হুড়মুড় করে আম্মুর রুমে ঢুকে মফিজা হলাম। এই রে মরেছি! বাঘ মামা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। চশমার গ্লাস ফেটে না যায় মাবুদ! কে জানতো এখানে বাঘ মামা(ছোট মামা) বসে আছেন। আগে জানলে তো এপথ মাড়াতাম না। এখন তো পালানোরও পথ নেই। আজ আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। টারজান তুমি কোথায় বাবুতা?
রুমে ঢুকে ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। না পারছি বের হতে, আর না পারছি দাড়িয়ে থাকতে। আমার শরীর ঘামছে। বুঝতে পারছি বিপি নেমে যাচ্ছে সড়সড় করে। কখন যেন আমি ঠাস করে পড়ে যাই। পড়লে অবশ্য মন্দ হয় না। মামার প্রশ্নের কবল থেকে তো বাঁচবো। কিন্তু এই পড়ে যাওয়া নিয়েও মামা একটা ইন্টারভিউ এর আয়োজন করবেন, ধুর! বেহুশ হবার নাটোক করবো নাকি ভাবছি। কিন্তু না নড়াচড়া করে তো থাকতে পারবো না। আর ঐ বাঘটা বেহুশ হবার পেছনে নানা রকমের কারণ খুঁজে বিসিএস প্রশ্ন করবেন। ধ্যাত্তেরি এই বাঘটা বড় মামার মত কেনো হলো না? আজ যদি বড় মামা এখানে বসে থাকতো তবে সীনটা হতো অন্য রকম। বড় মামা আমাকে দেখে ফিক করে হেসে বলতেন-
–“এই তো আমার মা চলে এসেছে। এখন সে তার মিষ্টি হাত দিয়ে মিষ্টি করে একটা পান বানিয়ে আমাকে খাওয়াবে।” কয়েক দিন আগে বড় মামা এসে ছিলেন। মামা এলেই ডোর বেল বাজানো বাদ দিয়ে বাহির থেকে আমার নাম ধরে ডাকেন। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিই। সেদিন বড় মামা বললেন-
–“জানিস মা তোর হাতের পান এতটাই সুস্বাদু যে তুই একটা পানের দোকান দিলেও পারিস।”
–“বলেন কি মামা? দেবো নাকি একটা পানের দোকান? শেষে কিন্তু দেশের যুবক ছেলেরাও পান খাওয়া শুরু করবে।”
–“তোর অতো ভেবে কাজ নেই। তোর পান বিক্রয় চললেই হবে। তবে ভয়ও আছে, কোনো পানখোর বুড়ো তোকে তুলে নিয়ে গেলে তো সব যাবে।”
কথা গুলো বলেই বড় মামা হাহা করে হাসতে শুরু করলেন। আমার মনে পড়ে গেলো ছোট বেলার কথা। তখন নানু বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে ফিরতেই চাইতাম না। আব্বু নিতে আসতো আর আব্বুকে দেখে কিছুতেই খুশি হতাম না। আব্বু আমাকে পটানোর জন্য বলতো, “অনেক পুতুল কিনে বাসায় রেখে এসেছি। আর যাবার পথেও আমার মাকে পুতুল কিনে দেবো।” আব্বুর কথা গুলো মিথ্যে নয়। সত্যিই আব্বু আমাকে নিয়ে যাবার জন্য পুতুল কিনে বাড়িতে রাখতো আর যাবার পথেও পুতুল কিনে দিতো। তবুও আমি যেতে চাইতাম না। লুকিয়ে থাকতাম আর আম্মু আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হতো। বিদায় মুহূর্তে যখন হাত পা ছুড়ে কাঁদতাম তখন বড় মামা আমাকে কোলে নিয়ে বলতেন-
–“মা আজ যাও আমি সামনে শুক্রবারে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো।”
আমি বড় মামার কথা বিশ্বাস করে বাড়ি চলে আসতাম কিন্তু সেই শুক্রবার আর আসতো না। প্রত্যেকবার বড় মামা একই ভাবে সান্ত্বনা দিতো আর আমি বিশ্বাস করতাম। বাঘ মামার ডাকে চেতনা ফিরলো। মামা বললেন-
–“পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?”
এই রে সেরেছে! এখন যদি বলি খুব ভালো হচ্ছে তাহলে তিনি বলবেন, “সারা বছর না পড়ে কি করে পরীক্ষা ভালো হয়?” যদি বলি, “পরীক্ষা ভালো হচ্ছে না” তাহলে বলবে, “সারা বছর না পড়লে পরীক্ষা ভালো হবে কি করে?” কি বলবো সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। বুদ্ধি এঁটে বললাম-
–“মোটামুটি হচ্ছে”
–“সারা জীবন কি এই মোটামুটির বাহিরে যেতে পারবে না? সেই তোমার ছোট বেলা থেকেই দেখছি যে, তুমি পরীক্ষা মোটামুটি দাও। মাস্টার্স শেষ করলে অথচ মোটামুটির মায়া ছাড়তে পারলে না? যাই হোক, সারা বছর না পড়ে মোটামুটি হলো কি করে? ম্যাজিক ট্যাজিক জানো নাকি? জানলে আমাকে একটু শিখিয়ে দাও। আমিও আমার স্টুডেন্টদের শেখাবো। আসলে আজ কালকার ছেলে মেয়েরা বেশির ভাগ তোমার মতই ফাঁকিবাজ বাদর। এরা লেখাপড়ার চেয়ে ফেসবুকিং বেশি করে আর আত্মীয় স্বজনদের ব্লক লিস্টে রাখে। তাই তোমার ম্যাজিকটা একটু শিখিয়ে দাও আমি সেটা আমার কলেজে ছড়িয়ে দেবো।”
যেটা মনে মনে ভেবে ছিলাম সেটাই হলো। জানতাম যে, তাকে ব্লকড করার মাশুল দিতেই হবে। আমার দোষ কোথায়? আমি তো বাধ্য হয়ে তাকে ব্লকড করেছি। উনি কোন আক্কেলে ভাগ্নিকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠান? মামা কখনো ফ্রেন্ড হতে পারে? তাও আবার যদি সে বাঘ মামা হয় তাহলে তো কথাই নেই। আমি রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেছি যেন উনার কাছে নোটিফিকেশন যায়। এতে উনি বুঝবেন যে আমি তার লিস্টেই আছি। তারপর ব্লক মেরেছি। এতেও উনি খান্ত হননি, উনি উনার আরেক আইডি থেকে আমার নাম সার্চ দিয়ে আমার প্রোফাইলে ঢুকেন।
একদিন শুনলাম উনি নাকি আমার লেখা সব দেখেন। এই খবর পাওয়ার পর এবার আর কাঁচা কাজ করিনি। মামার নামে বাংলাদেশে যত ইংরেজী বাংলা আইডি ছিল সব গুলানরে ব্লক মেরেছি। আহা কি বুদ্ধি আমার! ভাবা যায়! মনে মনে বললাম, যতই চিল্লাচিল্লি করেন না কেনো, আমি কিছুতেই আনব্লকড করছি না। আমি চুপচাপ আসামীর মত দাড়িয়ে আছি। যেন আমি স্কুলে পড়ি আর বাঘ মামা ক্লাসের স্যার। পড়া হয়নি তাই দাড়িয়ে আছি। এর মধ্যে তুষার বললো-
— “যাই চা খাবো।” সুযোগ পেলাম তাই সৎ ব্যবহার করতে হবে। বললাম-
–“দাড়া আমিও খাবো, আমিই বানাচ্ছি।”
–“কিরে ভুতের মুখে রাম নাম শুনছি যে! তুই যেচে চা বানাতে যাচ্ছিস? এই তুই সুস্থ আছিস তো?” রাগে শরীর জ্বলতে শুরু করলো। বললাম-
–“ভীষণ অসুস্থ আছি।”
–“তাই তো বলি! যাই হোক তুই মামার কাছে থাক, আমি তোর জন্য চা বানিয়ে আনছি।”
পুরাই একটা শয়তান ফাজিল ছেলে। কোথায় সে বোনকে বাঁচাবে তা নয়, বাঘের মুখে সাজিয়ে রেখে দিচ্ছে। কারো নিজের ভাই এত শত্তুর হয় না। এর শোধ আমি নিয়েই ছাড়ব ব্যক্কল বজ্জাত ছেলে। মামা বললেন-
–“তুমি যে আমাকে দেখলে পালাও সেটা আমি বুঝতে পারি।”
–“কই না তো, পালাবো কেনো? জীবনেও পালাই নি।”
–“এখনই তো পালাতে গেছিলে। যাই হোক লেখা পড়ায় আসি।”
ইয়া মাবুদ তুমি আমার কপালে এই সব না লিখলে পারতে না? আমার শরীর ঘামতে ঘামতে আমি শেষ। চা নয় গ্লুকোজ মেশানো পানি খাওয়া ফরজ হয়ে গেছে। মামা কি কি সব বলছেন তার একটাও আমার কানে ঢুকছে না। টিভিতে তখন ইরাবতী হচ্ছে। নাটকটা আসলেই কিন্তু খারাপ না।