আমি মহুয়া।বয়স ২১ বছর ৩ মাস ৮ দিন।আমার নামটা বাবার এক অতি প্রিয় বন্ধু রেখেছেন।নামটা আমার খুব পছন্দের। এখন আমি ছাদে একা একা হাটঁছি।নিচ থেকে মায়ের ডাক শোনা যাচ্ছে।
:মহু,এলি!কি করছিলিস ছাদে?
:কিছু,না,মা।এমনিতেই গেছিলাম।
:বেশ!মাঝে মাঝে এরকম একটু ঘোরাঘুরি করবি।সারাদিন ওরকম বইয়ে মুখ গুজে রাখতে হবেনা।
:তুমি আমায় বই পড়তে নিষেধ করছো?
:নিষেধ করছি না,তবে একটানা সারাক্ষন পড়তে নিষেধ করছি।
:আচ্ছা,এখন বলো কেন ডেকেছ?
:তোর বাবা অফিস থেকে ফোন করেছিল।বিকেলে তোকে দেখতে আসবে।তৈরি হয়ে থাকতে বলেছে।
:কয়টায় আসবে?
:এই ধর ৪/৫ টার দিকে আসবে।
রুমে চলে আসলাম।ছাদে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।মা-বাবাকে এসব বিষয়ে নিষেধ করে লাভ নেই।আগেও তাদের বলেছি যে আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না।পড়াশুনোটা শেষ করি।তারা মানে না।তাদের নানান যুক্তি।এখন আর বলি না।যা বলে কোন লাভ নেই,তা বার বার বলার কোন মানে নেই।
আমি পাত্রপক্ষের সামনে ভদ্র সেজে বসে আছি।পাত্রের বাবা অতি উচ্চ স্বরে হেসে হেসে বাবার সাথে কথা বলছে।এই ভদ্রলোকের সম্ভবত মুগ্ধ হওয়ার রোগ আছে।প্রথমত তিনি আমার বাবা-মায়ের আচরনে মুগ্ধ হয়ে গেছেন।তারপর থেকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয়েই চলেছেন।পাত্রের মা সবার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন।পাত্রের চাচা-চাচি আর সাথে নয়-দশ বছরের একটা ছেলেও এসেছে।সাথে পাত্র নিজেও এসেছেন।মা-খালাদের কাছে শুনেছি আগে মেয়ে দেখতে শুধুই গুরুজনরা যেত।কখনোই পাত্র নিজে যেত না।এখন যুগ পাল্টেছে।পাত্র নিজেই চলে যান পাত্রী পছন্দ করতে।বুঝলাম পাত্র পক্ষের আমার কাছে তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করার নেই।তারা সব খোঁজ খবর নিয়েই এসেছে।তবুও পাত্রীকে কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করতেই হবে।এটাই নিয়ম।
পাত্রের বাবা বাচ্চা মেয়েকে প্রশ্ন করার মতো করে আমায় জিজ্ঞেস করলেন- ‘মা,তুমি যেন কিসে পড়?’ ‘অনার্স সেকেন্ড ইয়ার,ফিজিক্স। ‘ ‘কোথায় পড়?’ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’ ‘ওহ্,হ্যা হ্যা।’ পাত্র পক্ষ চলে গেল।
আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি,তখন চাচাতো বোন রিংকি দিদি কে দেখতে এসেছে।রিংকি দিদি দেখতে আসার আগেই সে কেদেঁ কেটে এক বিশ্রী অবস্থা করে ফেলেছে।চাচি,মা সবাই মিলে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু সে কিছুতেই থামছে না।এরকম করলে রিংকি দিদি কে পাত্রপক্ষের সামনে নেয়া যাবে না।এতে পাত্রপক্ষ ভাববে মেয়ের হয়তো অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে।কিন্তু তার বাবা মা জোড় করে অন্য কোথাও বিয়ের ব্যবস্থা করছে।যদিও এ ধারনা মোটেও সত্য নয়।অল্পতেই কান্নাকাটি রিংকি দিদির অভ্যাস। যাই হোক,এই গুরুতর অবস্থার কথা মা গিয়ে চাচাকে জানালেন।চাচা প্রচন্ড রেগে গেলেন।রুমে এসে বাড়ি কাপিয়ে এক হুংকার দিলেন।রিংকি দিদি সহ পুরো বাড়ি নীরব হয়ে গেল।যাকে বলে পিনপতন নীরবতা।প্রায় সাথে সাথেই রিংকি দিদি চোখের জল মুছে সাঁজতে বসে গেল। পাত্র পক্ষের রিংকি দিদি কে বেজায় পছন্দ হলো।তারা ঐ দিনই আখ্ত করে রাখতে চায়।বাড়ির লোক প্রথমে একটু মোড়ামুড়ি করলেও পরে রাজি হয়ে গেলেন।
:মহু!খেতে আয়।
মায়ের ডাকে ঘোর কাটলো আমার।রাত হয়ে গেছে।খাবার টেবিলে বাবা বললেন পাত্র পক্ষের আমাকে পছন্দ হয়েছে।এখন আমরা রাজি থাকলেই তারা যত দ্রুত সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়।জানি বাবা শুনবেন না।তবুও বললাম যে আমি এখনি বিয়েটা করতে চাই না।আর কিছু না হলেও অনার্সটা শেষ করতে চাই।বাবা শুনলেন।বুঝলেন না।বাবা ঠান্ডা গলায় আমায় বোঝাতে চেষ্টা করলেন।তার মতে,তার শরীরটা কদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না।তিনি সারাক্ষনই আমাদের নিয়ে চিন্তিত থাকেন।তার কিছু হয়ে গেলে কে নেবে আমাদের দায়িত্ব।সে অন্তত পক্ষে তার মেয়েটাকে কারো হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান।
আমি বুঝলাম।বাবার কথার ওপর আর কিছু বলতে পারলাম না।বাবা যে আমাকে অনেক ভালোবাসেন তা আমি জানি।বারাবারি রকমের ভালোবাসা যাকে বলে।আমার কখনো কোন রকমের কষ্ট হোক,তা তিনি কখনোই চান না।
এসবের একমাসের মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে গেল।বিয়ের পর প্রথম যখন শাহেদের সাথে শশুর বাড়ি গেলাম তখন সবাই আমার দিকে আজব কোন জন্তু দেখার মতো করে তাকিয়ে রইলো।এ কেমন বউরে বাবা!যে তার বাপের বাড়ি থেকে লাগেজ,ব্যাগ,কার্টুন ভর্তি করে কাড়ি কাড়ি বই নিয়ে এসেছে।এ কেমন বই পোকা বউ!
তারা সবাই দেখছে আমি অনেক কিছু নিয়ে এসেছে।কিন্তু আমি জানি,আমি কিছুই আনতে পারিনি।ফেলে এসেছি আমার শৈশব,আমার কৈশোর।ফেলে এসেছি আমার সেই ছেলেবেলার পুতুলবিয়ের গল্প,ফেলে এসেছি আমার আদরের ছোট ভাইটাকে যে কিনা আমি ভাত না খায়িয়ে দিলে খেতেই চায় না,ফেলে এসেছি আমার মাকে যে আমার প্রতিটা বিষয়ের নিঁখুত যত্ন নিতেন,যে তার অগোছালো মেয়েটাকে গুছিয়ে রাখতো।ফেলে এসেছি আমার রাগী বাবাটাকে,এ বাড়িতে চলে আসার সময় যাকে খুজতে গিয়ে দেখি বারান্দায় পাতা চেয়ারটাতে বসে সে মুখ গুজে কাদঁছিলো।ফেলে এসেছি আমার মনভুলো বাবাটাকে যার কখনোই অফিস যাবার সময় চশমা নিতে মনে থাকে না,আমায় মনে করিয়ে দিতে হয়।
আমার এত বই দেখে,শাহেদ আমায় একটা পড়ার ঘর সাজিয়ে দিল।সেখানে বসে বসেই আমার সময় কেটে যায়।আমার শশুর-শাশুরি আমায় খুবই আদর করেন।এ বাড়িতে অনেকগুলো কাজের লোক।তারা সবসময় আমার কি লাগবে,কি না লাগবে তার খেয়াল রাখে।শাহেদের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়,মাঝে মাঝে কিছুটা রাত করেও ফেরে।আমার কখনোই একা একা লাগে না।বই পড়েই অনেক সময় পার করে দিতে পারি।প্রায়ই ফেরার সময় শাহেদ আমার জন্য নতুন নতুন বই নিয়ে আসে।মাঝে মাঝে কবিতার বই এনে আবৃতি করে শোনায়। প্রথম প্রথম দু-তিন মাসে একবার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম।এখন আর ছয় সাত মাস ছারা যাওয়াই হয়ে ওঠেনা।আমি নিজেই মাঝে মাঝে দেখি কতটা পর হয়ে গেছি আমি আমার বাবা-মা,ভাইয়ের কাছ থেকে।কিছুই করতে পারিনা আমি।
খেতে বসলে মনে পড়ে,আচ্ছা ভাইটা খেয়েছে? আমার শশুর যখন বাড়ি থেকে বেরোয় তখন মনে পরে বাবা কি বেরিয়েছে?চশমাটা নিয়েছে তো মনে করে?বাবার অসুধটা এখন কে এগিয়ে দেয়? আমি এসব বেশী ভাবতেও পারিনা।প্রচন্ড এক কষ্ট জানান দেয়-‘সে আছে’।তখনই ইচ্ছে করে বিশাল কোন খোলা মাঠে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলি-‘বাবা,মা কেন এত পর করে দিলে আমায় যে ইচ্ছে করলেই তোমাদের দেখতে পারবো না?কেন এত পর করে দিলে?কেন?’ পারিনা।পারি শুধু নিরর্থক কিছুক্ষন বারান্দার শিক ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়।অনার্স শেষ করি ফার্স্ট ক্লাসের সাথে।
ভালো ভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি।যেখানে অ্যাপ্লাই করবো সেখানেই জব হয়ে যাবে।শশুর মশাইকে এ কথা বলতেই তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন।পরে আমায় শাশুরি মা এসে জানালেন- তারা কেউই চায় না আমি জব করি।এ ফ্যামিলির কোন বউয়েরাই কখনো জব করে নি,আর করবেও না।এ শহরে তাদের একটা সুনাম আছে।তাদের এত বড় ফ্যামিলি বিজনেস!তাদের পুত্র বধূ বাইরে জব করবে।না,তা হয় না।আমি ইচ্ছে করলে আরও পড়তে পারি,কিন্তু জব করতে পারবো না।
সেদিনই বুঝে নিয়েছি,হয়তো এর নামই সংসার।কাউকেই দোষ দিই নি।আমার ভাগ্যে যা লেখা আছে,তাই ই হচ্ছে।
রাতে শাহেদ বাড়ি ফিরে রুমে ঢুকে দেখে আমি লাইট অফ করে বারান্দায় বসে আছি।শাহেদ কিছু বলেনা।কিন্তু বুঝতে পারছিলাম সে চাইছে আমি তাকে কিছু বলি।আর কিছু না হলেও অন্তত পক্ষে তার কাছে অভিযোগ করি,প্রতিবাদ করি,দোষারোপ করি।কিছুই বলিনা আমি।শান্ত ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে থাকি।কিছুক্ষন পর শাহেদ এসে চেয়ার টেনে আমার পাশে বসে।তার হাতে নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতার বই।সে ভরাট কন্ঠে আবৃতি করতে থাকে-
সংসার মানে সোনার কাঁকনে জীবনের রঙ লাগা,
সংসার মানে রক্তে-মাংসে সারারাত্তির জাগা।
সংসার মানে,অপেক্ষমাণ একজোড়া চোখে দাবি,
সংসার মানে সাজানো ভুবন আঁচলের খোঁটে চাবি।
সংসার মানে অনাগত শিশু,
পুতুলে সাজানো ঘর
সংসার মানে মনোহর নেশা,
ঈশানে-বিষাণে ঝড়।
সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা,
বেদনার জলাভূমি
সংসার মানে সংসার ভাঙা,
সংসার মানে তুমি।
আমি অপলক শাহেদের চোঁখে তাকিয়ে থাকি।শাহেদ আমার মাথায় হাত বুলোয়। কিছুদিন পর আমি অনুভব করি আমার ভিতর আরেক প্রানের সঞ্চার।দ্রুত সে বেড়ে উঠতে থাকে।হাত পা নাড়ে।আরেকটু বড় হলে সে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি দেয়।তার বাবা তার উপস্থিতি টের পাওয়ার জন্য কান পাতে।নতুন অতিথিকে বরনের আয়োজন চলতে থাকে।সে প্রতিমূহুর্তে আমায় জানান দেয় আমি আসছি। আমার সন্তান!প্রথম আমাদের ছোট্ট পরীকে যখন আমার কোলে দেয়া হয় তার মুখ দেখে আমি আমার সমস্ত প্রসব বেদনা ভুলে যাই। খুব আদর করে ওর বাবা ওর নাম রাখে বৃষ্টি।শিশু কন্যা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে।
সে এখন আঙুল আকড়ে ধরতেও শিখে গেছে।প্রথম তার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনে তার পিতা চোখের পানি লুকোয়।তার দাদুর পিঠে উঠে সারা বাড়ি চড়ে বেড়ায় সে।ছুটে এসে আমার কোলে শুয়ে পড়ে,আদুরে গলায় আবদার করে।বড়ই তারাতারি বেড়ে উঠতে থাকে আমার মেয়েটা।সে তার বাবার পাকা চুল বেছে দেয়,মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আমায় গল্প পড়ে শোনায়,লুকিয়ে লুকিয়ে আচার খায়।তার বয়স যখন পাঁচ,তখন জন্ম হয় তার ছোট ভাইয়ের।বৃষ্টি তার ছোট ভাইকেও দেখে রাখতে পারে,আবার মাঝে মাঝে আদুরে গলায় ভাইকে শাসনও করে।তার ভাইয়ের নাম মেঘ।বৃষ্টির সাথে মিলিয়ে মেঘ। স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি করে মেয়েটা বড় হতে থাকে।কেমন যেন হঠাৎ করেই আমার আর শাহেদের ছোট্ট বৃষ্টিটা অনেক বড় হয়ে যায়।
আজ বৃষ্টির বিয়ে।আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ওরা রওনা দেবে।বৃষ্টি চলে যাবে।আমাদের ছেড়ে মেয়েটা চলে যাবে অনেক দূরে, ইচ্ছে করলেই আমি আমার মেয়েকে দেখতে পারবো না,ইচ্ছে করলেই আমার মেয়েটা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরবে না,গল্প শোনাবে না।বৃষ্টি ওর বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।কাঁদে ওর বাবাও।বৃষ্টির মধ্যে আমি অনেক আগের মহুয়াকে দেখতে পাই।এ যেন বৃষ্টি নয়,এ অনেক আগের আমিই নতুন করে কাদঁছি।বৃষ্টি চলে যায়।পড়ে থাকে তার শৈশব,তার কৈশোর,পড়ে থাকে তার ছেলে বেলার সাজানো পুতুল ঘর,পড়ে থাকে সারাবাড়ি জুড়ে বৃষ্টির পায়ের ছাপ,পড়ে থাকে বৃষ্টির কান্না,বৃষ্টির আনন্দ।পরে থাকে শুধুই কিছু স্মৃতি আর কিছু স্মৃতি।