অফিসের কাজ শেষ করে আসতে আজ অনেক দেরি হয়ে গেল। এতো দেরি হয় না কখনো। আশেপাশে কোনো রিক্সা টেক্সি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাসায় হেঁটে যাবারই সিদ্ধান্ত নিলাম। সবকিছু নীরব। আজ রাতের জ্যোৎস্না খুব মিষ্টি, তাই হেঁটে যেতে কষ্ট হবে বলে মনে করছি না । রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি। আমার বাসার গলিতে প্রবেশ করার আগে তিনটা গলি সামনে পড়ে। প্রথম এবং দ্বিতীয় গলির মাঝখানে যখন আসলাম, তখন হঠাৎ একটা গোঙ্গানির আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসলো।
চারপাশের শীতল বাতাস যেন ভারি হয়ে গেল। আমি এদিক সেদিক তাঁকিয়ে খুঁজতে লাগলাম, কোথা থেকে এবং কে এমন ভাবে গোঙ্গাচ্ছে। পনেরো বিশ পা পিছিয়ে যেয়ে দেখি, আওয়াজটা প্রথম গলির ভিতর থেকে আসছে। আমি আস্তে আস্তে গলির ভিতর প্রবেশ করলাম। দেখলাম, একজন বৃদ্ধ লোক একটা বস্তা নিজের শরীরে জড়িয়ে গুটিসুটি করে বেসে আছে। আমি তার কাছে যেতেই লোকটা পিছনে সরে গেল। হয়তো ভয় পাচ্ছে, কিন্তু কেন। আমি আর তার সামনে না যেয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে বললাম,
“ভয় পাবেন না। আপনি কে এবং এত রাতে এখানে কী করছেন?” বৃদ্ধ লোকটা আমার কথা শুনে মথা উঁচু করে আমার দিকে তাঁকালো। আমি খেয়াল করলাম, লোকটা ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে।
“বাবা তুমি আমাকে চিনবা না। আমি অনেক দূর থেকে এখানে পালিয়ে আসছি।” পালিয়ে আসছে এটা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। একজন বয়স্ক মানুষ পালাবে কেন।
“পালিয়ে আসছেন কেন?”
“বলছি, তার আগে আমাকে একটু পানি খাওয়াবে?
“হ্যাঁ অবশ্যই। আপনি আমার সাথে চলুন।”
আমি লোকটার হাত ধরে আমার সাথে বাসায় নিয়ে আসলাম। এক গ্লাস পানি দিলাম। উনি সবটুকু পানি এক নিঃশ্বাসে খেয়ে আরো পানি চাইলেন। আমি শুধু তাঁকিয়ে দেখছি, একটা মানুষ কত পিপাসা পেলে এমন আচরণ করতে পারে। আমি আলমারি ভিতর থেকে একটা চাদর এনে লোকটাকে দিলাম পড়তে। লোকটা চাদর নিজের শরীরে জড়িয়ে, আমার দিকে তাঁকি একটা হাসি দিলেন। যে হাসি টাকাপয়সা দিয়েও অর্জন করা সম্ভব না। আমিও একটা হাসি দিয়ে বললা,
“এবার বলুন তো কেন পালিয়ে আসছেন?”
“বাসা থেকে পালিয়ে আসছি গতকাল রাতে। আমি যদি পালিয়ে না আসতাম, তাহলে এতসময়ে আমি জীবিত থাকতাম না!”
“কারণ? সবকিছু খুলে বলুন আমাকে?”
“বাবা আমার টাকাপয়সা সবকিছু আছে। শুধু শান্তি নেই। আমার একটা মেয়ে, একটা ছেলে, আমি এবং আমার স্ত্রী’কে নিয়েই আমার পরিবার। দুইবছর আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সে তার স্বামী নিয়ে লন্ডন থাকে। তারা বেশ সুখেই আছে। একমাস আগে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলে, ছেলে বউ, আমি এবং আমার স্ত্রী নিয়েই ভালোই যাচ্ছিল আমাদের দিন। ছেলে নিজে ব্যবসা করবে, তাই আমার কাছে টাকা চাইলো। আমিও ছেলের সুখের জন্য সবকিছু বিক্রি করে টাকা দেই ব্যবসা করতে। কিছুদিন পর ছেলে তার সম্পত্তির অংশ দাবি করে। আমিও বাবা হয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করি। ঘটনা শুরু হয় আমার স্ত্রী অসুস্থ হবার পর। সে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে যায়। আমার ছেলের বউ’র উপড় কাজের চাপ বেড়ে যায়।
রান্নাবাড়া সংসার এর যাবতীয় কাজ তাকে করতে হয়। এবং শাশুড়ির দেখা শুনা তো আছেই। এতকিছু তার পক্ষে সামলানো খুব কঠিন হয়ে যায়। তাই সে প্রতিদিন আমার ছেলেকে এই বিষয় নিয়ে খুব বিরক্ত করতো। পরে বাসায় কাজের লোক রাখা হলো। তবুও নাকি আমার স্ত্রী খুব জ্বালাতন করতো তাকে। অথচ আমার স্ত্রী’র যদি কিছু প্রয়োজন হতো আমি তাকে সাহায্য করতাম। আমিও একজন অসুস্থ মানুষ। আমার হাপানী আছে। সবকাজ তো আর কাজের লোক দিয়ে হয় না। আমি বউমাকে কখনো কোনো কাজ সহজে করতে দিতাম না। যতটুকু পারতাম আমি নিজেই আমার স্ত্রী’র দেখাশুনা করতাম। একদিন আমার স্ত্রী গোসল করার জন্য বউমা’কে বললো। কিন্তু সে আমর স্ত্রী’র মুখের উপড়েই বললো, “বুড়া বুড়ি দুইজন তো সারাদিন ছেলের ঘাড়ের উপড়েই বসে বসে খান। টের তো পান না টাকা কামাই করতে কত কষ্ট। একদিকে ছেলের ঘাড়ে বসে তাকে জ্বালা দিচ্ছেন আর অন্যদিকে আমাকে জ্বালাচ্ছেন।” আমি বউমা’কে বললাম, “তুমি কী বলছো এসব?”
“আমি ঠিকই বলছি। পারলে নিজেদের কাজ নিজেরা করে নিন। আমি এতকিছু পারি না।”
“তোমার করতে হবে না”
” আপনি বললেও তো করবো না। আপনাদের এতটকু লজ্জা থাকা উচিৎ।”
আমি এই কথাটা মেনে নিতে পারি নাই। তাই বউমা’র গালে একটা চর মেরে বসলাম। সে কান্না করতে করতে বললো, “আজ আসুক আপনাদের ছেলে। তারপর কিভাবে আপনাদের উচিৎ শিক্ষা দিতে হয় ভালো করে দেখাবো।”
এটা বলেই সে তার বাবার বাড়ি চলে গেল। এদিকে আমার ছেলে অফিস থেকে এসে তার স্ত্রী’কে না পেয়ে আমার কাছে জিজ্ঞেস করে। আমি সবকিছু খুলে বলি। সে উল্টা আমাকে এবং তার মাকে খুব বেশি কথা বলে। রাতে তার স্ত্রী’কে নিয়ে বাসায় আসে। সাথে তার শালিকেও নিয়ে আসে। এবং আমাকে আর আমার স্ত্রী’কে স্টোর রুমে থাকার ব্যবস্থা করে এবং তার শালিকে আমাদের রুমে থাকতে দেয়। রাত এগারোটা, আমার স্ত্রী’র খুব জ্বর আসে। আমি ঔষধ আনতে বাহিরে দোকানে চলে যাই।
ঔষধ এনে আমি যখন স্টোর রুমে ঢুকতে যাবো ঠিক তখন, খুব গোঙ্গানির শব্দ পেলাম। আমি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে যা দেখলাম তা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। আকাশ জমিন মনে হলো এক হয়ে গেছে। চারদিকের বাতাস থমকে গেছে। দেখলাম, আমার স্ত্রী’র বুকের উপড় বসে আমার ছেলে গলা টিপে ধরে আছে। আর তার শালি দুই হাত ধরে রাখছে। এবং ছেলের বউ পা চেপে ধরে বসে আছে। এমন দৃশ্য দেখে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। একটা জোরে চিৎকার দেই আমার স্ত্রী রাহেলার নাম ধরে। আমার চিৎকার শুনে ছেলের বউ পাশের টেবিল থেকে একটা ছুরি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি বুঝে গেলাম, আমার স্ত্রী’কে যেহেতু ঐ নিষ্ঠুর পশু গুলো মেরে ফেলছে, তাহলে আমাকেও ছাড়বে না। আমি কোনোমতে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। সারারাত একটা পুকুরপাড় বসে কাটিয়ে দিয়েছি। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে রাতে ঐ গলিটার ভিতর যেয়ে বসে থাকি। তারপর তো তোমার সাথে দেখা হলো।”
আমি বৃদ্ধ লোকটার কাহিনী শুনে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। লোকটাও খুব কান্না কারছে। আমি লোকটার চোঁখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম, “আপনার শরীরে যে চাদরটা দিয়েছি, ঐটা আমার বাবাকে আমি কিনে দিয়েছিলাম। যেদিন রাতে কিনে নিয়ে বাসায় আসি, সেইদিন রাতেই আমার বাবা মারা যায়। আজ থেকে এই চাদরটা আপনার এবং আমি আপনার ছেলে আর আপনিই আমার বাবা।”
লোকটা আমার কথা শুনে তার বুকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আর কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। এ কান্না সুখের কান্না। এ সুখ হলো একজন বাবা হারা সন্তান তার বাবা’র মতো কাউকে ফিরে পাওয়া, একজন সন্তান হারা বাবা তার সন্তানকে ফিরে পওয়া।