতো নাটক করছো কেন সবাই?”
বাবা উল্টো ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে আমাকে বললেন, “সকালে তুই ফেসবুকে কি স্ট্যাটাস দিয়েছিস দেখ। এখন ন্যাকামো করা হচ্ছে না? থাপ্পড় দিয়ে তোর দাঁত সব ফেলে দিব আমি।”
আমি চুপ হয়ে গেলাম।
সামান্য এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য এতকিছু। ডাটা অন করে তাড়াতাড়ি ফেসবুকে ঢুকলাম।
দেখি আমি সকালে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম,
“এক্সরে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এলাম। সবাই দোয়া করবেন।”