আমি যখন অনেক বড় হয়ে যাব তখনও কি তুমি আমাকে লাল আলতা, কাঁচের চুড়ি আর কাজল কিনে দিবে? বাবা হেসে উত্তর দিল
_তুই যখন বড় হয়ে যাবি তখন তোকে আমরা এক রাজকুমারের সাথে বিয়ে দিব।তুই তখন অনেক দূরে চলে যাবি আমাদের ছেড়ে।তারপর যখন তোর ছোট একটা মেয়ে হবে তখন আমি তোর সেই ছোট মেয়েটাকে এগুলো কিনে দিব।তখন তোকে আর এগুলো কিনে দিব না। কথাগুলো শোনার সাথে সাথে অভিমানে মুখটা কালো করে শুভ্রা উত্তর দিল, আমাকে অনেক দূরে কেন পাঠিয়ে দিবে?ও বুঝেছি! আমি তো তোমাদের কিছুই হইনা।আর থাক এখন থেকে আমাকে আর এগুলো কিনে দিতে হবে না। ছোট্ট মেয়েটার রাগ দেখে বাবা হেসে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।আর বললেন।
_রাগ করেছিস খুকুমনি!তুই তো আমার সব। তুই সারাজীবন আমার কাছে থাকবি। আর ওটা তো আমি মজা করেছি।আমি শুধু আমার শুভ্রাকেই সবকিছু কিনে দিব অন্য কাউকে না। অবশেষে মেয়েটার মুখে হাসি ফুটল।যেই হাসিটা ছিল মেয়েটার বাবার কাছে হীরের চেয়েও দামী।
শুভ্র মানে সাদা আর এটা ছেলেদের নাম তার যেহেতু মেয়ে তাই মেয়েটির বাবা মেয়েটির নাম রেখেছে শুভ্রা।কারন সাদা রঙ তার খুব প্রিয় ছিল কিন্তু ছোট্ট মেয়েটার সাথে বাবার এখান থেকেই মিল নেই আর সেটা হলো মেয়েটা লাল রং পছন্দ করত। লাল আলতা পরে চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে লাল কাঁচের চুড়ি পড়ে সাজতে খুব ভালবাসে মেয়েটা। আর এভাবেই কাটতে লাগল দিন আর বড় হতে লাগল শুভ্রা নামের সেই মেয়েটি। সেদিনকার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ ১৮ বছরে পা দিল।বাড়ি সহ আশেপাশের সবাই পাগল হয়ে গেল মেয়েটিকে বিয়ে দেয়ার জন্য।দেখতে দেখতে অবশেষে মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।সামনে শুক্রবার ওর বিয়ে।সবাই খুব খুশী কিন্তু নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলেন শুভ্রার মা এবং বাবা নামক মানুষ দুটি।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বিয়ের ঠিক ২ দিন আগে একরাতে হঠাৎ করে স্ট্রোক করে মারা গেলেন শুভ্রার বাবা।হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে শুভ্রার বাবা নামক প্রিয় আপন মানুষটি। যে তার মেয়েকে বড্ড বেশীই ভালবাসত!হয়ত সেও বিশ্রাম নিয়েছিল এই ব্যস্ত পৃথিবীর সকল কোলাহল থেকে। ২ দিন পর যেহেতু বিয়ে তাই শুভ্রা কোনভাবেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। সে সারাদিন কাঁদত আর পড়ে থাকত বাবার দেয়া সেই স্মৃতিগুলো নিয়ে।যেগুলো হলো এখন তার হারিয়ে যাওয়া বাবার একমাত্র স্মৃতি। তাই সবাই চেয়েছিল বিয়ের দিনটা পিছিয়ে দিতে কিন্তু ছেলেপক্ষ থেকে ছেলের মা ও মৃত্যুশয্যায় ছিল তাই তারা চেয়েছিল খুব দ্রুত ছেলেটাকে বিয়ে করে ছেলের বৌকে ঘরে তুলতে।
আর এভাবেই শুভ্রার সেদিনের বিয়েটা ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল শুভ্রার জীবনযুদ্ধ। যেখানে শুভ্রা কখনো কোনো কাজ করত না আজ সেখানে তার পুরো সংসারের হাল ধরতে হচ্ছে। কারন সে তো আর পারবে না তার মা আর আদরের ছোট ভাইটাকে ফেলে দিতে। অবশেষে শুরু হলো তার জীবন সংগ্রাম।সারাদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশন তার মাঝে আবার বহু কষ্টে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া আর অন্যান্য বহু ঝামেলা তো আছেই।এরকম হাজারো টেনশন নিয়েই শুরু হত তার দিন আর হাজারো ব্যস্ততা শেষে অন্ধকার রুমে বসেই কেটে যেত তার রাত।
_কিন্তু শুভ্রার সেই কালো চোখ আজ আর কাজল দ্বারা আবৃত হয় না। আজ হাজারো ব্যস্ততার কড়াল গ্রাসে সেই চোখের নিচে কাজলের পরিবর্তে স্থান পেয়েছে কালো দাগ। আজ আর শুভ্রা পায়ে লাল আলতা দেয় না কারন হাঁটতে হাঁটতে আজ তার পা ফেঁটে লাল রক্তটাই হয় আলতার প্রতিচ্ছবি।
_এরই নাম জীবন।সে মাঝেমাঝে ভাবনার জগতে প্রবেশ করে তার বাবাকে প্রশ্ন করে, বাবা! আর একটু দেরীতে গেলে কি খুব ক্ষতি হত তোমার?বাবা তোমার সেই আদরের শুভ্রা যে আজ বড্ড ক্লান্ত! আজ সে প্রচন্ড রোদে পুড়ছে কারন তার মাথার উপর থেকে সবচেয়ে বড় ছায়াটাই যে হারিয়ে গেছে!