আমার এনগেইজমেন্টটা একদম হটাত করে হয়ে গেল। ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময়, আমার হবু শ্বশুর শাশুড়ি আমাদের পরিবারের সাথে পরিচিত হতে এসে আম্মুর হাতের রান্না খেয়ে যাওয়ার সময় আমাকে একটা চেইন পড়িয়ে দিয়ে গেল আর বিয়ের তারিখও ঠিক করে গেল। শুধু দুই পরিবারের বাবা, মা আর কেউ না। ছেলে, মেয়ে আগেই পছন্দ করা ছিল, সুতরাং আর ঝামেলা করে লাভ কী? তাই বলে এইভাবে? বলা নাই, কওয়া নাই, আমার কোন বান্ধবী নাই, সাজ নাই তেমন কোন। আমার বান্ধবীদের দেখেছি এনগেইজমেন্ট এর মাস ছয়েক আগে থেকে গল্প শুরু হয়। আর আমার বেলা এই অবস্থা? তাও, আমি বাবার এক মেয়ে, প্রথম সন্তান। সেও। কিন্তু কী আর করা? নিজের পছন্দ মত জামাই পাচ্ছ, এটাই বড় কথা, চুপ থাকাই উত্তম। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ থেকে গেল যে আমাকে কোন আংটি পড়ান হল না। কতদিনের শখ, আংটি পড়ে লাজুক মুখ নিয়ে ক্লাসে যাব। বান্ধবীরা এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে সেই আংটি দেখার জন্য।
আমি বিজয়ীর মত অথচ সলজ্জ হেসে হাতটা বাড়িয়ে দেব। কোন পলাতক চোখ লুকিয়ে সেই আংটি দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলবে। আমি সন্ধ্যা বেলা পড়তে বসে, পড়া ভুলে আনমনে আংটির দিকে তাকিয়ে থাকব। সাদা পাথর থেকে সাত রঙের দ্যুতি বের হয়ে আমার মনে সাত রঙ্গা স্বপ্ন এঁকে দেবে। তার কিছুই হল না। ছিনতাইয়ের ভয়ে রিকশা চড়া আমি চেইনটাও খুলে রাখলাম। মনের দুঃখ মনে চেপে রাখলাম কিছুদিন, তারপর হবু বরকে একদিন বলেই ফেললাম দুঃখের কথাটা। সে বেচারাও তখন ছাত্র। পাস করে বিয়ের আগে চাকরি জুটাতে হবে এই টেনশনে মাথা খারাপ। যদিও এই দিব্যি তাকে কেউ দেয় নাই, তবুও। এখন সে এই আংটি সমস্যার সমাধান করবে কিভাবে? আমি অবশ্য একবারই বলেছি, কোন চাপ দেই নাই। কেমন করে যেন হাত খরচ টরচ বাঁচিয়ে, টিউশানির টাকা জমিয়ে সে এক হাজার টাকা জোগাড় করল। আমাকে একদিন ক্লাসের পর বলল চল নিউমার্কেট যাই। ওখানে তেমন একটা যাওয়া হয় না। কিন্তু আমার চাপাচাপিতেও তেমন কিছু বলল না। আমার বিস্ময় বাড়ছেই। সোনার দোকানে নিয়ে যখন ঢুকল আমি তো বাকরুদ্ধ।
‘একটা আংটি পছন্দ কর। ‘
‘কার জন্য?’
‘কার আবার, তোমার।’
‘ তুমি টাকা পেলে কোথায়?’
‘চুরি করি নাই।’ ওর উত্তর শুনে আমি বুঝলাম রেগে গেছে। আর কথা বাড়ালাম না।
ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। আমি নিজেই সোনার দোকানে গেছি এর আগে হাতে গুনে তিন চার বার। আম্মুর সাথে। আমাদের দুজনের দিকেই দোকানদাররা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মজাও পাচ্ছে মনে হয়। দুজনের চেহারাই বলে দিচ্ছে আমাদের বয়স আর আনাড়িপনা। আমি ওর পকেটের অবস্থা জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি অবস্থা বেশ খারাপ। আর সোনা কেনা কি যা তা কথা? একদম বড়দের ব্যাপার। এবং বড়লোকদের ব্যাপার। খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি, সব কিছুর দামই অনেক বেশি মনে হয়। তাছাড়া এক রাশ লজ্জা আর অস্বস্তিতে গলা জড়িয়ে আসছে। মিন মিন করে যখন বলি ‘ভাই, ওই আংটিটা দেখাবেন?’ নিজের কান পর্যন্তই যাচ্ছে না।
অবশেষে আমরা অসাধ্য সাধন করে এক হাজার টাকার মধ্যে একটা আংটি কিনতে পারলাম। ব্যান্ড রিং। পাথর নেই। পাতলা পাতের আংটি, মেশিনে বানানো। সেই আংটি পড়ে আমি ভীষণ খুশি। আর ও তো বিজয়ীর বেশে বের হল দোকান থেকে, সেই খুশি দেখে আমার খুশি গেল আরও বেড়ে। সুখী সুখী মুখ করে ঘুরে বেড়াতাম। না, বন্ধুদের দেখানো হয় নি। কেউকেই দেখানো হয় নি, তবে পড়তে বসে আনমনা হতাম সাত রঙের ছটা ছাড়াই। বিয়ের সময় সেই আংটি আমি কিছুতেই খুলবো না, অন্যান্য গয়নার সাথেই পড়ে থাকলাম। বহু বছর সেই আংটি আমার হাতে ছিল। শেষ পর্যন্ত, আঙ্গুল মোটা হয়ে যখন চেপে বসল, আর খোলাই সম্ভব না, তখন ভয়ে এক গয়নার দোকানে যেয়ে ওদের যন্ত্র দিয়ে কাটতে হয়েছিল। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে ও আর আমাকে কখনো কোন গয়না কিনে দেয় নাই। আমার সেটা নিয়ে বিন্দু মাত্র দুঃখ বা আফসোস ছিল না। আসলে দামি গয়নার প্রতি আমার কোন আগ্রহ কোন কালেই ছিল না।
সে তখনো পড়াশোনা করছে। আমরা বিদেশে। আমিও পড়ি। ছাত্র জীবনের দরিদ্র অধ্যায় চলছে। এর মধ্যে তার মাথায় ভুত চাপল, আমাকে একটা ভাল আংটি কিনে দেবে। আমাকে না জানিয়ে পয়সা জমানো শুরু করল। বেশ অনেকদিন ধরে। এক সময় আমার পড়া শেষ, আমি চাকরি শুরু করেছি। আমাদের অবস্থা একটু ভাল ততদিনে। এমনি এক সময় আমাকে জোড় করে ধরে নিয়ে গেল গয়নার দোকানে। প্রথমে আমি বুঝি নাই। চারিদিকে চোখ ঝলসানো হীরে জহরত। আমার সেই পুরানো অস্বস্তি ফিরে এল । বেশি বড়লোকি দোকানে ঢুকলে আমার যেটা হয়, এখনো হয়। দম বন্ধ লাগে। মনে হয় আমি এখানে খুব বেমানান আর সবাই সেটা বুঝে ফেলছে। তাছাড়া আমাদের পোশাক আশাক ও এতো সাধারণ, সঙ্গে আবার ট্যাঁ ট্যাঁ করা বাচ্চা। পাঁচ দশ মিনিট ঘুরে আমি বললাম ‘এখানে কেন এসেছি? খামাখা সময় নষ্ট। এগুলা দেখার কোন আগ্রহ আমার নাই।
সে খুব রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল ‘তুমি একটা আংটি কেন না। এই কয় বছরে তো খালি কষ্ট করলে। নিজের জন্য কখনো দামি কিছু কিনো না।’ ঢং দেখে আমার মেজাজ আরও খারাপ। মাত্র চাকরি পেয়েছি বলে কি এখন দুহাতে টাকা উড়াতে হবে? মাত্র না গাড়ী কিনলাম? আমাদের এতো টাকা নেই। ‘ ভাগ্যিস কথা বার্তা বাংলায় হচ্ছিল। ওর মুখ এইবার উজ্জ্বল হয়ে গেল ‘আমি গত এক বছর ধরে কিছু টাকা জমিয়েছি, তোমাকে না বলে। পরীক্ষার খাতা দেখেছি, ডিউটি করেছি। প্লিজ একটা আংটি কেন। তোমাকে একটা সস্তা দড়া আংটি পড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেটাই পড়ে থাক সব সময়। আমার সখ হয়েছে। ‘
আমার এইবার চোখে পানি চলে এসেছে। সেই পানি লুকাতে আমি তাড়াহুড়া করে আংটি দেখা শুরু করলাম। খুব বেশি দামি হওয়া যাবে না। ও পুরো টাকা নিজে দিতে না পারলে খুব লজ্জায় পড়ে যাবে। আবার দেখতে খুব চিপ হলেও হবে না, তাতেও সে নিজের অক্ষমতায় কষ্ট পাবে। ডায়মন্ড থাকতে হবে, সাত রঙ্গা দ্যুতির গল্প সে জানে। এই কঠিন সমীকরণ মেলানো খুব কঠিন। অবশেষে খুব ছোট্ট একটা ডায়মন্ড আর যার সাথে কিছু কুচো ডায়মন্ড মিলিয়ে দেখতে মোটামুটি চলনসই একটা আংটি আমরা কিনতে পারলাম। আংটিটার চেয়েও ওর হাসিটা ছিল অনেক বেশি দামী।
এরপর শুরু হল এক যন্ত্রণা। একটু পর পর আংটির খোঁজ নেয়। ঠিক আছে তো, হারিয়ে ফেলি নাই তো? এমন না যে আমি প্রতিদিন জিনিস হারাই। আমার মহা বিরক্তি লাগে, মাঝে মাঝে হাসিও পায়। এর অল্প কয়েকদিন পরেই আমাকে অন্য এক শহরে ট্যুরে যেতে হল। আমি তখন গাড়ী চালাতে পারি না। অফিসের এক কলিগের গাড়িতে যাতায়াত করছি হোটেল থেকে অফিসে।
একদিন সকালে ওজু করতে গিয়ে সেই আংটি পিছলে গিয়ে পড়ে গেল সিঙ্কের ভেতরে। আমার সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল। আমার চোখের সামনে ওর মুখটা ভাসছে, হাসি হাসি চেহারা। এই খবর আমি কিভাবে ওকে দেব? হাত, পা কাঁপছে আর চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়ছে। নিজেকে বার বার ধিক্কার দিচ্ছি। আমি কেমন বউ? এই দিশেহারা অবস্থায় একটা বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছিলাম, কলটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
ভীষণ ভয়ে ভয়ে হোটেলের রিসেপশনে ফোন করে বললাম এই ঘটনা, প্লাম্বার পাঠাও। আল্লাহকে এক মনে ডেকেই যাচ্ছি, যত দোয়া দরুদ জানি সব। ঘড়ির কাটা টিক টিক করছে। এদিকে একটু পরেই আমার অফিসে একটা ট্রেনিং। বিদেশি কলিগ মিনিট দশেকের মধ্যেই চলে আসবে। ট্রেনিঙে না যাওয়ার কোন উপায় নেই। নতুন চাকরি আর চাকরিটা আমার ভীষণ দরকার। ওকে আমার জন্য দেরি করানো সম্ভব না কারণ ট্রেনিঙের রেজিস্ট্রেশন টাইম পার হয়ে যাবে। আমার বুক কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আর কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে।
ওই অবস্থাতেই প্লাম্বার আসল। আমি এক বুক আশা আর আশংকা নিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পাইপের ভেতর থেকে আংটিটা উদ্ধার করল। ‘তুমি কলটা বন্ধ করে দিয়েছিলে বলেই পাওয়া গেল আংটিটা।’
আমি মনে মনে বলছি ‘এ আংটি কিছুতেই হারাতে পারে না। এটা একজন মানুষের অনেক কষ্টের উপার্জন।’
পুনশ্চঃ সেই মানুষটি এই শেষ ঘটনাটা আজও জানে না। সে সবসময় আমার লেখা পড়েও না। যদি চোখে পড়ে আশা করি ক্ষমা করে দেবে আমার অসাবধানতা।